‘হিন্দুত্ব’ কিংবা ‘উগ্র জাতীয়তাবাদ’কে সামনে রেখে ভোট আকর্ষণ করা যাচ্ছে না, বুঝেছেন সংঘের নেতারা। ভোট-বিপর্যয়ের কারণ যে মূল্যবৃদ্ধি, সম্ভবত প্রথমবার স্বীকার করলেন মোদি-শাহরা। ভোটমুখী রাজ্যের বিজেপি সরকারগুলি পেট্রল-ডিজেলে ভ্যাট কিছুটা কমিয়েছে। এতদিন পর এই সামান্য তৎপরতা কি কাজে দেবে? লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী
পেট্রল, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি যে ভোটে বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে, তা সম্ভবত এই প্রথমবার মেনে নিলেন নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা। রাজনীতির যে-শাস্ত্র মেনে তাঁরা এতদিন চলে এসেছেন তাতে মূল্যবৃদ্ধির জন্য পৃথক কোনও অধ্যায় ছিল বলে মনে হয় না। ভোটে পরপর ধাক্কা খেয়েও এতদিন তাঁরা মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টিতে উদাসীনই থেকেছেন। কিন্তু, ভারতে যে এখনও ‘মূল্যবৃদ্ধি’ই ভোটে সবচেয়ে বড় ইস্যু- তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।
হিমাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে জয়রাম ঠাকুরের চলে যাওয়া এখন নাকি স্রেফ সময়ের অপেক্ষা! তাঁর অবস্থা বিজয় রুপানি বা বিএস ইয়েদুরাপ্পার মতো হতে চলেছে কি না, সেটা হয়তো অল্প কয়েক দিনে বোঝা যাবে। কিন্তু উপনির্বাচনে হিমাচল প্রদেশের ধাক্কায় মোদি-শাহরা এইটুকু বুঝেছেন যে, আগামী বছর যদি এই পাহাড়ি রাজ্যটায় ক্ষমতা ধরে রাখতে হয়, তাহলে অবিলম্বে পেট্রল-ডিজেলের দাম কমানো ছাড়া বিকল্প কোনও রাস্তা নেই। তবে শুধু পাহাড়ি রাজ্য কেন, আগামী দু’বছরে তো ১০টি রাজ্যে বিধানসভা ভোট। এই ১০ রাজ্যের অধিকাংশই ‘এনডিএ’-র দখলে। হিমাচল প্রদেশে বিজেপির বিরুদ্ধে যে হাওয়া উঠেছে, তা কি উত্তরাখণ্ডে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব? মনে হয় না। এই দুই পাশাপাশি রাজ্য চরিত্রের দিক থেকে একইরকম। দুই পাহাড়ি রাজ্যের অর্থনীতিতেও বিপুল সাদৃশ্য। হিমাচল প্রদেশে ভোটে হারার একমাত্র ও প্রধান কারণ যে মূল্যবৃদ্ধি, তা নিয়ে কোনও সংশয় কোনও স্তরে নেই। রাজ্যের একটি লোকসভা ও তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে পর্যুদস্ত হওয়ার পরই জয়রাম ঠাকুর ঘোষণা করে দিয়েছেন, মূল্যবৃদ্ধির কারণেই তাঁকে হারতে হয়েছে। হিমাচলে উপনির্বাচনে এবার ইস্যুই ছিল অর্থনীতি। পেট্রল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি, নিত্যপ্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়া এবং সর্বোপরি আপেল চাষিদের দূরবস্থাই ছিল হিমাচলে উপনির্বাচনে ইস্যু।
হিমাচলের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গের উপনির্বাচনে বিজেপির ধাক্কা আরও বেশি। বস্তুত, রাজ্যে বিজেপির ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। হিন্দুত্বের রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে কোনও দিনই দাগ কাটতে পারেনি। কখনও কখনও বিশেষ কোনও ইস্যুর ভিত্তিতে বিজেপির দিকে হাওয়া উঠেছে। সেই হাওয়া ফের মিলিয়ে যেতেও সময় নেয়নি। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের কর্মীরা দশকের পর দশক সচেষ্ট থেকেও এ রাজ্যে কখনওই তাদের সংগঠনের বিস্তার ঘটাতে পারেনি। সে কারণে তৈলাক্ত বাঁশে ওঠার মতোই বিজেপি বারবার এ রাজ্যে কিছুটা উঠে আবার আগের জায়গায় নেমে গিয়েছে। সেই প্রবণতাই আবার শুরু হয়েছে কি না, এই প্রশ্ন উঠেছে রাজ্যের সাম্প্রতিক উপনির্বাচনের ফল দেখার পর। এই উপনির্বাচনে তৃণমূল ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ থেকে শুরু করে তাদের বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পগুলি ও উন্নয়নমূলক কাজকর্মের পাশাপাশি পেট্রল-ডিজেলের দাম ও তজ্জনিত মূল্যবৃদ্ধিকেও ইস্যু করেছিল। ভোটের ফলে যে সেসবের প্রতিফলন ঘটেছে, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। ছ’মাস আগের বিজেপির ৩৮ শতাংশ ভোট কেন ১৪.৫ শতাংশে নেমে গেল, তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়তো আরও হবে। কিন্তু কে বলতে পারে যে, বিজেপি ১৪.৫ শতাংশ থেকে ভবিষ্যতে আরও নেমে যাবে না? ডিসেম্বরেই রাজ্যে পুরভোট। সেই পুরভোটে ফের আরও একবার বোঝা যাবে কী হারে বিজেপির ভোটের ক্ষয় হচ্ছে।
আসলে রাজনীতিতে যখনই অর্থনৈতিক ইস্যু প্রাধান্য পাচ্ছে, তখনই ধাক্কা খাচ্ছে বিজেপি। হিমাচল প্রদেশেও যে এটাই ঘটেছে, স্বীকার করছেন সে রাজ্যের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম ঠাকুরও। শুধু ‘হিন্দুত্ব’ দিয়ে আর কতটুকু এগনো যায়? হরিয়ানায় উপনির্বাচনে একটি মাত্র আসনে বিজেপির পরাজয় হয়েছে। এই পরাজয় যে কৃষি আইনের কারণে, সে ব্যাপারে সবাই নিঃসংশয়। বিজেপির উদ্বেগজনক ফল হয়েছে কর্ণাটক ও রাজস্থানের উপনির্বাচনেও। কর্নাটকে বিজেপি প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতাকে দূর করতে কয়েক দিন আগেই মুখ্যমন্ত্রীর পদে বদল ঘটিয়েছে। ভি এস ইয়েদুরাপ্পার জায়গায় এসেছেন স্বচ্ছ ভাবমূর্তির বাসবরাজ বোম্মাই। সেই বোম্মাইয়ের জেলায় উপনির্বাচনে কংগ্রেসের কাছে বিজেপির হার হয়েছে। তাঁর নিজের জেলার হাঙ্গল কেন্দ্রে কী করে কংগ্রেস জিতল, তা ময়নাতদন্ত করে দেখা উচিত- মন্তব্য করেছেন খোদ বোম্মাই। রাজস্থানে ক্ষমতায় কংগ্রেস। অতীতে এই মরুরাজ্যে উপনির্বাচনে দেখা গিয়েছে শাসক দলের বিরুদ্ধে ভোট হয়। কিন্তু, এবারই ব্যতিক্রম। হইহই করে জিতেছেন মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলটের প্রার্থীরা। বিজেপির ভোট শতাংশ ভয়ংকর রকম কমে গিয়েছে।
একই ঘটনা মধ্যপ্রদেশেও। সেখানে বিজেপির সরকার। উপনির্বাচনে বিধানসভার একটি আসন কংগ্রেসের কাছে বিজেপির হাতছাড়া হয়েছে। কিন্তু ভোট শতাংশ কমেছে। মধ্যপ্রদেশে খান্ডোয়ার লোকসভা আসনে উপনির্বাচন ছিল। কিশোর কুমারের জন্মভিটেতে বিজেপি জিতলেও ভোটের ব্যবধান কমেছে অবিশ্বাস্য হারে। হিমাচল প্রদেশে জয়রাম ঠাকুরের নিজস্ব এলাকায় লোকসভা কেন্দ্র মান্ডিতে বিজেপির পরাজয় হয়েছে। গুজরাট—বেষ্টিত দাদরার লোকসভা কেন্দ্রটি উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা দখল করেছে। সেই অর্থে মধ্যপ্রদেশে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান সম্মান রক্ষা করেছেন। কিন্তু, বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে এই রাজ্যে ভোটের পার্থক্য মাত্র ২ শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
উপনির্বাচনের সামগ্রিক ফলাফল নরেন্দ্র মোদির পক্ষে আরও ভয়াবহ হতে পারত, যদি না অসমে হিমন্ত বিশ্বশর্মা বা মেঘালয় কনরাড সাংমারা কিছুটা ইজ্জত না বাঁচাতেন। প্রশ্ন হল, উত্তর-পূর্ব ভারত দিয়ে ২০২৪-এ মোদির কতটা সম্মান বাঁচবে? উপনির্বাচনের ফল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জাতীয় স্তরে আরও শক্তিশালী নেত্রী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। উদ্ধব ঠাকরে, নীতীশ কুমার, হিমন্ত বিশ্বশর্মারা নিজেদের কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। কিন্তু কোথায় দাঁড়াবেন মোদি-শাহরা? সেই কারণে এই প্রথম মোদি-শাহরা মানলেন মূল্যবৃদ্ধি, দেশের আর্থিক দুর্দশা ইত্যাদি ভোটের কারণ হতে পারে। শুধুমাত্র ‘হিন্দুত্ব’ বা ‘উগ্র জাতীয়তাবাদ’কে ইস্যু বানিয়ে যে ভোট আকর্ষণ করা যাচ্ছে না, তা হয়তো বুঝতে পারছেন সংঘ নেতারাও।
পেট্রল-ডিজেলের উৎপাদন শুল্ক কমানো হল তিন বছর বাদে। গত তিন বছর ধরে কেন্দ্র লাগাতার উৎপাদন শুল্ক বাড়িয়ে গিয়েছে। এই সময়কালে কর্পোরেট ট্যাক্সে বিরাট ছাড় দেওয়া হলেও, উৎপাদন শুল্ক কখনও কমেনি। উৎপাদন শুল্ক থেকে প্রতি লিটার পেট্রলে কেন্দ্রীয় সরকার আয় করছিল ৩২ টাকা ৯০ পয়সা। প্রতি লিটার ডিজেলে এই আয় ছিল ৩১ টাকা ৮০ পয়সা। এক বছরে শুধুমাত্র পেট্রল ও ডিজেলের উপর থেকে উৎপাদন শুল্ক বাবদ কেন্দ্রের আয় ৪ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। ফলে অন্য খাতে কর কমে যাওয়া মধ্যেই আনছিলেন না মোদি-শাহরা। অথচ, পেট্রল-ডিজেলের এই করের বোঝা যে সাধারণ মানুষকেই বইতে হয়, তা নিয়ে সংশয় নেই। উৎপাদন শুল্ক বিপুল বাড়িয়ে এখন সামান্য ছাড় দেওয়া হচ্ছে। ভোটমুখী রাজ্যের বিজেপি সরকারগুলি পেট্রল-ডিজেলে ভ্যাট কিছুটা কমিয়েছে। এখন প্রশ্ন, এতদিন বাদে এসে আর্থিক ফ্রন্টে মোদি-শাহদের এই সামান্য তৎপরতা আদৌ কি কোনও ফল দেবে?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.