কিংশুক প্রামাণিক: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফরমুলা উপেক্ষা করলে বিরোধী জোট সফল হবে না। গোবলয়ে তিন রাজ্যে কংগ্রেসের ভরাডুবির পর এ কথা আবার স্পষ্ট।
এই নির্বাচনে কংগ্রেসের ক্ষেত্রে ‘ভরাডুবি’ কথাটিই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে, কারণ বিজেপি যতই লাফালাফি করুক, আদতে বিরোধী ভোটের বিভাজনের অনেকটাই সুযোগ তারা পেয়েছে। মমতার মতে, গোবলয়ের রাজ্যে অন্তত ৭০টি এমন বিধানসভা আসন আছে যেগুলি বিজেপিকে উপহার দেওয়া হয়েছে। আসন সমঝোতা ঠিকঠাক হলে হয়তো পাশার দান অন্যরকম হত। একই সঙ্গে তৃণমূলনেত্রী আশা প্রকাশ করেছেন, ভুল থেকেই শিক্ষা নিতে হবে। তাহলেই ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে বিরোধীরা ভাল ফল করবে।
তিনি যে এই বার্তা কংগ্রেসকে (Congress) দিতে চেয়েছেন, তা পরিষ্কার। তাঁর ফরমুলা মেনে যদি কংগ্রেস এগত, তাহলে এতটা বিপর্যয় কি হত? সহজ ক’টি কথা প্রথম দিন থেকে বলে আসছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। এক, দেশজুড়ে যতদূর সম্ভব আসনে ‘একের বিরুদ্ধে এক’ প্রার্থী দিতে হবে। দুই, যে যেখানে শক্তিশালী তাকেই লড়াইয়ের দায়িত্ব দিতে হবে। তিন, ন্যূনতম কর্মসূচি সামনে রেখে মানুষের কাছে যেতে হবে। চার, নেতা নির্বাচন করবে জনগণ। ভোটের আগে নয়, পরে ঠিক হবে কুর্সিতে বসবেন কে।
সমস্যা হল, হেরে ভূত হয়ে গেলেও কংগ্রেসের জমিদারি মানসিকতা এখনও যায়নি। পাটনায় যখন ‘ইন্ডিয়া’ জোটের প্রথম বৈঠকটি হয়, তখন রাহুল গান্ধী খুব দামি একটি কথা বলেছিলেন, ‘আমি অতীত মনে রেখে এখানে আসিনি।’
তাঁর এই শান্ত, সংযত কথা শুনে মনে হয়েছিল কংগ্রেস বোধহয় নমনীয় হয়েছে। বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়েছে। কিন্তু কর্নাটকে ঝড়ের গতিতে বিজেপিকে (BJP) হারিয়ে দেওয়ার পর কংগ্রেসের কি মনে হয়েছিল, জোটের দরকার নেই? বিজেপিকে একাই রুখে দিতে পারবে তারা?
না হলে যা নিয়ে এত হইচই সেই ‘ইন্ডিয়া’-কে পাঁচ রাজ্যে খুঁজে-ই পাওয়া গেল না কেন? কই, মমতার কাছে তো প্রস্তাব এল না, আপনি রাজস্থানে প্রচারে আসুুন। তৃণমূ্ল নেতাদের বলা হল না, মধ্যপ্রদেশের বাঙালি এলাকায় প্রচার করুন। জোটের সব নেতাকে নিয়ে একটি করে বড় র্যালি হোক ভোপাল-জয়পুর, রায়পুর-হায়দরাবাদে।
চারটি রাজ্যেই বিজেপির বিরুদ্ধে তারা-ই প্রধান প্রতিপক্ষ বলে কি অন্যদের পাত্তা দিতে চায়নি কংগ্রেস? তারা কি দেখাতে চেয়েছিল কংগ্রেসই জোটের সব?
এই সমস্যা কংগ্রেসের চিরকালীন। এই করে-করে কয়েকটি রাজ্যে দলটি সাইনবোর্ডে পরিণত হয়েছে। তাদের জানা নেই বিশাল সাগরের বুকে সেতুবন্ধনে একটি কাঠবেড়ালিরও ভূমিকা থাকে। তাজমহল একা কেউ তৈরি করতে পারেনি। যুগে-যুগে শত-শত মানুষের পরিশ্রমে তা গড়ে উঠেছিল।
জোট এমন এক পাঁচফোড়নের মতো মশলা যাতে পারস্পরিক সহযোগিতা দরকার। তবেই সুগন্ধ ছড়াবে। জোটে একাধিক দল থাকবে, কখনওই সবার শক্তি সমান হবে না। তবু সেই মঞ্চে কেউ ছোট, কেউ বড়। সেই সূত্রে যার যেমন শক্তি তেমনই তার অংশীদারিত্ব থাকবে। কিন্তু সম্মান সবার সমান।
আমাদের রাজ্যে বামফ্রন্ট জোট টিকেছিল খানিকটা এমন থিওরিতেই। শরিকি সংঘাত মাঠে-ময়দানে তীব্র ছিল। কিন্তু মজা হল, ভোট এলে সব বাম ভোট এক হয়ে যেত। তারাও ন্যূনতম কর্মসূচি নিয়ে এগিয়েছিল। সরকারে আসার পর দফতর বণ্টনে শক্তি অনুয়ায়ী শরিকদের দায়িত্ব দিয়েছিল সিপিএম।
‘ইন্ডিয়া’ জোটে অবশ্য এতটা আশা করা যায় না। বামপন্থীদের এক ছাতার তলায় আসা, আর আসমুদ্র হিমাচলের বিচিত্র মত ও পথের দলকে একত্র করা এক বিষয় নয়। নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে বাম দলগুলির কোনও ভিন্নমত ছিল না। কিন্তু এই জোটে তেমন পরিস্থিতিই নেই। তৃণমূল কংগ্রেস আর ডিএমকে দুই আঞ্চলিক দল হলেও দুই দলের মেরু আলাদা। আবার অখিলেশ যাদব, লালুপ্রসাদ, নীতীশ কুমারদের রাজনীতির সঙ্গে মেলে না কাশ্মীরে ফারুক আবদুল্লাদের অবস্থান। কংগ্রেসের বাংলার সিপিএমের সঙ্গে আসন রফা, অথচ কেরলে সেয়ানে সেয়ানে লড়াই। এরপর রয়েছে শরদ পাওয়ার মতো ‘মোস্ট আনপ্রেডিকটেব্ল ক্যারেক্টর’, যিনি কখন কোন দিকে চলে যাবেন, কেউ জানে না! এমন সাড়ে বত্রিশভাজার পটভূমিতে সব বিরোধী দলের এক ছাতার তলায় আসা এক কথায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু প্রাণের তাগিদে হয়ে গেল ‘ইন্ডিয়া’ জোট।
উল্টোদিকটি যদি বিচার করা যায় তাহলে আবার গলা মেলাতে হবে অতুলপ্রসাদের সুরে, ‘নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান,/ বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’। এরই নাম তো ভারত, ইন্ডিয়া। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে এত জাত-ধর্ম-বর্ণ মিলেমিশে যদি ‘জনগণমন অধিনায়ক’ গাইতে পারি, তাহলে রাজনৈতিক মিলনে অসুবিধা কোথায়? সেই সূত্রেই ‘ইন্ডিয়া’ জোট ডালপালা মেলেছে। এতটাই যে দিল্লির শাসকের কাছে ‘ইন্ডিয়া’ নামটি পর্যন্ত হয়ে পড়েছে চক্ষুশূল।
চার রাজ্যের ফল যদি বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে একটি চিরাচরিত রীতিই চোখে পড়বে। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ছবি উঠে আসবে। মনে রাখতে হবে, সব রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ নয়। আমাদের রাজ্যের মানুষ স্থিতাবস্থার পক্ষে। একটা জেনারেশন দীর্ঘকাল ধরে একটি দলকেই ভোট দিয়ে যায়। যেন খানিকটা অভ্যাস। সহজে সেই মতের যেমন পরিবর্তন হয় না, তেমন নতুন ভোটারও অন্যদিকে হাঁটে। স্বাধীনতার পর প্রায় দু’-দশক বাংলায় ছিল কংগ্রেস শাসন।
ফলে, বাংলার সমীকরণ অন্য রাজ্যে খাটে না। চার রাজ্যে কিন্তু তিন সরকারের পতন হয়েছে। অর্থাৎ, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা বড় হয়ে উঠেছিল রাজস্থান, ছত্তিশগড়, তেলেঙ্গানায়। তাই সরকার পড়ে গিয়েছে। রাজস্থানে দীর্ঘকাল ধরে পাঁচ বছর পর পর সরকার বদল হয়। এবারও হয়েছে। মরুদেশে গেরুয়া ঝড় যারা দেখছে, তাদের জেনে রাখা দরকার, ২০২৮ সালে আবার সেখানে কংগ্রেস ফিরবে। ছত্তিশগড়েও গতবার বিজেপি সরকার হেরে কংগ্রেস এসেছিল। এবার আবার বিজেপি জিতল। তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য দু’বার মুখ্যমন্ত্রিত্ব ভোগ করার পর কে. চন্দ্রশেখর রাও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। টিআরএস রাতারাতি হয়ে যায় বিআরএস। তিনিও হেরে গেলেন প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়ায়। এমনকী, মিজোরামেও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা থেকেই নতুন একটি দল ক্ষমতায় চলে এল। মণিপুরের হামলার বদলা খ্রিস্টানরা নিল বিজেপি ও তাদের সঙ্গে চলা স্থানীয় দলকে হারিয়ে।
একমাত্র অন্য ছবি মধ্যপ্রদেশে। বোঝা যাচ্ছে, উত্তরপ্রদেশের হাওয়া মধ্যপ্রদেশের গায়েও। হিন্দুত্বেই মেরুকরণ। তা-ও শিবরাজ সিং চৌহান যেভাবে মমতার লক্ষ্মীর ভাণ্ডারকে নকল করে প্রকল্প ঘোষণা করেছেন, তাতে মহিলারা সমর্থন দিয়েছেন। না হলে ব্যবধান এতটা হয় না।
এই খণ্ডচিত্রগুলিই আসলে পাঁচ রাজ্যের আসল ছবি। বিজেপি যদি মনে করে সেমিফাইনাল জিতে ফাইনালও জিতে গিয়েছে, তাহলে ভুল হবে। গতবার এই রাজ্যগুলি গোবলয়ে হেরেও দিল্লিতে তারা ক্ষমতায় এসেছিল। তার মানে এই ফল দিয়ে লোকসভার বিচার হবে না।
একদিক দিয়ে ভাল-ই হল ‘ইন্ডিয়া’-র। জোটের ভাল এবং খারাপ দু’টি দিক-ই উন্মোচিত হল। এই হার ভবিষ্যতে তাদের জিততে একজোট করবে।
মমতার ফরমুলা ছাড়া গতি নেই, রাহুল গান্ধী নিশ্চয়ই বুঝবেন। অতএব, ‘একের বিরুদ্ধে এক’-ই ‘ইন্ডিয়া’-র একমাত্র লক্ষ্য। বিরোধী ভোট ছত্রখান হলে মোদিকে গোদি থেকে সরানো যাবে না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.