নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী: রামচন্দ্র (Ram) তাঁর বিখ্যাত বংশের মর্যাদা অনুযায়ী কাজ করেছেন কিনা, সেটা সাধ্বীশিরোমণি সীতার প্রশ্ন ছিল কালিদাসের ‘রঘুবংশ’-য়। ব্যাপারটা যদি একান্ত কাব্যিক প্রচার বলে মনে করেন আপনারা, তাহলে মনে রাখবেন রামায়ণের ক্রৌঞ্চবিরহী কবিও কিন্তু তাঁর আপন সৃষ্ট নায়কের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন তথাকথিতভাবে কলঙ্কিনী সীতাকে তাঁর আপন তপোভূমিতে আশ্রয় দিয়ে। এবং সীতা যখন সুখপ্রসবা হয়ে দুই পুত্রের জননী হলেন, তখন সেই পুত্রদের পূর্ণশিক্ষার ভার বাল্মীকি নিজে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এই পুত্রজন্মের খবর থেকে আরম্ভ করে তাদের বড় হয়ে ওঠার কোনও সুখ-সন্দেশ তিনি অযোধ্যাপতি রামচন্দ্রকে পাঠাননি। ঘটনাপ্রবাহে লব-কুশের রামায়ণ—গীতি শুনে রামচন্দ্র যখন সীতাকে ঘরে তুলতে চেয়েও ব্রাহ্মণ্যভাবিত মধ্যযুগীয় স্মার্ত বামুনের মতো শুদ্ধিবাতিকের জায়গাটা প্রকট করে তুললেন, তখন আদিকবি কিন্তু বিখ্যাত রাম-রাজত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন সীতার পাতাল-প্রবেশ ঘটিয়ে।
আমরা অবশ্যই মনে করি, রামচন্দ্রের চরিত্র এই সীতা-পরিত্যাগের কাহিনির সঙ্গে সমঞ্জস নয়। আর মনুষ্যলীলায় যদি বা এমনটা করেও থাকেন সমাজোচিত অকর্তব্য হিসাবে, তার জন্য তিনি সমালোচিতও হয়েছেন যথেষ্ট। কালিদাসের মতো মহাকবির লেখনীতে তো বটেই, তিনি আরও নাটকীয় কৌশলে সমালোচিত হয়েছেন নাট্যকার ভবভূতির কলমে। আমরা এই সমালোচনার বিস্তারে যাচ্ছি না। কেননা, পণ্ডিতরা বহুলভাবে স্বীকার করেছেন যে, ভৃগু-আঙ্গীরস গোত্রের ব্রাহ্মণরাই রামায়ণের ‘উত্তর কাণ্ড’-র ব্রাহ্মণায়ণ ঘটিয়েছেন এমনভাবেই যে– এই সীতা-পরিত্যাগের মতো সামাজিক শুদ্ধিবাতিককে প্রশ্রয় দিয়েছেন রামচন্দ্র। আর একটি ঘটনায় শূদ্র-শম্বুক ব্রাহ্মণদের মতো তপস্যা করছিলেন বলে তাঁর গলা কেটে নিয়ে রামচন্দ্র রাজা হিসাবে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিলেন। বর্ণাশ্রমধর্মের সঠিক রক্ষক বলেই রামচন্দ্র কিন্তু বড় রাজা!
বাস্তবে প্রজার সুখে সুখী হয়ে আপন সাধ্বী স্ত্রীকে পরিত্যাগ করা এবং ব্রাহ্মণ প্রজাদের কথা শুনে তপস্যারত অবস্থায় শূদ্র-শম্বুককে বধ করে ব্রাহ্মণদের মর্যাদা রক্ষা করা ছাড়া আর কোনও কিছু এমন নেই, যাতে রাম-রাজ্যের বিশেষত্ব প্রমাণ হয়। সবচেয়ে বড় কথা, এই দুটো কঠিন এবং বিতর্কিত ঘটনার উপরেই কিন্তু রাম-রাজ্যের ‘মিথ’ তৈরি হয়ে গিয়েছে। এবং সেটাও ব্রাহ্মণরাই তৈরি করে দিয়েছেন। যদিও এই ‘মিথ’ তৈরি হওয়ার পরে আর কেউ ভাল করে বিচার-বিশ্লেষণও করে দেখেননি যে, এই বহুশ্রুত রাম-রাজ্যের ইতিহাস রামচন্দ্রের কোন প্রশাসনিক দক্ষতার উপর দাঁড়িয়ে আছে অথবা সেসব দক্ষতার দৃষ্টান্তই বা কী? কিন্তু মিথটা যখন তৈরি হয়েই গেল, তখন কেউ আর তাঁর প্রশাসনিক গল্পগুলো একেবারের তরেও বললেন না। বলার জায়গায় রইল শুধু তাঁর ত্যাগের কাহিনিগুলি এবং রাবণ-বধ। তাতে মিথ আদর্শে পরিণত হল– রঘুপতি রাঘব রাজা রাম।
আমার বক্তব্য অন্য জায়গায়। আমি বলতে চাই, রাম-চরিত্রের মাহাত্ম্য রচনার সমস্ত উপাদান বস্তুত রাম-রাজ্য ছাড়া রাম চরিত্রের আর সব জায়গাতেই আছে এবং সেই জায়গাতেই তিনি ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’। যেসব মূর্খ আজকাল এই ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’ বলে রাজনৈতিক রাম-মাহাত্ম্য প্রচার করছেন, তাঁরা ‘মর্যাদা’ শব্দটার অর্থ তো জানেনই না, ‘পুরুষোত্তম’ তো দূরের কথা। প্রথমত বলি, রামচন্দ্রকে কেউ ‘পুরুষোত্তম’ সম্বোধন করেন না, ‘পুরুষোত্তম’ হল ভগবান বিষ্ণুর অভিধান, সেই সূত্রে কৃষ্ণও পুরুষোত্তম, যেমন লোকবাদ–পুরুষের মধ্যে পুরুষ হলেন বিষ্ণু– নদীষু গঙ্গা পুরুষেষু বিষ্ণুঃ। আর যেমনটি ভগবদ্গীতায় অর্জুনের মুখে কৃষ্ণের প্রতি সম্বোধন– হে পুরুষোত্তম, আমি তোমার সেই ঐশ্বরিক রূপ দেখতে চাই– দ্রষ্টুমিচ্ছামি তে রূপমৈশ্বয়ং পুরুষোত্তম। সবচেয়ে বড় কথাটা বলেছেন কবি কালিদাস– খুব ‘ক্যাজুয়ালি’– যেমনটা একমাত্র ভগবান হরিকেই ‘পুরুষোত্তম’ বলা হয়– হরির্যথৈকঃ পুরুষোত্তমঃ স্মৃতঃ। শ্রীহরি অবশ্যই বিষ্ণু।
প্রসঙ্গত জানাই, ‘ওম্ বিষ্ণুর্নারায়ণ হরি’-কে পুরুষোত্তম বলা হয় বলেই ভগবান রামচন্দ্রকে পুরুষোত্তম বলা যাবে না, অথবা কেউ না বললেও আমরা বলতে পারব না– এমন কিন্তু নয়। তাছাড়া, রামচন্দ্রের মধ্যে শত—সহস্র লক্ষণ আছে, যাতে তাঁকে পুরুষোত্তম বলা যায়। তবুও তাঁকে এই শব্দে ডাকা হয় না। সজ্জন—ভাবুকদের পরম্পরাই তাই। তাঁরা তাই পুরুষোত্তমের অবতার-বিশিষ্টতা বুঝে দু’টি প্রকার নির্দেশ করে বলেছেন– রামচন্দ্র হলেন মর্যাদা পুরুষোত্তম আর কৃষ্ণ হলেন লীলা—পুরুষোত্তম। লীলার ক্ষেত্রে কোনও বাঁধন থাকে না। মনুষ্যরূপে এই পৃথিবীতে এসে কৃষ্ণ যা কিছুই করেছেন, তার মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই এমন চরমতা আছে, যা মানুষের অনুকরণযোগ্য নয়। সেসব লীলারস—আস্বাদন আমাদের কাছে দার্শনিকভাবে ব্যাখ্যাযোগ্য, কিন্তু তাঁর জীবন আমাদের আচরণীয় নয়, জীবনের ক্রিয়াকর্ম-ব্যবহারও মানুষের আচরণীয় নয়– নৈতৎ সমাচরেজ্ জাতু মনসাপি হ্যনীশ্বরঃ। এজন্যই কৃষ্ণ লীলাপুরুষ।
অন্যদিকে দেখুন, রামচন্দ্রও কিন্তু ভগবান বিষ্ণুর অবতার, তিনিও মানুষী-লীলা করছেন, কিন্তু সে লীলার মধে্য কোথাও মনুষ্য—ব্যবহারের অতিক্রম নেই, নেই চিরাচরিত ‘ধর্মের ব্যতিক্রম’, যা কৃষ্ণের ক্ষেত্রে আছে– ধর্মব্যতিক্রমো দৃষ্ট ঈশ্বরাণাঞ্চ সাহসম্। অথচ, কৃষ্ণের জীবনাচরণের বিপ্রতীপে রামচন্দ্রের ব্যবহার এবং জীবন সর্বক্ষেত্রে আদর্শ। ঠিক এইখানেই ‘মর্যাদা’ শব্দটির তাৎপর্য। রামচন্দ্র মর্যাদা—পুরুষ। ‘মর্যাদা’ মানে কিন্তু এখানে dignity, respect– এসব নয়। মর্যাদা মানে ‘সীমা’। সীমা অতিক্রম না করাটাই মর্যাদা অতিক্রম না করা। রামচন্দ্র কীভাবে এই মর্যাদা অতিক্রম করছেন না, সেটার ব্যাখ্যা করতে হলে আগে কৈকেয়ীর কথা শুনতে হবে।
দশরথ কৈকেয়ীকে দু’টি বর দেবেন বলে পূর্বে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। পরে কৈকেয়ী যখন সেই বরে রামের বনবাস আর ভরতের রাজ্যাভিষেক যাচনা করলেন, তখন দশরথ সেই বর দিতে অস্বীকার করলে তাঁর সত্যভঙ্গের প্রসঙ্গেই কৈকেয়ী ‘মর্যাদা’—র কথা উচ্চারণ করেন। কৈকেয়ী বলেন, বিশাল-বিস্তীর্ণ সাগর ইচ্ছা করলেই তার বেলাভূমির সীমা অতিক্রম করতে পারে, বিশেষত চন্দ্রোদয়ারম্ভে সমুদ্রে যে জোয়ারের জলোচ্ছ্বাস তৈরি হয়, তাতে সমুদ্র ইচ্ছা করলেই তটভূমি অতিক্রম করতে পারে, কিন্তু এই যে তটসীমা অতিক্রম করে না– সেখানে নাকি সমুদ্রের প্রতিজ্ঞা আছে যে,
মর্যাদা অতিক্রম করবে না, অর্থাৎ সীমা অতিক্রম করবে না–
সরিতাংতু পতিঃ স্বল্পাং মর্যাদাং সত্যমন্বিতঃ।
সত্যানুরোধাৎ সময়ে বেলাং স্বাং নাতিবর্ততে।।
এখন জিজ্ঞাস্য– রামচন্দ্রের ক্ষেত্রে কীভাবে এই ‘মর্যাদা’ শব্দের তাৎপর্যটি প্রযোজ্য হয়। এখানে মর্যাদা মানে সংযম, কন্ট্রোল। সম্পূর্ণ ইন্দ্রিয়বৃত্তির মধ্যে মন এবং বুদ্ধির সংযম—সীমা যিনি বুঝতে পারেন, তিনি মর্যাদা—পুরুষ। আর মর্যাদা—পুরুষদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন রামচন্দ্র। মর্যাদা পুরুষোত্তমের সবচেয়ে ভাল ইংরেজি অনুবাদ হল– The Lord of propriety, আরও পরিষ্কার করে বললে– he who functions within the limits and rules। প্রখ্যাত সিপিআই নেতা মধু লিমায়ে এইরকম একটা অনুবাদ করলেও, আমার মনে হয়, শেষ-কথাটা হওয়া উচিত ‘within the limits of rules’ অথবা গবেষকোচিত ভাষায়– Rama, the embodiment of supreme order. এখানে ‘order’ মানে শৃঙ্খলা, বিশদর্থে ধর্ম, ধর্মবিধির শেষ সীমা যিনি জানেন এবং সে-সীমা যিনি অতিক্রম করেন না– তিনিই হলেন মর্যাদা—পুরুষ, যাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন রামচন্দ্র।
ধর্মের নিয়ম এতটুকুও যিনি অতিক্রম করেন না, অথচ সমস্ত ক্ষেত্রেই সেই অতিক্রম করার ক্ষমতা তাঁর ছিল– এই সীমাটাই রামচন্দ্রকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে আদর্শ পুরুষ করে তুলেছে বলেই রামচন্দ্র মর্যাদা—পুরুষোত্তম। পিতা দশরথের যাতে সত্যভঙ্গ না হয়, সেজন্য তিনি চোদ্দো বছর বনবাস যেচে নিয়েছেন– এখানে তিনি আদর্শ পুত্র। বন্ধু সুগ্রীব বানরের জন্য তিনি অন্যায়ভাবে বালীকে বধ করেছেন, বন্ধুত্ব রক্ষার ক্ষেত্রেও তিনি আদর্শ। তিনি আদর্শ ভাই– এটা অনালোচ্য বিষয়– লক্ষ্মণ ভাই কথাটা প্রাবাদিক। তিনি আদর্শ বীর– রাবণের মতো ত্রিভুবনবিজয়ী বীরের হন্তা তিনি। তিনি আদর্শ স্বামী– তিনি সীতাকে নির্বাসনই দিন, অথবা অগ্নিপরীক্ষার অপমানই করুন, তিনি সেই বহুবিবাহের স্বচ্ছন্দতার মধ্যেও দ্বিতীয়বার বিবাহ করেননি– তিনি একপত্নীব্রত। আবার তৎকালীন দিনের রাজতান্ত্রিক নীতি-ভাবনায় যেখানে কৌটিলে্যর অর্থশাস্ত্র পর্যন্ত বলে যে, ‘প্রজাসুখেই রাজার সুখ, প্রজার হিতেই রাজার হিত’– সেখানে নিজের স্ত্রীকে পর্যন্ত তিনি নির্বাসন দিচ্ছেন প্রজাদের কাছে নিজের ভাবমূর্তি বজায় রাখার জন্য– এদিক থেকে দেখতে গেলে তিনি আদর্শ রাজাও বটে। এইভাবেই রামচন্দ্র মর্যাদা-পুরুষোত্তম।
আমাদের তর্ক শুধু শেষ জায়গায়; কেননা, রামচন্দ্রের মহিমা-খণ্ডে পুত্রের আদর্শ, ভাইয়ের আদর্শ, কিংবা বীরত্বের আদর্শ নিয়ে কোনও তর্ক থাকতেই পারে না। কিন্তু প্রজারা সন্দেহ করছে বলেই অগ্নিশ্রদ্ধা স্ত্রীকে তিনি সন্দেহ করছেন: রাম-রাজত্বের এই আদর্শটাও এই ভারতের বহু বহু এবং বহু মানুষ ‘আদর্শ’ হিসাবে গ্রহণ করেছেন। সেজন্য ভদ্র বধূর উপর শুধু সন্দেহের বশে অপমান-অত্যাচার করাটাও বহু পুরুষ এবং বহু শাশুড়ির আদর্শ সাধন হয়ে উঠেছে। অতএব, রাম-রাজত্বের এই ‘মিথ’ রাজা হিসাবে এতটুকুও অনুকরণযোগ্য কিনা, বিশেষত সেটা স্ত্রীলোকের প্রতি মর্যাদা প্রকট করে কি না, ভেবে দেখবেন। একইভাবে তপস্যারত শূদ্র-শম্বুককে হত্যাও ‘রাম-রাজ্য’-র মহিমা এতটুকুও বাড়ায় না। অথচ এই দু’টি ঘটনা ছাড়া রাম-রাজ্যের অন্য কোনও মহিমা রামায়ণের কবিকণ্ঠে উচ্চারিত হয়নি। প্রজারঞ্জনের আর কোনও দৃষ্টান্তও রামায়ণে নেই। অতএব, অতিকথা বন্ধ হোক।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.