২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি যখন প্রধানমন্ত্রী হলেন, তখন দেশে ঋণের বোঝা ছিল ৫৫ লক্ষ কোটি টাকা। ২০২২ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১৫৫ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ৯ বছরে মোদি সরকার ঋণ করেছে ১০০ লক্ষ কোটি টাকা। মোদি সরকারের আমলে বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগও ব্যাপকভাবে কমছে। কলমে সুতীর্থ চক্রবর্তী
নরেন্দ্র মোদি সরকারের আমলে গত এক দশকে ভারতের অর্থনীতির মূল দুর্বলতার জায়গা হল লগ্নির অভাব। বেসরকারি ক্ষেত্রে যেমন লগ্নি নেই, তেমনই ব্যাপকভাবে ধাক্কা খাচ্ছে বিদেশি লগ্নিও। সরকারি তথ্য থেকেই জানা যাচ্ছে, গত একবছরে দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ১৬ শতাংশের বেশি কমেছে। লগ্নি যে দেশে হচ্ছে না, সেটা আপাতদৃষ্টিতেই আমরা সাধারণ মানুষ উপলব্ধি করি। লগ্নি হলে দেশে কল-কারখানা তৈরি হত, চাকরিবাকরির সুযোগ ঘটত। কিন্তু সেসব কিছুই হচ্ছে না। গত এক দশকে দেশে বলার মতো একটাও কলকারখানা তৈরি হয়নি। চাকরির সুযোগ তলানিতে পৌঁছেছে। সরকারি ও বেসরকারি তথে্যই দেখা যায়, বেকারত্ব তার শীর্ষবিন্দুতে গিয়ে পৌঁছেছে।
গত কয়েক দিন ধরে অর্থনীতি সংক্রান্ত কিছু সরকারি তথ্য ঘিরে হইচই চলছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য তথ্য হল দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন তথা জিডিপি বৃদ্ধির হার। এই বৃদ্ধির হার সদ্য শেষ হওয়া ২০২২-’২৩ অর্থবর্ষে ৭.২ শতাংশ হয়েছে। গত বছরের চেয়ে সেটা কম। কিন্তু যেহেতু ‘হায়ার বেস’-এর উপর ভিত্তি করে এই বৃদ্ধির হার, তাই এই হার নিয়ে খুশি দেশের আর্থিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
গত এক বছরে মূল্যবৃদ্ধির সমস্যাটাও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। মে মাসের খুচরো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে যে-তথ্য মিলেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে গত ২৫ মাসের মধ্যে মূল্যবৃদ্ধি সর্বনিম্ন বিন্দুতে গিয়েছে। কয়েক দিন আগেই রিজার্ভ ব্যাংকের দ্বিমাসিক আর্থিক নীতি কমিটির বৈঠক শেষ হয়েছে। সেই বৈঠক থেকে এবারও রেপো রেটে কোনও পরিবর্তন করা হয়নি। রেপো রেট হল সুদের সেই হার, যে-হারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলি রিজার্ভ ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা ধার নেয়। রেপো রেট বৃদ্ধি না হওয়া মানেই ব্যাংকের ঋণে সুদ বাড়বে না। এতে সাধারণ মানুষের স্বস্তি। কারণ, বাড়ি-গাড়ির ইএমআই এখনই বাড়ছে না। ইদানীং, আমরা দেখতে পাই রিজার্ভ ব্যাংক রেপো রেট বাড়ালে সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকগুলি ইএমআই বাড়িয়ে দেয়।
ইএমআই বৃদ্ধি না পাওয়ার স্বস্তি থাকলেও অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক যে-ছবি আমাদের সামনে হাজির করছে, তা মোটেও স্বস্তিদায়ক নয় সাধারণ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে। মোদি সরকার যে অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে এখনও কোনও সাফল্য দেখাতে পারছে না, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এসব সূচক ও তথ্যে। গত এক বছরে উৎপাদন ক্ষেত্রে বৃদ্ধি ঘটেছে মাত্র ১.৩ শতাংশ। উৎপাদন ক্ষেত্রে বৃদ্ধি না-ঘটার কারণই হল বেসরকারি ক্ষেত্রে লগ্নি কমে যাওয়া এবং দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়া। উৎপাদন ক্ষেত্রে বৃদ্ধি না-ঘটলে যে কর্মসংস্থান বাড়ানো সম্ভব নয়, তা বোঝার জন্য অর্থনীতিতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। চাকরি না-থাকা সবসময় আঘাত করে মধ্যবিত্তের জীবনকে।
মোদি সরকারের আমলে একদিকে যেমন বেসরকারি ও বিদেশি লগ্নির অভাব তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে এই সময় বেড়েছে সরকারে ঋণের পরিমাণ। কয়েক দিন আগে, বর্তমান বছরে সরকারের আর্থিক ঘাটতির যে-তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ২০২২-’২৩-এ ফিসক্যাল ডেফিসিট গিয়ে পৌঁছেছে জিডিপির ৬.৪ শতাংশে। ’২০-’২১-এ কোভিডের বছরে ফিসক্যাল ডেফিসিট পৌঁছেছিল ৯.২ শতাংশে। সে-সময় সরকারি খরচ কয়েক গুণ বেড়েছিল।
দেশে এই ফিসক্যাল ডেফিসিট বরাবর ৩ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে ঘোরাঘুরি করত। ২০১৪ সালে, নরেন্দ্র মোদি যে-বছর ক্ষমতায় এলেন, সেই বছরে ফিসক্যাল ডেফিসিট ছিল ৪.৫ শতাংশ। মোদির প্রথম পঁাচ বছরে ফিসক্যাল ডেফিসিট নতুন করে বাড়েনি। কিন্তু ২০১৯ থেকেই ফিসক্যাল ডেফিসিট বাড়তে থাকে। কোভিডের সময় তা রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছয়। তারপরেও কমার হার দেখা যাচ্ছে না।
মোদি সম্প্রতি খয়রাতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। মোদির আমলের ফিসক্যাল ডেফিসিটের বহর দেখিয়ে কংগ্রেসের অভিযোগ, মোদি সরকার লগ্নি না-আনতে পেরে ঋণ করে খয়রাতির মাধ্যমে অর্থনীতিকে বাঁচানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। তথ্য দিয়ে কংগ্রেসের আরও অভিযোগ, মোদির আমলে দেশে ঋণের বোঝা তিন গুণ হয়েছে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি যখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন দেশে ঋণের বোঝা ছিল ৫৫ লক্ষ কোটি টাকা। ২০২২ সালে সেটা বেড়ে হয়েছে ১৫৫ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ, মোদির ৯ বছরে সরকার ঋণ করেছে ১০০ লক্ষ কোটি টাকা। ভারতের ঋণ জিডিপির ৮৪ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছে। কংগ্রেসের তরফে তথ্য দিয়ে আরও দাবি করা হচ্ছে, মোদি সরকার প্রতি সেকেন্ডে ৪ লক্ষ টাকা করে ঋণ করেছে। প্রতিদিন ঋণ করেছে ৩,৪৫৬ কোটি টাকা। গত কয়েক দিনে সংবাদমাধ্যমে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের তরফে এই তথ্যকে খণ্ডন করে পাল্টা এখনও কিছু বলা হয়নি।
সম্প্রতি দেশবাসীর ভোগব্যয় সংক্রান্ত কিছু তথ্যও প্রকাশ পেয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে ২০২২-’২৩ অর্থবর্ষে দেশে ভোগব্যয় বৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২.৮ শতাংশ। যা মোটেও আর্থিক বৃদ্ধির হারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আবার এটাও ঘটনা যে, দেশের হোটেল ও পরিবহণ শিল্পে গত এক বছরে আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। হালে কোনও দামি ট্রেনে টিকিট পাওয়া যায় না। বিমানের টিকিটের দাম প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বড় শহর ও পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে হোটেলের ঘর পাওয়া দুষ্কর। চার চাকার গাড়ি বিক্রিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থাৎ, বড়লোকদের ভোগব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব ও সাধারণ মানুষের ভোগব্যয় কমছে। এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হল, দুই চাকার যান বিক্রি কমে যাওয়া। তার মানে, অর্থনীতির যেটুকু ভাল হচ্ছে, তা মূলত বড়লোকদের। সাধারণ মানুষের অবস্থা রোজ আরও খারাপের দিকেই যাচ্ছে।
লগ্নি বাড়ানোর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা কী, সেটা এখন বড় প্রশ্ন। কোনও সংস্কারমূলক পদক্ষেপ লক্ষ করা যাচ্ছে না। শিল্প বৃদ্ধির দিকে না গিয়ে কি খয়রাতির মাধ্যমে শুধু ভোটে জেতার লক্ষ্যেই মোদি সরকার পরিচালিত হচ্ছে? দেশের অর্থনীতির যেটুকু যা উন্নতি তার পুরোটাই বড়লোকদের। আগামী এক বছরের মধ্যে লোকসভা ভোট। লোকসভা ভোটের আগে গরিব ও সাধারণ মানুষের জন্য মোদি সরকারের কী বার্তা হবে, জল্পনা এখন তা নিয়েই।
(মতামত নিজস্ব)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.