ছবি: অমিত ঘোষ
কিংশুক প্রামাণিক: ১৯৮৪ থেকে ২০১১- সাতবার লোকসভার সাংসদ। নরসিমা রাও, অটলবিহারী বাজপেয়ী, মনমোহন সিংয়ের মন্ত্রিসভার সদস্য। দু’বার রেলমন্ত্রী। ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ, নারী ও শিশুকল্যাণ এবং কয়লা মন্ত্রকের দায়িত্ব। পরপর তিনবার নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা নিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রিত্ব।
প্রয়াত রাজীব গান্ধী লড়াকু মনোভাবের জন্য তাঁকে এতটাই নির্ভর করতেন যে, বাংলায় যুব কংগ্রেস সভানেত্রীর পদে আসীন করেন। কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে নতুন দল গঠন করে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান তাঁর নেতৃত্বে। তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসে সেই বাম-কংগ্রেসের আসন শূন্যে নামল তাঁর পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ ভোট একজোট হওয়ায়।
২০১১ সালের পরিবর্তনের পর আন্তর্জাতিক ‘ফোর্বস’ ম্যাগাজিন জনমানসে প্রভাবশালী বিশ্বের এমন ১০০ জন মহিলার নাম প্রকাশ করে। সেই তালিকায় নাম ছিল বাংলার এই মেয়ের। ১৩০ কোটির দেশে কে সেই নারী, যাঁকে দেখতে আমেরিকা থেকে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে এসেছিলেন ‘ফার্স্ট লেডি’ হিলারি ক্লিনটন!
আজও সাধারণ বাড়িতে থাকেন। সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে সামাজিক ক্ষেত্রেও তাঁর সাফল্য ঈর্ষণীয়। প্রান্তিক মানুষের কথা ভেবে অভিনব সব প্রকল্প তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত। জন্ম থেকে মৃত্যু– সবেতেই মানুষের পাশে সরকার। ‘কন্যাশ্রী’, ‘সবুজ সাথী’-র মতো স্কুলছাত্র-ছাত্রীদের জন্য কর্মসূচি বিশ্বে মডেল। রাষ্ট্রসংঘ দিয়েছে সম্মান।
বিরোধী নেত্রী থাকার সময় তাঁর অন্য রূপ। একের পর এক আপসহীন আন্দোলন। বারবার জীবন বিপন্ন। তাঁরই নেতৃত্বে ‘নো আডেনটিটি কার্ড নো ভোট’ আন্দোলনের জেরে দেশে সচিত্র পরিচয়পত্র দেখিয়ে ভোট দেওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে তাঁর জমি আন্দোলন, অনশন, অবস্থানের জন্য দেশের কৃষক সমাজ পায় নিরাপত্তা। ১৮৯৪ সালের একতরফা জমি অধিগ্রহণ আইন পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় ভারত সরকার। কৃষক-খেতমজুর-বর্গাদারদের জমির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বেই ৭০ বছরের ক্ষত, উত্তরবঙ্গের ছিটমহল সমস্যার সমাধান। মাওবাদীদের রুখে জঙ্গলমহলে শান্তি প্রতিষ্ঠা অথবা পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদকে আটকে দেওয়াও কম বড় কাজ নয়!
নারী ক্ষমতায়নের প্রতীক এই মহিলা চেয়ারের প্রত্যাশা করেন না। যে কোনও অন্যায়-অবিচার-বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীক। তিলে তিলে নিজের সাফল্য এমন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন, তাঁকে আজ উপেক্ষা করা অসম্ভব। সুদীর্ঘ বায়োডেটা যাঁর, তাঁর নাম নিশ্চয়ই আর বলার দরকার নেই। তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ভারতীয় রাজনীতিতে এমন বর্ণময় চরিত্র আর একজনও এই মুহূর্তে আছেন কি? বাংলার সফল রাজনীতিবিদ ডা. বিধানচন্দ্র রায়, অজয় মুখোপাধ্যায়, জ্যোতি বসু, প্রণব মুখোপাধ্যায়। যাঁদের সংসদীয় জীবন ছিল প্রকৃত অর্থেই মহাসংগ্রামের। সেই তালিকায় মমতার নামও উঠে এসেছে। যদিও অনেকেই মনে করেন, মমতার কাজটা এঁদের প্রত্যেকের চেয়ে ছিল কঠিন। কারণ, তিনি লড়াই করেছেন একাই, শূন্য থেকে। কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপি-র মতো বিরাট অর্থ ও ক্ষমতাশালী দল ছিল তাঁর বিপক্ষে। কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে প্রবল শক্তিধর সিপিএম-কে হারান। এবার বিজেপির মতো দলকে বাংলায় রুখে দিয়ে নিজের নাম ইতিহাসে লিখেছেন মমতা। স্বভাবতই আজ জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপি-বিরোধী শিবিরে আর কোনও নেতা নেই, যাঁর লড়াই থেকে কাজ- বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর ধারে-কাছে রাখা যায়।
তাহলে কি মমতাই ২০২৪ সালে সম্মিলিত বিরোধী শিবিরের মুখ হয়ে উঠতে পারেন? তিনিই কি হবেন বিরোধীদের প্রধানমন্ত্রী-পদপ্রার্থী?
এখনও লোকসভা ভোট তিন বছর বাকি। কিন্তু বাংলায় দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা নিয়ে হ্যাটট্রিক করার পর মমতাকে ঘিরে এই অমোঘ প্রশ্নটি সামনে এসে গিয়েছে। বিশেষ করে বিজেপি যেভাবে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে তাদের সেরা অস্ত্র প্রধানমন্ত্রীকে বসিয়ে এবার সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিল, তাতে লড়াইটা মমতা—মোদিময় হয়ে ওঠে। নজিরবিহীনভাবে প্রায় ১৫টি জনসভা করেন প্রধানমন্ত্রী। পুরো কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা তিনমাস ঘাঁটি গেড়েও মমতার কোনও ক্ষতি করতে পারেনি। ২১৩ আসন নিয়ে বিজেপির ডবল ইঞ্জিন সরকারের স্বপ্ন চূর্ণ করে দেন তৃণমূল নেত্রী। মোদিকে এত বড় ধাক্কা সাম্প্রতিককালে কেউ দিতে পারেননি। কাজেই লোকসভা ভোটে বিজেপিবিরোধী শিবিরের মুখ হয়ে ওঠার যথার্থ নাম মমতা-ই। তিনি তাঁর যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন।
কিন্তু সবাই মানলেও কংগ্রেস কি মমতাকে মানবে? খুব সংগত প্রশ্ন। কিন্তু দেশের রাজনীতি আজ যে-খাতে প্রবাহিত, তাতে তাঁদের একার দ্বারা যে কিছুই হবে না- সেটা নিশ্চয়ই কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী বুঝছেন। নিজেদের প্রাসঙ্গিক করে তুলতে বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করার কথাই নিশ্চয়ই আগে ভাববেন। সেক্ষেত্রে সব দল মিলে একটি বৃহত্তর মোর্চা গঠন জরুরি। ‘অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি’ তৈরি করে মানুষের সামনে যেতে হবে। আগামী তিন বছর বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা ভোটে এই জোটকে সামনে রেখে নিজেদের ঐক্য তুলে ধরতে হবে। উনিশের খারাপ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে কে বড়, কে ছোট- এই ভাবনা দূরে ঠেলতে হবে।
যদিও জাতীয় স্তরে জোট-রাজনীতির অভিজ্ঞতা ভাল নয়। মানুষ স্থায়ী সরকার চায়। সেক্ষেত্রে জোট জোরদার না হলে বিজেপির লাভ হবে। কিন্তু বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করে এখনই জোট তুলে ধরতে পারলে দেশে ৬৬ শতাংশ বিজেপি-বিরোধী ভোট এক করা অনেকটা সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সেটা করে দেখিয়ে দিয়েছেন। কংগ্রেস বা সিপিএমকে নিশ্চিহ্ন করার বাসনা মানুষের ছিল বলে মনে করি না। কারণ, দুই দলেরই বাংলার রাজনীতিতে স্মরণীয় অবদান রয়েছে। কিন্তু মানুষ দেখল, বিজেপি-বিরোধী ভোট যদি ভাগ হয়, তবে লাভ গেরুয়া শিবিরেরই। তাই সবাই জোড়াফুলে ভোট দিলেন। যারা নীতিগতভাবে তৃণমূলকে পছন্দ করেন না, তাঁরাও দিলেন। লক্ষ্যটা ছিল, ‘নো ভোট টু বিজেপি’। মুখ সব সময় ফ্যাক্টর। বাংলার ভোটে বিজেপির বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ মমতার বিকল্প মুখ তুলে ধরতে না পারা।
বস্তুত ২০২৪ সালে নরেন্দ্র মোদিকে হারাতে হলে বাংলার মানুষের এই সিদ্ধান্তকে উদাহরণ করতে হবে সব বিরোধী দলকে। ইগো ছাড়তে হবে কংগ্রেসকে। মমতাকে এখন সবচেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছে বিজেপি। হোন না তিনি আঞ্চলিক শক্তি। মাত্র ৪২টি আসনে তঁার লড়াই। কিন্তু পরিস্থিতি খানিকটা ১৯৯৬ সালে জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাবের মতোই। তখন কংগ্রেস ও বিজেপি-বিরোধী শিবিরে অনেক নেতাই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য ছিলেন। কিন্তু সর্বজনগ্রাহ্য নেতা ছিলেন একমাত্র বসুই। বামেদের আসন সেবার ছিল ৪৪। সিপিএম ৩৪। তা সত্ত্বেও জ্যোতিবাবুকে নেতা নির্বাচন করেছিল বিরোধী শিবির। দেড়শোর কাছাকাছি আসন নিয়ে এই সোনিয়া গান্ধী সমর্থনে রাজি ছিলেন, বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে। কিন্তু সিপিএম শেষ পর্যন্ত রাজি হয়নি। সে অবশ্য অন্য ইতিহাস।
বিজেপি নিরঙ্কুশ না হলে এবারের পরিস্থিতিও তেমন হতেই পারে। যদি সব বিরোধী দল সমস্ত ছুঁৎমার্গকে দূরে সরিয়ে মোদিকে সরানোর স্বার্থে এক হতে পারে মমতাকে সামনে রেখে, তাহলে এই রাজ্যেও ৪২ আসনে মেয়েকে জেতানোর তাগিদ দেখা দেবেই। তখন হয়তো স্লোগান হতে পারে ‘দিল্লি বাংলার মেয়েকে চায়’। বিজেপিকে প্রধান চ্যালেঞ্জ দেওয়ার দায়িত্ব যাদের ছিল, সেই কংগ্রেস দলের অবস্থা শোচনীয়। পাঁচ রাজ্যের ভোটে তাদের ফল সবচেয়ে খারাপ। বাংলায় বিজেপিকে মমতা রুখে দিলেন। কংগ্রেস কোনও আসন পায়নি। অসমে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এল বিজেপি। কংগ্রেস বাধা হয়ে উঠতে পারল না। দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে পালাবদল পাঁচ বছর পরপর হয়। কিন্তু দেখা গেল কেরলের মানুষ কংগ্রেস নয়, ফের বামেদের উপর আস্থা রাখল। পুদুচেরিতে কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোটকে হারাল এনডিএ।
কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী নিজেকে প্রশাসনিক ক্ষমতা থেকে দূরে রেখেছেন। পুত্র রাহুল গান্ধী পারিবারিক পরিচয়ে আলোকিত। তাঁর বালকসুলভ সময় এখনও না কাটায় কংগ্রেসের মাজা সোজা করা যায়নি। লোকসভা ভোটে এবারও তিন অঙ্কের ধারেকাছে কংগ্রেসের যাওয়ার সম্ভাবনা কেউ দেখছে না। ফলে রাহুলকে মোদির বিরুদ্ধে মুখ করলে গেরুয়া শিবির সবচেয়ে খুশি হবে। কোনও বিরোধী দলও রাহুলকে মানবে বলে মনে হয় না। তদুপরি বিজেপি-বিরোধী ভোট একবাক্সে আনা সম্ভব হলে রাজ্যে-রাজ্যে আঞ্চলিক দলের আসনের যোগফল ম্যাজিক ফিগারের কাছে যেতে পারে। সেই শিবিরে যোগ্যতম মুখ মমতাই। যাঁর হয়তো লড়াই ৪২ আসনে, কিন্তু বাস্তবে তিনিই মোদির প্রধান মাথাব্যথা। একুশের বাংলা ঠিক করে দিয়েছে, চব্বিশের দিল্লির পাটিগণিত।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.