বিশেষ করে সেই সময়ে, যখন পৃথিবীজুড়ে এমনিতেই মন্দা-র হাওয়া। গত সপ্তাহের ‘অর্থনীতিকথা’-য় আমরা মনে করেছিলাম, পৃথিবীজুড়ে খাদ্যাভাব দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আজ বলছি, সেই সঙ্গে মন্দা-র দেখা মেলারও সম্ভাবনা। লিখছেন দীপংকর দাশগুপ্ত
প্রায় তিন বছর হতে চলল, অর্থনৈতিক দুনিয়ার স্বাস্থ্যোন্নতির কোনও লক্ষণ নেই। একটা সমস্যার সমাধান হতে-না-হতেই অন্য সমস্যা এসে উপস্থিত। তাই গত একমাস ধরে যে-সমস্ত কথাবার্তা বলেছিলাম, এখনও হয়তো তারই কিছু পুনরাবৃত্তি করতে হবে। উপায় নেই, কারণ পৃথিবী জুড়েই দুর্ভাবনা বেড়ে চলেছে। আমরা ঠিক কোনদিকে এগচ্ছি, সেটা নিশ্চিতভাবে জানা না-থাকলেও, সন্দেহ রয়েছে প্রায় সকলেরই মনে।
ঠিক এই মুহূর্তে যে-ঘটনাটা নিয়ে টানাপোড়েন চলেছে, তা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যবৃদ্ধির হার। গত মাসে সেখানে মূল্যবৃদ্ধির হার উঠতে উঠতে গিয়ে ঠেকেছে ৮.৬ শতাংশে। ১৫ জুন ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সভাপতি জেরোম পাওয়েল বলেছেন, মূল্যবৃদ্ধি রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সুদের হার ০.৫ শতাংশের বদলে ০.৭৫ বাড়ানো হয়েছে। ১৯৯৪ সালের পর এটি তৃতীয়বার সুদ-বৃদ্ধির সংবাদ। শুধু তা-ই নয়, বৃহত্তমও বটে। পাওয়েল সাহেব যখন বলেছিলেন সুদের হার বাড়তে চলেছে, তখনই বাজারে আশঙ্কা জেগেছিল যে, বৃদ্ধি আরও বেশি হবে। এবং হলও তাই। ০.৫-এর পরিবর্তে ০.৭৫ শতাংশ। ইতিপূর্বে সরকারি ঋণপত্রের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী হতে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু জেরোম পাওয়েলের ঘোষণার ফলে ব্যাপারটা গিয়েছে উলটে। অর্থাৎ, সরকারি ঋণপত্রের মূল্য এখন নিম্নগামী।
এর কারণটা একটু বুঝে নেওয়া যাক। ধরা যাক, একটি সরকারি ঋণপত্রের মূল্য ১০০ ডলার, আর সেই ঋণপত্র থেকে বার্ষিক আয় ১.৫ ডলার। তাহলে সুদের হারও হল ১.৫ শতাংশ। সুদের হার ১.৫ থেকে বাড়ানোর রাস্তাটা কী? যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ঋণপত্র কিনতে শুরু করে, তবে জোগানের তুলনায় চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে ১০০ টাকার ঋণপত্রের মূল্য ১০০ ডলার থেকে বেড়ে হয়তো ১১০ ডলার হয়ে যাবে। কিন্তু ওই ঋণপত্রই তো বছরে প্রতিদান দেয় ১.৫ ডলার। এখন ১১০ ডলার থেকে ১.৫ ডলার প্রতিদান পাওয়ার অর্থ হল সুদের হার কমে ১.৩৬ শতাংশ হয়ে গেল। আর এই গল্পটা উলটে দিয়ে, যদি আমরা মনে করি যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণপত্র কেনার পরিবর্তে বিক্রি করতে শুরু করল, তাহলে ঋণপত্রের জোগান চাহিদার তুলনায় বেড়ে গিয়ে তার দাম যাবে কমে। আর, ওই কম মূল্যের ঋণপত্রের উপর ১.৫ ডলার প্রতিদানের অর্থ হবে সুদের হার বেড়ে গেল। কাজেই হিসাবটা সহজ। ঋণপত্রের মূল্য ও তার উপর সুদের হার বিপরীত দিকে চলে।
সঙ্গে আরও একটা ঘটনা ঘটতে থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক যদি বাজারে সরকারি ঋণপত্র বেচতে থাকে, তবে একই সঙ্গে বাজারে অর্থের জোগান কমে যায়। কারণ, যে কোনও পণ্যের মতোই বিক্রেতা টাকা আদায় করে ক্রেতার কাছে। সরকারি ঋণপত্রর ক্ষেত্রে বিক্রেতা তো কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকই আবার অর্থের জোগানও দিয়ে থাকে। তাই কোনও-না-কোনও উপায়ে নিজেরই তৈরি করা অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে তুলে নিচ্ছে। আর এই কাজটা যে হচ্ছে, তার সংকেত হল সুদের হারে বৃদ্ধি। বলাই বাহুল্য, এই সুদের হার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিও বাড়াতে থাকবে। (ভারতে এই কাজটা করা হয় রেপো রেটের ওঠা-নামা দিয়ে।) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে আর্থিক বাজারে টানাটানি হতে থাকলে শেয়ার বাজারেও তার প্রতিফলন দেখা যায়।
সরকারি-বেসরকারি সমস্ত রকমের ঋণপত্র অথবা শেয়ারের মূল্যই নেমে যাবে। নগদ প্রতিদানের আকর্ষণ কমে যায় মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কায়। ভবিষ্যৎ নিয়ে এই দুর্ভাবনার ফলে অনেকেই শেয়ার বাজারে তাঁদের শেয়ার বেচে দেবেন। এই মুহূর্তের খবর অনুযায়ী, আমেরিকায় জানুয়ারির তুলনায় শেয়ারের দাম কমেছে ২০ শতাংশ। অর্থাৎ, যাঁরা সেই সমস্ত শেয়ারের মালিক, তাঁদের সম্পত্তির মূল্যে আঘাত পড়ছে। এই একই সঙ্গে ব্যাংকজাতীয় সংস্থাগুলি সুদের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে, কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই সেই কাজ করছে। ফলে যাঁরা ঋণ নিয়ে বাজারে ক্রয় করেন, তাঁরা এবার একটু সাবধানে চলবেন। অন্যপক্ষে যাঁদের
সম্পত্তি ক্ষয় হচ্ছে, তাঁদেরও বাজারে উপস্থিতি কমতে থাকবে।
ফলে অর্থনীতির নীতি-নির্ধারকরা যা-ই বলুন না কেন, এই সুদের হার বাড়ানোর সঙ্গে পরস্পরবিরোধী যোগাযোগ আছে অপর এক অর্থনৈতিক ব্যাধির। সেই ব্যাধিটা কী, বুঝতে হলে আমাদের বহু আলোচিত কাহিনিতে ফিরে যেতে হবে। ঋণের উপর সুদের হার বাড়লে বাজারে চাহিদা কমবে বহু পণ্যেরই। এই পরিস্থিতিকে আমরা কী অভিধা দিয়ে থাকি? মন্দা। অর্থাৎ, সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যবৃদ্ধির ফলে অপর এক অর্থনৈতিক দানবের হাজির হওয়ার পথ সুগম হয়ে যায়। তাত্ত্বিক অর্থনীতির দুনিয়ায় অবশ্য মূল্যবৃদ্ধি ও মন্দার সম্পর্ক নিয়ে বহু তর্ক আছে। আপাতত সেই বিতর্কে না গিয়ে, একটু অতিসরলীকরণের রাস্তায় চলাই ভাল। যদি মন্দার উপস্থিতি অল্প কিছুদিনের জন্য হয়, তবে ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারণ নেই। কিন্তু কতদিনের জন্য- সে বিষয়ে কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে? বিশেষ করে কোভিডের মন্দার হাত থেকে তো আমরা এখনও পুরোপুরি মুক্তি পাইনি।
আমরা নয়ের দশক থেকে বিশ্বায়নের দোলনায় চড়ে হাওয়া খাচ্ছিলাম। ভালই ছিলাম, কিন্তু ২০০৮ সালে অকস্মাৎ হাজির হল সাব-প্রাইম মন্দা। সেই মন্দা থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম ঠিকই, কেবল এখন আবার এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হল। বিশ্বায়নের যুগে মার্কিন দেশে সুদের হার বাড়লে পৃথিবীর শেয়ার বাজার থেকে ডলার ছোটে মার্কিন মুলুকে। তার ফলে বাকি পৃথিবীর শেয়ার বাজারেও অল্পবিস্তর ধস নামতে বাধ্য। উপরন্তু অন্যান্য দেশের মুদ্রা, ইয়েন, ইউরো, ভারতীয় টাকা প্রভৃতি সব মুদ্রারই ডলারের তুলনায় অবমূল্যায়ন হতে শুরু করে। এদিকে জাপান, ভারত, চিন, ইউরোপ সর্বত্রই তেলের প্রয়োজন। সেই তেলের মূল্য নির্ধারিত হয় ডলারে। অবমূল্যায়নের জন্য তাদের জরুরি সব আমদানি- বিশেষ করে তেলের ও খাদ্যের, মূল্যবৃদ্ধি হতে বাধ্য। একদিকে পুতিনের কল্যাণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের ডলার মূল্য বাড়ছে, অন্যদিকে ডলারের নিজের মূল্যও অবমূল্যায়নের ফলে বেড়ে চলেছে। সর্বত্রই আমদানি করতে নাভিশ্বাস উঠছে। আবার সকলেই মূল্যবৃদ্ধি কমানোর জন্য সেই একই কৌশল অবলম্বন করতে উদ্যত। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের আদেশে সুদবৃদ্ধি। কাজেই সর্বত্রই আমরা এখন সুদ-বৃদ্ধির খেলা দেখতে থাকব। অর্থাৎ পৃথিবীজুড়েই।
এদিকে আমরা এক্ষুনি আলোচনা করলাম যে, সুদ-বৃদ্ধির অপর নাম ‘মন্দা’, বিশেষ করে সেই সময়ে যখন পৃথিবীজুড়ে এমনিতেই মন্দা-র হাওয়া। এর আগের পক্ষের ‘অর্থনীতিকথা’-য় আমরা মনে করেছিলাম, পৃথিবীজুড়ে খাদ্যাভাব দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আজ বলছি, সেই সঙ্গে মন্দা-র দেখা মেলারও সম্ভাবনা। আর, এই সম্ভাবনা কেবল একটি কোনও দেশে নয়। আমেরিকার মূল্যবৃদ্ধি সমগ্র পৃথিবীতেই ছড়াবে। এই মন্দা-র তেজও নিদারুণ, কারণ পৃথিবী বর্তমানে একটি বিশ্বায়িত অর্থনীতি। বিশ্বায়নের ফলে কোভিডের মতো মূল্যবৃদ্ধিও ছোঁয়াচে রোগ। তবে কি এবার বিশ্বায়নে অবিশ্বাসের বিষাক্ত ছায়া পড়বে?
হবেও বা!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.