আইএসএল ভারতীয় ফুটবলের কোন উন্নতি করছে না৷ দুম করে এমন মন্তব্য করে দেওয়াও তো ঠিক নয়৷ এর পক্ষেও যুক্তি প্রয়োজন৷ সেই যুক্তিতেই আলোকপাত করলেন সুলয়া সিংহ৷
ফোরলান কোন দলের হয়ে খেলবে রে?
কলকাতা তো পেল না, বোধহয় মুম্বইয়ে সই করছে৷ কার্লোস রবের্তো কি এবার থাকছে?
না রে৷ এবার আর চোখের সামনে থেকে সেই দুরন্ত ফ্রি-কিক দেখা হবে না৷
উক্ত কথোপকথনে বেশ পরিষ্কার, এই ফুটবলপ্রেমীরা আই লিগ, আইএসএল-এর বাইরে আন্তর্জাতিক ফুটবল দেখতেও অভ্যস্ত৷ বরং বলা যেতে পারে, দেশের মাটিতে আইএসএল-এ কোন কোন বিদেশি ফুটবলার খেলবেন, তা নিয়ে এরা বেশি মাথা ঘামায়৷ কিন্তু আইএসএল তো তৈরি হয়েছিল ভারতীয় ফুটবলের উন্নতির স্বার্থে৷ ঘুমন্ত সিংহকে জাগিয়ে তোলার শপথ নিয়ে৷ তাহলে?
প্রতিবছর চড়া মেক-আপে মুখ সাদা করে, ঠোঁটে বাজারি লিপস্টিক লাগিয়ে একঝাঁক তারকা বেষ্টিত হয়ে বছরের তিনটি মাস গ্যালারিতে উপস্থিত হন এই কোটি টাকা টুর্নামেন্টের মালকিন৷ আর বলেন, দেশের ফুটবলের উন্নতি হবে, হ্যান করেঙ্গে, ত্যান করেঙ্গে৷ অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর ঘুরে যেই জানুয়ারি পড়ে, অমনি ধীরে ধীরে টিভি-র পর্দা থেকে সেই চেহারাগুলি উধাও হয়ে যায়৷ আর মেক-আপহীন ভারতীয় ফুটবলের কঙ্কালসার চেহারাটা একইরকম থেকে যায়৷
এভাবে ব্যাখ্যা দিলে আইএসএল প্রেমীরা আবার রাগ করতে পারেন৷ হাজার হোক, গাঁটের কড়ি খরচ করে ‘কিউট’ বরুণ, ‘হট’ জনকে মাঠে দেখতে যান তাঁরা৷ পরিসংখ্যান তো বলেই দিয়েছে, ভারতে আইএসএল শুরুর আগে এত মহিলা ফুটবল ভক্তকে মাঠে দেখা যেত না৷ কী করে যাবে? আই লিগ, ফেডারেশন কাপে তো কেউ “কাম অন ইন্ডিয়া, লেটস ফুটবল” বলে উৎসাহ দেয় না৷ তাই উৎসাহ জন্মও নেয় না৷ এখানেও তর্ক বন্ধ করতে রাজি নয় সুপার লিগ ভক্তরা৷ টিআরপি-র বিচারে প্রথম সংস্করণেই বিশ্বের সেরা চার জনপ্রিয় লিগের তালিকায় ঢুকে পড়েছিল আইএসএল৷ ও হ্যাঁ, তাই তো! তা দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সংস্করণে তালিকার ঠিক কত নম্বর স্থানে রয়েছে এই টুর্নামেন্ট? খবর নিয়েছেন?
আইএসএল ভারতীয় ফুটবলের কোন উন্নতি করছে না৷ দুম করে এমন মন্তব্য করে দেওয়াও তো ঠিক নয়৷ এর পক্ষেও যুক্তি প্রয়োজন৷ ভাবতে খারাপ লাগে, এর পক্ষে দু-একটা নয়, বেশ কয়েকটা যুক্তি সাধারণ মানুষও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারবে৷ আইএসএল-এর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হল এর মেয়াদ৷ ভারতীয় ক্লাব চার্চিল ব্রাদার্সের মালিক এই টুর্নামেন্টের সমালোচনা করে বলেছিলেন, আইএসএল-কে কোনওভাবেই ‘লিগ’ বলা চলে না৷ কারণ একটি টুর্নামেন্ট অন্তত ছ’মাস চললে তার গায়ে ‘লিগ’-এর তকমা চাপে৷ এর দ্বিতীয় ব্যর্থতা, আইএসএল-এর নিজস্ব কোনও মাঠ নেই৷ ইংল্যান্ড, স্প্যানিশ, ইতালীয় ক্লাবের মতো এ দেশের দলগুলির মান তৈরির কথাবার্তা হবে৷ অথচ দলের নিজস্ব কোনও মাঠই থাকবে না৷ এটাও সম্ভব? দেশের স্থায়ী ক্লাব, সরকারের সঙ্গে ঝগড়া-ঝাটি করে যে মাঠ জুটল, তাতেই অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে ফুটবলারদের৷ আর বলা হবে, “দেখ বাবা, আই লিগের থেকে কিন্তু আইএসএল-এর মান অনেক উন্নত৷ খেয়াল রেখো৷” বিদেশি ক্লাবগুলোর নিজস্ব মাঠ, ক্লিনিক, জিম, সুইমিং পুল কি তাহলে লোক দেখাতে থাকে?
এই যে প্রতিবার আইএসএল শুরুর আগে কলকাতা দলের ম্যানেজার কলার তুলে বলেন, “আমাদের টিম স্পেন থেকে প্রি-সিজন ট্রেনিং করে এল৷” শুনে মনে হয়, এই এক মাসের ট্রেনিংয়েই বুঝি ভারতীয় ফুটবলের সাফল্য লুকিয়ে বসে ছিল৷ আচ্ছা বলতে পারেন, বার্সেলোনা, রিয়াল, চেলসি, লেস্টারের মতো জুনিয়র ও সিনিয়র দলগুলো কেন আমেরিকা, জাপানে গিয়ে প্রি-সিজন প্রীতি ম্যাচ খেলে? এমনি এমনি? ওদের ক্লাবে অর্থ বেশি রয়েছে, তাই? না৷ উন্নতি পরিকাঠামোর জন্য৷ ভারতের অবশ্য ওসবের প্রয়োজন নেই৷ দু-তিন মাস বিশ্বমানের কোচ আর ঝাঁ-চকচকে একটা টুর্নামেন্ট পেলেই ফুটবলের উন্নতি রোখে সাধ্যি কার!
টিভি-র পর্দায় কচি-কাচারা সুপার লিগ দেখবে আর ফুটবল পায়ে লাফিয়ে মাঠে নেমে পড়বে৷ যুবপ্রজন্মকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করবে আইএসএল-এর ফর্সা সুন্দর রূপ৷ এমনটাই তো আশা করা হয়৷ বাহ্, বেশ ভাল কথা৷ আশা পূর্ণ হল৷ ফুটবলেও অর্থ রয়েছে, এই ভেবে তরুণরা আগ্রহ দেখাতে শুরু করল৷ কিন্তু তারপর? ফুটবলারদের জন্য উন্নত পরিকাঠামো, উপযুক্ত মাঠ, পর্যাপ্ত কোচিং, প্রীতি ম্যাচ, এসবের ব্যবস্থা থাকবে তো? স্পেনের জুনিয়ররা যেভাবে এবং যতক্ষণ ট্রেনিং করেন, এ দেশের সুনীল ছেত্রীরা তা এখনও ভাবতে পারেন না৷ সেসবের জন্য তৈরি তো ‘লেটস ফুটবল’ স্লোগানের কর্ত্রী? কে জানে৷ পুজোর মরশুমে যেমন ক’দিনের জন্য দেবীর আগমন ঘটে, তিনিও তেমন তিন মাসের ফুটবল মরশুমে আবির্ভূত হন৷ সবাইকে ফুটবল খেলতে বলেন, এবং বিদায় নেন৷ সারা বছর কী হল না হল, এত মাথা ঘামানোর সময় কোথায় তাঁর? মাস তিনেক পর তো আবার সবাইকে ক্রিকেট খেলতেও উৎসাহিত করার দায়িত্ব থাকে তাঁর৷ আর এই কাজে তাঁর যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, সেদিকে সদা সতর্ক দেশের ফুটবল কর্তারা৷ আইএসএল চলাকালীন ১৮-র যুবক হয়ে ওঠেন তাঁরা৷ আর বাকি সময়? ওই কোনও ক্লাব নিয়ম ভাঙলে খবরের শিরোনামে আসেন৷ আই লিগ আর আইএসএল-কে জুড়ে দিয়ে তাঁরা ঠিক কোন পথে এগোতে চাইছেন, তা আলোচনাসাপেক্ষ৷ কারণ ‘প্যায়সা ফেক, তামাশা দেখ’ প্রবাদে আজও বলি হচ্ছে সেই ভারতীয় ফুটবলই৷ আইএসএল আসে, আইএসএল যায়, ভারতের বুকে জন্ম নেওয়া কোনও নতুন তারকার নাম উঠে আসে না৷ এভাবে চলতে থাকলে এ দেশ যে বিশ্বকাপের ছায়াও মাড়াতে পারবে না, তা বলার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন হয় না৷
তিনমাস ধরে বিদেশি তারকারা দেশের মাটিতে টাকা কুড়োবেন৷ আর সেই ঘুমন্ত সিংহ মুচকি হেসে বলবে, “ওরে, আমায় খোঁচা মেরে বিরক্ত করিস না৷”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.