উত্তরপ্রদেশ-সহ বাকি পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফল একটি ন্যায্য প্রশ্ন রাখল, গান্ধীরা নেতৃত্ব ছাড়লেও কংগ্রেসের ভাঙা মাজা সোজা হবে কি? ইতিহাসবিদ-রাজনীতিজ্ঞ রামচন্দ্র গুহ মনে করেন, গান্ধীরা নেতৃত্ব ছাড়লে ভোল বদলাবে না। তাঁরা রাজনীতি থেকে অবসর নিন। তাতে কংগ্রেস বাঁচলেও বাঁচতে পারে। আগামী বছরের প্রধান আকর্ষণ তাই ‘কংগ্রেস’ নামক হারাধনের শেষ দুই সন্তান রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ের বাঁচা-মরা। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের ফল বেরনোর সন্ধ্যায় দিল্লিতে শাসক দলের সদর দপ্তরে প্রধানমন্ত্রীর হাঁটাচলা ভাল করে লক্ষ করে থাকলে নিশ্চয়ই দেখেছেন, তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে আত্মবিশ্বাস কীভাবে ঝরে পড়ছিল। এক-একটা পা মেপে মেপে হাঁটছিলেন, মনে হচ্ছিল এ যাবৎ যাবতীয় বিরোধী সমালোচনা, ভোট-পণ্ডিতদের পূর্বাভাস, নিন্দুকদের তাচ্ছিল্য পায়ে দলে এগিয়ে চলেছেন। প্রতিটি পদক্ষেপ যেন প্রশ্নাতীত ও তর্কাতীতভাবে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের নির্ঘোষ। হবেই তো! যেভাবে সব জল্পনা নস্যাৎ করে পাটিগণিত ভুলিয়ে ব্যক্তিগত রসায়ন মহিমান্বিত করলেন তা বিস্ময়কর! ভারতের সংসদীয় রাজনীতিতে শাসকের এমন দীর্ঘমেয়াদি দাপট ইদানীং কদাচিৎ দৃশ্যমান।
সেই মঞ্চ থেকে আগাম এক ঘোষণাও প্রধানমন্ত্রী শুনিয়ে রেখেছেন। বলেছেন, পণ্ডিতিভাষ্যে উত্তরপ্রদেশে ২০১৭ সালের প্রভাত যেমন ২০১৯-এর সুদিনের বার্তাবাহক হয়েছিল, তেমনই ২০২২-এর রায়ও দু’-বছর পরের সাধারণ নির্বাচনের ভাগ্যলিপি হয়ে থাকছে। বাদ বাকি যা কিছু হবে নিছকই আনুষ্ঠানিকতা।
এই বীরত্বের বিপ্রতীপে কোনও প্রতিরোধ আদৌ গড়ে উঠতে পারে কি না ভেবে চলেছি। প্রশান্ত কিশোর অবশ্য ‘সাহেব’-কে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ভারত দখলের যুদ্ধ নির্ধারিত হবে ২০২৪ সালে এবং সেই যুদ্ধের ফল কোনও রাজ্যের ভোটে নির্ধারিত হবে না। প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত এই ভোটকুশলীর মতে, লোকসভা ভোটের আগে এমন মন্তব্য বিরোধীদের মনস্তাত্ত্বিক চাপে ফেলার ধূর্ত চেষ্টা ব্যতীত অন্য কিছু নয়। তাঁর ব্যাখ্যায়, লোকসভার ভোটে অন্য খেলা হবে। হতেই পারে। লোকসভার ভোট এখনও দু’বছর পর। রাজনীতিতে বছর তো দূরের কথা, ঘটনাপ্রবাহ ভিন্ন খাতে বইলে পক্ষকালের মধ্যে হাওয়া উলটো দিকে ঘুরে যেতে পারে। হাতেগরম উদাহরণ আন্না হাজারের দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলন। পা কেঁপে গিয়েছিল মনমোহন সরকারের। কাজেই দু’-বছর পর রাজনীতির আকাশে কোন রং ছাইবে সেই ভবিষ্যদ্বাণী না-করে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্কিম কটাক্ষ- শিশুর জন্মই হল না অথচ অন্নপ্রাশনের তোড়জোড় চলছে! কোথায় বিনয়ী হবেন, তা না অহংকারী ও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছেন! এসব পতনের লক্ষণ!
প্রকৃত বিজয়ী মহানুভবতা ও ঔদার্যের প্রতীক হন। আধুনিক ভারতের রাজনীতি বহুদিন সেই পথচলা ভুলে গিয়েছে। এখন নতুন সংস্কৃতি। এতদ্সত্ত্বেও বলা যায়, এবারের ভোট প্রমাণ করল আট বছর রাজত্বের পরেও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব ফলদায়ী। তাঁর উপর সাধারণ মানুষ এখনও আস্থা হারাননি। হয়তো জৌলুস কমেছে। ভরসা ও বিশ্বাসেও কিছুটা টাল খেয়েছে। জনমনে অভিযোগও জমেছে বিস্তর। কিন্তু যাবতীয় অপ্রাপ্তিবোধ নাগরিক সমাজে ততটা ক্ষোভ সঞ্চার করেনি যার উদ্গিরণে শাসক বানভাসি হয়। সেই ক্ষোভের প্রকাশ আমরা ২০১১-তে পশ্চিমবঙ্গে দেখেছি, কেন্দ্রীয় পর্যায়ে ১৯৭৭ সালে দেখেছি, ২০১৪-এও। কিন্তু ২০২২-এ নয়। ২০২৪-এ ক্ষোভের ভিসুভিয়াসের আবির্ভাব ঘটবে কি না পরের কথা। রাজনীতির অনেক পণ্ডিতকেই আপাতত দেখছি আশান্বিত হতে ভয় পাচ্ছেন। কুণ্ঠায় ভুগছেন। মান্যিগন্যি ভোট-পণ্ডিতদের আত্মবিশ্বাসে এই ধাক্কা এবারের ভোটের অন্যতম বাস্তবতা।
বেশ কিছু গুরুতর ভাবনার অবকাশও এই ভোট করে দিল। যেমন, প্রতিস্পর্ধী হিসাবে বিরোধীরা এখনও অন্ধকার হাতড়ে চলেছে। কোনও রাজ্যেই তারা এমন কোনও শক্তপোক্ত দেওয়াল খাড়া করতে পারেনি যেখানে মাথা কুটে শাসক রক্তাক্ত হয়। এখান থেকেই জন্ম দ্বিতীয় সত্যের, যা কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ ঘিরে ঘূর্ণায়মাণ। গান্ধী পরিবারের পক্ষে কংগ্রেসকে (Congress) কিঞ্চিদধিক দেওয়াও আগামীতে আর সম্ভব কি- এটা যেমন বড় প্রশ্ন; তেমনই গুরুত্বপূর্ণ, গান্ধীরা নেতৃত্ব ছাড়লেও কংগ্রেসের ভাঙা মাজা কখনও সোজা হবে কি না। ইতিহাসবিদ রাজনীতিজ্ঞ রামচন্দ্র গুহ মনে করেন, গান্ধীরা নেতৃত্ব ছাড়লে ভোল বদলাবে না। তাঁরা রাজনীতি থেকে অবসর নিন। তাতে কংগ্রেস বাঁচলেও বাঁচতে পারে। রামচন্দ্রর যুক্তি, গান্ধীরাই বিজেপির সেরা হাতিয়ার। কারণ, যে যে বিষয়ে তাঁরা সরকারের সমালোচনা করেন একটাও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না তাঁদের পূর্বসুরিদের কৃতকর্মের দরুন। তা সে স্বৈরাচার হোক, দুর্নীতি হোক, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো দুর্বল করার অভিযোগ হোক, বহুত্ববাদিতার বিসর্জন হোক অথবা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল করা, প্রতিটিতেই তাঁদের পূর্বজদের ছাপ স্পষ্ট।
কিন্তু গান্ধী-অধীন কংগ্রেস ও পরিবারের স্তাবককুল যে গতানুগতিকতার বাইরে বেরবে না ভোট-পরবর্তী ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকই তার প্রমাণ। ’২৪-এর ভোটের আগে আগামী বছরের প্রধান আকর্ষণ তাই ‘কংগ্রেস’ নামক হারাধনের শেষ দুই সন্তান রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ের মরা-বাঁচার প্রশ্ন। পাঞ্জাবের নাটক যেভাবে মঞ্চস্থ হল তাতে অতি বড় কংগ্রেসিও আর ভরসায় বুক বাঁধার সাহস পাচ্ছে না। মোদিও পণ করেছেন, কংগ্রেস দেউড়ির শেষ দু’টি বাতিও নিভিয়ে দেবেন। জয়ের হ্যাটট্রিকের আগে এটাই তাঁর শেষ অভীপ্সা।
গত বছর থেকে ভোট-আকাশে উজ্জ্বলতর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। এবারের ভোট সন্দেহাতীতভাবে আরও দুই নক্ষত্রের জন্ম দিল- অরবিন্দ কেজরিওয়াল (৫৪) ও যোগী আদিত্যনাথ (৪৯)। দু’জনেই অতি উচ্চাশী। দু’জনের রয়েছে অন্তত দু’-আড়াই দশকের রাজনৈতিক জীবন। মোদি-উত্তর বিজেপিতে যোগীর সম্ভাব্য অবস্থান এখন থেকেই চর্চায় উঠে এসেছে। এসেছে, যেহেতু মোদি-শাহকে অমান্য করে স্ব-শক্তিতে ভর দিয়ে যোগী শুধু টিকেই থাকেননি, দলকে জয়ীও করেছেন। নিজের তৈরি নিয়ম মেনে ২০২৯ সালে মোদি ‘সন্ন্যাস’ নিলে সংঘ-প্রশ্রয়ে উত্তরাধিকারের দাবিদার গেরুয়াধারী হতেই পারেন। উত্তরপ্রদেশের ওজন সবসময়ই আলাদা।
অতটা ওজনদার কেজরিওয়াল এখনও হননি। ‘আপ’-এর পাঞ্জাব জয় অবশ্যই কৃতিত্বের। তবু জাতীয় রাজনীতির নিরিখে তা ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে জয়ের মুখ থেকে হার ছিনিয়ে কৃষ্ণগহ্বরে নিমজ্জিত হওয়ার অত্যাশ্চর্য কংগ্রেসীয় উপাখ্যান। এক বছর আগেও যে-রাজ্যজয় কংগ্রেসের কাছে ছিল জলভাত, একের পর এক ভুল ও অপসিদ্ধান্ত কীভাবে তা কঠিন করে তুলতে পারে, পাঞ্জাবে কংগ্রেস সেই দৃষ্টান্ত রেখে গেল। এমন কালিদাসচিত আচরণের দ্বিতীয় নিদর্শন রাজনীতিতে সম্ভবত নেই!
কিন্তু তাই বলে আপের সাফল্য ছোট করে দেখা অনুচিত হবে। তারা একমাত্র দল যারা বিজেপিকে পরপর দু’বার দিল্লিতে হারিয়েছে। কংগ্রেসকে খাতা পর্যন্ত খুলতে দেয়নি। কিন্তু তবুও রাজনৈতিক দল হিসাবে আপ সেভাবে কল্কে পায়নি। এর প্রধান কারণ- দিল্লির পরিধি, তার রাজনৈতিক চরিত্র এবং বিপুল কেন্দ্রীয় বদান্যতা। রাজধানী-রাজ্য দিল্লি পূর্ণ রাজ্য না-হওয়ায় সরকারের কাজের পরিধি জল, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, সাফাই ও স্বাস্থ্যের বাইরে বিস্তার লাভ করেনি। এই প্রথম তারা এক বড় ও পূর্ণাঙ্গ রাজ্যে তখ্তাসীন যা সমস্যাসংকুল এবং ঋণগ্রস্ত। ২ লাখ ৮২ কোটি টাকার ঋণের বোঝা নিয়ে ভগবন্ত মান মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন। জনমুখী নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করে অর্থনীতির সামাল দেওয়া তাঁর চ্যালেঞ্জ।
কংগ্রেসের ব্যর্থতা ও আপের সাফল্য বিরোধী রাজনীতিকে কোন দিশা দেয় তা দেখার। শাখাপ্রশাখা বিস্তারে সেই রাজ্যগুলোয় আপ নজর দিচ্ছে যেখানে বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেস। যেমন হিমাচলপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, গোয়া, হরিয়ানা, গুজরাট, তেলেঙ্গানা। পশ্চিমবঙ্গেও তারা আড়মোড়া ভাঙা শুরু করেছে। পাঞ্জাব জয়ের পর বিজয় সমাবেশে কেজরিওয়াল দিল্লি ও পাঞ্জাবের মতো গোটা দেশে ‘ইনকিলাব’ সফল করার হাঁক দিয়েছেন। কংগ্রেস তাতে আরও দুর্বল হলে আপ-এর সাফল্য কিছুকাল বিজেপিকে অবশ্যই উৎসাহিত করবে। কিন্তু তারপর? উচ্চাশী কেজরিওয়ালের স্বপ্ন বিজেপি-বিরোধী মুখ হওয়া। সেই লক্ষ্যে এগনোর ব্লু প্রিন্টও তৈরি। দীর্ঘদিনের মিত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে অতঃপর কেজরিওয়ালের রাজনৈতিক রসায়নের ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি কেমন হয় তা-ও হয়ে উঠবে আগামীর অন্যতম আকর্ষণ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.