১৯৭৯ সালের ৭ এপ্রিল ‘ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ অসম’(আলফা) সৃষ্টি হয়েছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবহেলার অবসান এবং মাত্রাছাড়া অবৈধ অভিবাসনের সমস্যা থেকে ভূমিপুত্রদের রক্ষার উদ্দেশ্যে। কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর দশ বছরে মোদি সরকার অনুপ্রবেশ রুখতে যা কিছু করেছে তাতে সমস্যার হাল ফিরেছে কি না তা নিয়ে অসমে অবশ্য বিতর্কের অন্ত নেই। কলমে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
চালাকি নিয়ে স্বামীজি একটা মহৎ কথা বলেছিলেন বটে, কিন্তু এখনকার দিনে তা আদৌ প্রাসঙ্গিক কি না, সে নিয়ে একটু ‘চায়ে পে চর্চা’চলতেই পারে। বছর শেষ হওয়ার মুখে এক যুগ আগে ধৃত আলফা নেতাদের সঙ্গে কেন্দ্র ও অসম সরকারের ত্রিপাক্ষিক চুক্তি সেই চর্চার কেন্দ্রে চলে আসছে। কারণ, চালাকিটা বেপর্দা হয়ে গিয়েছে।
বছর শেষের দুদিন আগে, ২৯ ডিসেম্বরের ওই চুক্তিকে সরকার ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দিয়েছে! সেটা নাকি অসমের বিচ্ছিন্নতাবাদ নিরসনের একটা মাইলফলক। কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকারি ভাষ্যে ‘রেড লেটার ডে’। ‘নতুন ভোরের সূচনা’। দিনটির এমন মাহাত্ম্য বর্ণনার কারণ, এর ফলে নাকি অসমে উন্নয়ন ও প্রগতির বন্যা বয়ে যাবে। যেভাবে হাঁকডাক করে রাজ্যের সম্ভাব্য উন্নতি ও প্রগতির কথা সরকার বলছে, তাতে মনে হতেই পারে যে, ভাবখানা এমন আলফা-র সঙ্গে এতকাল চুক্তি হয়নি বলেই যেন উন্নয়ন ও নির্মাণযজ্ঞ থমকে ছিল; শুক্রবার সেসব বাধাবিপত্তি কেটে গেল!
চুক্তিতে বিস্তর প্রতিশ্রুতি। বলা হয়েছে, এর ফলে অসমের আদি বাসিন্দাদের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত হবে অন্তত আগামী ৬০ বছরের জন্য। রাজ্যের উন্নয়নে কেন্দ্র দেড় লক্ষ কোটি টাকা খরচ করবে। তাতে কী কী হবে– চুক্তিতে সেই ফিরিস্তিও সবিস্তারে লিপিবদ্ধ। রাজ্যের আদি বাসিন্দাদের জমির পাট্টা দেওয়া হবে। দখলমুক্ত জমি নিয়ে ‘ল্যান্ড ব্যাঙ্ক’ তৈরি করে তা ভূমিহীন আদি বাসিন্দাদের মধ্যে বিলি করা হবে। রুগ্ণ চা-বাগানগুলোর স্বাস্থ্য ফেরানো হবে। অন্য প্রতিশ্রুতির মধ্যে রয়েছে নানা প্রতিষ্ঠানের পত্তন। এমনকী, রেলপথ সরঞ্জাম উৎপাদন কারখানা স্থাপনের কথাও বলা হয়েছে।
১৯৭৯ সালের ৭ এপ্রিল ‘ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ অসম’(আলফা) সৃষ্টি হয়েছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবহেলার অবসান এবং মাত্রাছাড়া অবৈধ অভিবাসনের সমস্যা থেকে ভূমিপুত্রদের রক্ষার উদ্দেশ্যে। কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর দশ বছরে মোদি সরকার অনুপ্রবেশ রুখতে যা কিছু করেছে তাতে সমস্যার হাল ফিরেছে কি না তা নিয়ে অসমে অবশ্য বিতর্কের অন্ত নেই। চুক্তি অনুযায়ী, অবৈধ অভিবাসন রুখতে নিরাপত্তা ব্যবস্থার দ্বিতীয় বেষ্টনী হিসাবে সীমান্ত পুলিশকে শক্তিশালী করা হবে। একগুচ্ছ আবেদনের নিষ্পত্তি সুপ্রিম কোর্টে না হওয়া পর্যন্ত রাজ্যে ‘সিএএ’ প্রয়োগ করা হবে না। আলফা নেতৃত্ব এতেই সন্তুষ্ট? এইসব প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাসে? স্রেফ এই প্রতিশ্রুতিগুলো পেতে এত বছরে ১০ হাজার মানুষকে প্রাণ দিতে হল? শুনতে একটু কেমন কেমন লাগছে না?
প্রশ্নগুলো রাজ্যে নানা মহলে আলোচিত। অথচ উত্তর নেই। না থাকারই কথা। কারণ, চুক্তির যৌক্তিকতাই প্রতিষ্ঠিত নয়। গত ১২ বছর ধরে আলফার যে-নেতারা মুখ ও মান বাঁচানো গোছের একটি চুক্তি করতে নয়াদিল্লির নর্থ ব্লকে মাথা ঠুকে মরেছেন, যাঁরা আজ নখদন্তহীন বৃদ্ধ মানুষখেকোর সঙ্গে তুলনীয়, সরকারি কৃপাধন্য, রাজ্য-রাজনীতির দিঘিতে সামান্যতম তিরতিরে ঢেউ তোলার ক্ষমতাও যাঁদের আজ নেই, এই চুক্তি হয়েছে তাঁদের সঙ্গেই, তাঁদের ও কতিপয় সমর্থকের আনুষ্ঠানিক পুনর্বাসনের তাগিদে।
এ দেশে ক্ষোভ প্রশমনের সহজতম ও নির্ভরযোগ্য সিদ্ধান্ত হল কমিটি গঠন। মুখ ও মান বাঁচানোর তাগিদ সম্পন্ন এই চুক্তিতে কমিটি গড়ার প্রতিশ্রুতির ছড়াছড়ি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর কথায় যদিও তা ‘ঐতিহাসিক’। শান্তির নয়া অধ্যায়। যা কিনা ‘আলফাকে ভেঙে খান খান করে দেবে!’চুক্তি ছিল না বলে এতকাল এসব উন্নয়ন কেন হয়নি, কোথায় বাধা ছিল, তা অবশ্য বোধের অতীত! চুক্তির প্রতিটি প্রতিশ্রুতি যে কোনও নির্বাচিত সরকারের রুটিন কর্তব্য। সেই দায়িত্ব না-পালনের দায় একদা ‘দুর্বিনীত’ আলফার ঘাড়ে চাপানো ভাবের ঘরে চুরি ছাড়া আর কিছুই নয়। তা নিয়ে রাজ্যের বিরোধী-মহল সরব। গণমাধ্যমে সেই সমালোচনা কতটা প্রতিফলিত, সে অবশ্য অন্য কথা।
আসল কথা পরেশ বড়ুয়ার ফোঁস! একদা ত্রাস আলফা নেতৃত্বের যে-অংশ ঢাকঢোল পেটানো এই চুক্তিকে আদৌ আমল দিতে প্রস্তুত নয়, সেই আলফা (স্বাধীন) গোষ্ঠীর নেতৃত্বে রয়েছেন এই ৬৬ বছরের গেরিলা যোদ্ধা। মায়ানমার ও চিন সীমান্তের কোনও এক অজ্ঞাত স্থানে তাঁর বাস। চুক্তির পরদিনই অজ্ঞাতবাস থেকে ফোনে এক সর্বভারতীয় গণমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন, ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনার বিরোধী কোনওকালেই ছিলেন না, এখনও নন। কিন্তু সেই আলোচনার ভিত্তি হতে হবে অসমের ‘সার্বভৌমত্ব’। সার্বভৌমত্ব নিয়ে আলোচনায় সরকার রাজি থাকলে এক টেবিলে বসতে আগের মতো তিনি এখনও প্রস্তুত। নচেৎ নয়।
পরেশ মানছেন না। চুক্তির প্রাসঙ্গিকতা ও যৌক্তিকতা তাই প্রশ্নবিদ্ধ। আজকের অসমে হীনবল আলফাবাহিত অশান্তির আশঙ্কা যৎকিঞ্চিৎ।
তবুও যতটুকু যা ওই পরেশের দিক থেকেই। গেরোটা এখানেই। গণমাধ্যমকে পরেশ তাই জানাতে ভোলেননি, তাঁকে দেওয়া মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তের প্রতিশ্রুতির দিকে তিনি তাকিয়ে রয়েছেন। কী সেই প্রতিশ্রুতি? পরেশের কথায়, মুখ্যমন্ত্রী নাকি তাঁকে বলেছিলেন সার্বভৌমত্ব নিয়ে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা তিনি কেন্দ্রকে বুঝিয়ে ছাড়বেন। ওই প্রতিশ্রুতি সত্যিই হিমন্ত দিয়েছিলেন কি? জানা নেই। যদিও জানা আছে, মনমোহন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি. চিদম্বরমের ঘোষিত নীতি ছিল হিংসা ও সার্বভৌমত্বের দাবি ত্যাগ করে আলোচনায় রাজি থাকলে সরকার তৈরি। মোদি সরকারের নীতিও অনুরূপ।
চুক্তিবদ্ধ অরবিন্দ রাজখোয়া, অনুপ চেতিয়া, শশধর চৌধুরী বা চিত্রবন হাজারিকাদের সঙ্গে পরেশ বড়ুয়ার পার্থক্য একটাই। চুক্তিপন্থীদের মতো নমনীয় তিনি আজও নন। যে লক্ষ্য নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের শুরু, আজ যে তা ধরাছোঁয়ার বাইরে। সেই সত্যি উপলব্ধি করা সত্ত্বেও পরেশ তাঁর কয়েকশো অনুগামী নিয়ে (সরকারের হিসাবে মাত্র ২০০) এখনও টিকে রয়েছেন। দিন দিন তাঁর শক্তিক্ষয় হচ্ছে। মনোবলও তলানিতে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অসাড়ত্বও তাঁর চেয়ে ভাল অন্য কেউ সম্ভবত বোঝেন না। তবুও ‘সার্বভৌম অসম’ নামক মরীচিকার পিছনে তিনি ছুটেই চলেছেন।
চুক্তি সই হলেও সরকার পুরো চুক্তিপত্র প্রকাশ করেনি। ফলে বিরোধীদের কাছে সবকিছু দিনের আলোর মতো এখনও স্পষ্ট নয়। তা না হোক, ২৯ ডিসেম্বর রাজধানী দিল্লিতে যে ‘অপটিক্স’ তৈরি হল, প্রচারগুণে লোকসভা ভোটে তার অবদান কে অস্বীকার করবে? অসমের ভালো-মন্দ পরের কথা, ডাব্ল ইঞ্জিন সরকারের সার্থকতা ও দেশের ত্রাতা মধুসূদনের জয়গাথার নতুন আখ্যান তো রচিত হল! সেই আখ্যানে ‘কাব্যে উপেক্ষিতা ঊর্মিলা’ হয়ে রইলেন শেখ হাসিনা। ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার
প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনা প্রথম বছরেই উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কোমর ভেঙে দিয়েছিলেন। নভেম্বরে প্রথম গ্রেপ্তার করেন অরবিন্দ রাজখোয়াকে। একে একে অন্যদেরও। ভারতে সবশেষে ফেরত আসেন অনুপ চেতিয়া। অধরা শুধু পরেশ। সেই থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলও শান্ত। হিমন্তের স্বীকারোক্তি, হাসিনার প্রতি তাঁরা কৃতজ্ঞ, কেননা, তাঁর দৌলতে ভারতের নর্থ-ইস্ট নিরুপদ্রবে নিদ্রা যায়!
‘ঐতিহাসিক’ চুক্তির দিন সরকারের কণ্ঠে হাসিনার অবদানের উল্লেখ না থাকা বিচ্যুতি কি না– তা ভিন্ন আলোচনা। তবে বিচ্যুতি হিসাবে অবশ্যই চিহ্নিত থাকবে কংগ্রেসের সমালোচিত না হওয়া। এই প্রথম কংগ্রেসকে না দুষে মোদি সরকার ‘ঐতিহাসিক’ কিছু একটা করল! চুক্তির পর অরবিন্দ রাজখোয়া কিন্তু শান্তি প্রক্রিয়া শুরুর জন্য মনমোহন সিং ও তরুণ গগৈয়ের অবদান স্বীকার করেছেন। অমিত শাহ বা হিমন্তের কাছে তা নিশ্চিত শ্রুতিমধুর ছিল না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.