বুলেট ট্রেন থেকে ভারতকে ডিজিটাল করে তোলার প্রয়াস৷ মেক ইন ইন্ডিয়া থেকে স্বচ্ছ ভারত অভিযান৷ কোনও না কোনও স্লোগান তুলে কর্মরত দেশের প্রধানমন্ত্রী৷ দেশের হিতের জন্যই তো? রাজনীতির বেড়াজালে থেকে কি দেশসেবা করা অসম্ভব? উত্তরের খোঁজে সুলয়া সিংহ৷
“হর হর মোদি, ঘর ঘর মোদি…৷”
বছর আড়াই আগে এই সংলাপটি শাহরুখ খানের “রাহুল… নাম তো শুনা হোগা”র মতোই সুপারহিট হয়েছিল৷ সারা দেশ ভুগেছিল মোদি নামক জ্বরে৷ যার ফলস্বরূপ দেশের ১৪তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শাসকের আসনে বসেছিলেন গুজরাতের নরেন্দ্র দামোদর ভাই৷ জয়ের আগে এবং পরে দেশকে বদলে ফেলার নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন৷ জোর গলায় বলেছেন ‘অচ্ছে দিন’ আসবে৷
গত মঙ্গলবার যখন প্রধানমন্ত্রী ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করলেন, একই সঙ্গে বিস্মিত আর গর্বিত হল গোটা দেশ৷
বিস্মিত এই ভেবে, যে আগামী ক’টা দিন তো এই নিয়ে দেশ তোলপাড় হবে৷ সাধারণ মানুষ সমস্যায় পড়বে৷ সেনসেক্স ঝপ করে নিউটনের আপেলের মতো নিচে পড়ে যাবে৷ আর ভোট ব্যাঙ্ক? ১২৫ কোটি যখন এই একই সমস্যায় পড়বে তখন মোদির কী হবে? আগামী নির্বাচনে একটিও ভোট যে জুটবে না তাঁর! ভোটের রাজনীতিতে তো আম আদমির মন জুগিয়ে চলাই চিরন্তন নিয়ম৷ তাহলে? তখনই এল গর্বিত হওয়ার পালা৷ মনে হল, নাহ্৷ তার মানে ভোটের কথা না ভেবেই দেশের স্বার্থে এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মোদি৷
রাস্তায় এটিএম-এর সামনে লাইন দিয়ে বাস্তবটা আমার কাছে আরও স্পষ্ট হল৷ আমি একা নই৷ আমার মতো অনেক ‘আমি’ই গর্বিত৷ আমি মানে আম আদমি৷ যে কোনওভাবেই ‘হোক কলরব’-খ্যাত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত নয়৷ তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে সঙ্গীকে চুমু খেয়ে প্রতিবাদও জানায়নি৷ তবে পেটে পুঁথিগত বিদ্যে অবশ্যই রয়েছে৷ আমি মানে যাঁর ড্রাইভারও নেই, তাই তাঁকে নিয়ে মোক্যাম্বো যাওয়ার পালাও নেই৷ কিন্তু জুকারবার্গের তৈরি দেওয়ালের হালহকিকতের বিষয়ে তারা ওয়াকিবহাল৷ যে আমি কোনও রাজনৈতিক দলের ঝান্ডা হাতে পথেও নামেনি কখনও৷ সেই আমার বাড়িতে তল্লাশি চালালে সিটি গোল্ডের গয়না ছাড়া আর কিছুই মিলবে না৷ খোলা মাথায় চিন্তা করলে যতটুকু বোঝা যায়, ততটুকু দিয়েই যে আমি যুক্তি সাজায়৷ সেই ‘আমি’রা দারুণ গর্বিত৷ যাঁরা পাক অধিকৃত কাশ্মীরে সরকারের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের ঘটনাকে দু’হাত তুলে স্বাগত জানিয়েছিল৷ ১০টা-৫টার জীবনে আটকা পড়ে দেশসেবা করা থেকে যারা বঞ্চিত হন, মোদি যেন তাদের দেশসেবার সুযোগ করে দিয়েছেন৷ অর্থাৎ তাদের মতে ‘নোট বাতিল’ এক্কেবারে সঠিক সিদ্ধান্ত৷ তবে মুদ্রার উল্টোপিঠও তো রয়েছে৷ যারা এটিএম-এর লাইনে দাঁড়িয়ে বিরক্ত৷ তাদের হিংস্র দাঁত, নখ আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে৷ হট করে এমন সিদ্ধান্ত কেউ নেয়?
আচ্ছা, সত্যিই কি এই সিদ্ধান্ত আটঘাট না বেঁধে রাতারাতি নেওয়া হয়েছে? তাহলে এক বছর আগে থেকে কেন প্রধানমন্ত্রী আধার কার্ড আবশ্যক করার নির্দেশ দিয়েছিলেন? কেন প্রতিটি দেশবাসীকে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে বলা হয়েছিল? কেন গত ছ’মাস ধরে গোপনে নোট ছাপানোর কাজ চলছিল তবে? ব্যবসার ক্ষেত্রে, হাসপাতালে, রেল কাউন্টারে বা নয়া টাকা লেনদেনে আম আদমি যে সমস্যায় পড়বে, তার কি কোনও ধারণা ছিল না সরকারের? নিশ্চয়ই ছিল৷ নাহলে, নোট বাতিল ঘোষণার সময়ই মোদি কেন বলবেন, এতে সাধারণ মানুষের ক’দিন অসুবিধা হবে? এতেও কয়েনের উল্টোপিঠের হুঙ্কার থামছে না৷ তাদের দাবি, দেশের অধিকাংশ কালো টাকা তো বিদেশের ব্যাঙ্কেই পড়ে রয়েছে৷ হুমম… অস্বীকার করার উপায় নেই৷ কিন্তু জাল নোট ছাপিয়ে যেভাবে সন্ত্রাস থাবা বসাচ্ছিল, সেই গরম লোহায় কি জোর হাতুড়ির ঘা পড়ল না?
বিখ্যাত জ্যোতিষ নস্ট্রাদামুস নাকি সাড়ে ৪০০ বছর আগে বলে গিয়েছিলেন, ২০১৪ থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত যিনি এই দেশের চালকের আসনে বসবেন, তাঁর হাত ধরেই ভারতে শুরু হবে নয়া স্বর্ণযুগ৷ ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাওয়ার জন্যই নস্ট্রাদামুসের পরিচিতি৷ যদিও এ তথ্যের সত্যতা আলোচনাসাপেক্ষ৷ তবে ‘ইমপসিবল ইজ নাথিং’ বলেও একটি প্রবাদ এ ধরণিতে চালু রয়েছে৷ বল্লভভাই প্যাটেল হোক বা এ পি জে আবদুল কালাম, রাজনীতির বেড়াজালে জড়িয়ে থেকেও দেশের হিতে কাজ করেছেন তাঁরা৷ তার মানে আম আদমি মোদিকে সেই আসনে বসানোর সাহস দেখাচ্ছে? পাগলকে পাগল বললে, সে না হয় খেপে যায়৷ কিন্তু যে পাগল নয়, সে কীভাবে নিজেকে প্রমাণ করবে? দার্শনিক প্লেটো বলেছিলেন, গণতন্ত্র শিক্ষিত মানুষদের জন্য৷ গরিব ও ধনীদের চিন্তাধারা এবং শিক্ষাগত পার্থক্য গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর৷ ১২৫ কোটির গণতান্ত্রিক দেশ আড়াই বছর আগে ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কি না, মোদির কথায় তা ৩০ ডিসেম্বরের পরই স্পষ্ট হয়ে যাবে৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.