রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আবার ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ তৈরি করতে চাইছেন। ‘মডেল’ হল: সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে তৈরি হওয়া এই স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোয় একটা প্রাক্তন কমিউনিস্ট দল খুলে শাসনভার দখল করা, তাঁবেদার রাষ্ট্রপ্রধান তৈরি করা, তাঁর উদ্দেশ্য। আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে ইউক্রেন ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছিল, ন্যাটো-র সদস্য হতে চাইছিল, যা পুতিনের না-পসন্দ।
সুমন ভট্টাচার্য: চুম্বক এক, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন (Joe Biden) বলেছেন, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আবার ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ তৈরি করতে চাইছেন।
চুম্বক দুই, রাশিয়া যখন ইউক্রেন আক্রমণ শুরু করছে, ঠিক তার আগের রাতে মস্কোয় গিয়ে উপনীত হন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। অর্থাৎ, চিন এবং পাকিস্তান এতদিন যে-‘অক্ষ’ তৈরির চেষ্টা করছিল, সেই অক্ষে বেজিংয়ের সঙ্গে হাত মেলাল মস্কো।
চুম্বক তিন, এটা কি ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’-র শুরু? বলা মুশকিল। তবে নিশ্চিতভাবে ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’-র নবায়ন। মস্কোয় কমিউনিস্ট শাসনের অবসান এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর থেকে আমরা যে ‘ইউনিপোলার ওয়ার্ল্ড’ বা আমেরিকা-কেন্দ্রিক বিশ্ব রাজনীতি দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম, পুতিন সেটা ভেঙে দিলেন।
চুম্বক চার, মস্কোর এই আগ্রাসনকে, হ্যাঁ ‘আগ্রাসন’ শব্দটাই যথার্থ, বামপন্থীদের পক্ষেও সমর্থন করা মুশকিল। আফগানিস্তানে রুশ ট্যাঙ্কের অনুপ্রবেশকে যাঁরা প্রগতিশীলতার সপক্ষে অস্ত্র ধরা বলে সওয়াল করতেন, তাঁদের পক্ষেও ২০২২-এ এসে পুতিনের ‘জোর যার মুলুক তার’ নীতি সমর্থন করা সম্ভব নয়।
চুম্বক পাঁচ, ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে এবং কালের অমোঘ স্রোতে ওয়াশিংটন বনাম মস্কোর এই লড়াইয়ে দিল্লির পক্ষে রুশ নীতিকে সমর্থন করা সম্ভব নয়। ভারতে যে সরকারই থাকুক, বিজেপি কিংবা অ-বিজেপি, তাদের রুশ আগ্রাসনের থেকে দূরে থাকতে হবে। তা না হলে স্বাধীন ভারতের গণতন্ত্রের চর্চা বৃথা হয়ে যাবে। ‘ফ্রি ওয়ার্ল্ড’ বা ‘মুক্ত পৃথিবী’-র বাইরে ভারতকে চলে যেতে হবে।
চুম্বক ছয়, আমেরিকা এবং রাশিয়ার এই টানাপোড়েনে অর্থনীতি ধাক্কা খাবে, তেলের দাম বাড়বে। আর, তেলের দাম বাড়লে তার আঁচ পড়বে ভারতের বাজারে। এমনিতেই মূল্যবৃদ্ধি, তার দরুন মানুষের ক্ষোভ কেন্দ্রের মোদি সরকারের কাছে যথেষ্ট মাথাব্যথার কারণ। মূল্যবৃদ্ধি কতটা রাজনৈতিক ক্ষতি করছে, সেটা হয়তো পাঁচ রাজ্যের ভোটের ফলাফলই বলে দেবে। এর পরে আরও মূল্যবৃদ্ধি ভারতে যে কোনও কেন্দ্রীয় সরকার এবং শাসক দলের জন্য চাপ তৈরি করে দেবে।
রাশিয়ার ইউক্রেন (Russia-Ukraine War) আক্রমণের পরে প্রাথমিকভাবে যে বিষয়গুলি সামনে আসছে, সেগুলিকে পরপর সাজালে এইরকম কয়েকটি চুম্বক তৈরি হবে। যে ছ’টি চুম্বকের কথা লেখা হল, সেই ছ’টি চুম্বক নিয়েই হয়তো আগামীতে গবেষণাপত্র তৈরি হবে, বা বই লেখা হবে। কিন্তু ঠিক যখন থেকে এই বিষয়গুলি একেবারে আমাদের চোখের সামনে এল, তখনকারও একটা অভিঘাত থাকে। যাকে বলে, সাম্প্রতিকের ধাক্কা। সেই ‘ইনস্ট্যান্ট রিঅ্যাকশন’ বা অভিঘাত না বুঝলে, বা বিশ্লেষণ না-করলে সময় আসলে হাতের থেকে পিছলে যায়।
জো বাইডেনের মন্তব্যটাকেই ধরা যাক। ওই কথাটিই সমগ্র এই সংকটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্য। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আবার সোভিয়েত ইউনিয়ন তৈরি করতে চাইছেন, এটা আসলে কোনও মার্কিনি অভিযোগ নয়, বর্তমান রুশ নেতৃত্বের মননকে অনুধাবন করা। পুতিন নিজে বহুবার বলেছেন, তাঁর অনুগত তাত্ত্বিকরা লিখেওছেন যে, গত শতকের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়া। তাহলে সেই ‘ঐতিহাসিক ভুল’ সংশোধন করতে পুতিন যে ব্রতী হবেন, এতে অবাক হওয়ার কী-ই বা আছে?
গত শতকের নয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরে রাশিয়া-সহ ১৫টি রাষ্ট্র, বিশ্বের মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। সেই মানচিত্র বদলে দিয়ে আবার পুতিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন কীভাবে তৈরি হবে? রুশ দেশনায়ক একটা ‘মডেল’ ভেবেছেন, মধ্য এশিয়ার সাবেক সোভিয়েত অঙ্গরাজ্যে তিনি তা গত দু’দশক ধরে সাফল্যের সঙ্গে চালাচ্ছেনও।ইউরোপের বেলারুশেও এই মডেলের ‘টেস্ট রান’ হয়ে গেল। এবার ইউক্রেনকে ওই মডেলের ধাঁচে ঢেলে নিতে চান। মডেলটা কী?
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে তৈরি হওয়া এই স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোয় কোনও প্রাক্তন কমিউনিস্ট একটা দল খুলে শাসনভার দখল করে নেবেন। তারপরে সেই দল এবং প্রয়োজন পড়লে সেই নেতার পরিবার যুগ যুগ ধরে দেশ শাসন করে যাবে। নির্বাচন ‘নাম কে ওয়াস্তে’। আখেরে ওই শাসক দলই ৯০ শতাংশ বা তারও বেশি ভোট পেয়ে জিতবে। যদি কোথাও গণতন্ত্রের দাবিতে বা শাসকের দুর্নীতি, স্বজনপোষণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়, তাহলে পুতিন রুশ সেনাবাহিনী পাঠিয়ে সব ঠান্ডা করে দেবেন। মধ্য এশিয়ায় কাজাকস্তান বা বেলারুশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ দেখলেই পুতিনের এই ‘হীরক রাজার দেশে’-র মডেলকে বোঝা যাবে। এই হীরক রাজার দেশের মডেলে রুশ রাষ্ট্রপতির হঠাৎ ইউক্রেনকে উদয়ন পণ্ডিত মনে হল কেন? আর, ইউক্রেনকে শায়েস্তা করতে তিনি এত বদ্ধপরিকর কেন?
এর কারণ, ২০১৪ সালে ইউক্রেনে জনবিক্ষোভের পরে সেখানে মস্কোপন্থী সরকারের পতন হয় এবং নির্বাচনের পরে নতুন সরকার তৈরি হয়। এটা আশ্চর্য সমাপতন যে, ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি, যাঁকে সরাতে মস্কো বদ্ধপরিকর, তিনি আসলে আগে একজন কমেডিয়ান ছিলেন এবং ছিলেন তীক্ষ্ণ শ্লেষে সমাজ, রাজনীতিকে বিঁধতে অভ্যস্ত। জেলেনস্কি-র আমলে ইউক্রেন যে আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছিল, ন্যাটো-র সদস্য হওয়ার চেষ্টা করছিল, সেটা পুতিনের একেবারে না-পসন্দ। পুতিনের এই নয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন মডেলের অনেকগুলো সুবিধা আছে। প্রাক্তন কেজিবি অফিসার আদতে স্তালিনের শাসনকেই ফিরিয়ে আনতে চান, আদর্শগত হ্যাংওভার ছাড়াই।সেজন্য দুনিয়ার নানা প্রান্তে কমিউনিজমের আদর্শে বুঁদ হয়ে থাকারা এবং ভারতের বামপন্থীরাও একটু বিপাকে, ইউক্রেনে বোমা আর মিসাইলের শব্দকে তাঁরা ‘বিপ্লবের বজ্রনির্ঘোষ’ বলতে পারছেন না।
কিন্তু দেশে-দেশে, মানে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে তৈরি হওয়া বিভিন্ন দেশে, যাঁরা পুতিনের অনুগত হয়ে ক্ষমতায় বসছেন, তাঁদেরও শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থ দেখার বা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা চালানোর নৈতিক দায়িত্ব নেই। তাই নির্দ্বিধায় এই শাসকরা পুত্র কিংবা জামাইদের খনির বরাত, তেলের কোম্পানির মালিকানা দিয়ে যাচ্ছেন। কমিউনিস্ট শাসনে দলীয় আমলাতন্ত্রকে ব্যবহার করে স্বজনপোষণ বা দুর্নীতি করতে যেটুকু আড়ালের প্রয়োজন হত, পুতিনের সোভিয়েত মডেলে তাঁবেদার রাষ্ট্রে
ক্ষমতায় বসতে পারলে আদর্শগত মুখোশ ছাড়াই সব করা যায়।
এই পর্যন্ত যদি আমরা অনুধাবন করতে পারি, তাহলে বুঝতে অসুবিধা হবে না যে, পুতিনের গণতন্ত্র বা দেশ চালানোর মডেলের সঙ্গে একেবারে যুগলবন্দি হতে পারে কমিউনিস্ট-শাসিত চিন– নির্বাচন, গণতন্ত্র বা ব্যক্তিস্বাধীনতা যে-প্রশাসনের অভিধানেই নেই। আর, রুশ প্রেসিডেন্ট এবং চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে কিছু অদ্ভুত মিলও রয়েছে। দু’জনেই নিজ-নিজ দেশে ‘ব্যক্তিগত কাল্ট’ নির্মাণে যত্নবান, এবং কত বছর শাসন ক্ষমতায় থাকবেন, তা-ও তাঁরাই ঠিক করতে চান।
পুতিন তার জন্য দেশের সংবিধান সংশোধন করিয়েছেন, আর শি জিনপিং চিনা কমিউনিস্ট পার্টির গঠনতন্ত্র। পুতিনের স্বপ্ন সোভিয়েত ইউনিয়নকে তৈরি করা, আর শি জিনপিংয়ের মিং রাজত্বের স্বর্ণযুগে ফিরে গিয়ে দুনিয়ায় মাল বেচা। অতএব, এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে দুই শাসকই চাইবেন মস্কো-বেজিং যুগলবন্দি হোক।
আর সেই যুগলবন্দিতে আপাতত করতাল বাজাচ্ছে ইমরান খানের পাকিস্তান। সোজাকথা, বিশ্ব রাজনীতির বাইশ গজে নতুন করে টিম সাজানো চলছে। সেখানে হয়তো নতুন স্লোগানও তৈরি হবে– ‘মার্কিন সাম্রজ্যবাদ নিপাত যাক’-এর পরিবর্তে ‘রুশ আগ্রাসন দূর হটো’ গোত্রের। এই নতুন বাস্তবতায় মস্কোপন্থী হওয়া আর প্রগতিশীলতার নামাবলি নয়। কে স্বৈরতন্ত্রের পক্ষে আর কে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করছে, সেই সংজ্ঞাটাও আবছা হবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বার্লিনে আর দেওয়াল না উঠলেও পূর্ব- ইউরোপ জুড়ে অদৃশ্য ব্যারিকেড তৈরি হবে। সেই ব্যারিকেডের একপাশে যারা গণতন্ত্রের কথা বলবে, তারা-ই ন্যাটোর সদস্য হবে। তিরিশ বছরের ব্যবধানে আবার ওয়াশিংটন আর মস্কোর ভিতরের ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ ঘনীভূত হবে, তীব্রভাবে।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.