‘এসসিও’-তে চিনের সঙ্গে ভারত বৈঠক করল না। রাশিয়ার সঙ্গে কথা বলে ও চিনের সঙ্গে কথা না-বলে ভারত কী মেসেজ দিতে চাইল? কলমে জয়ন্ত ঘোষাল
এবার দিল্লিতে একজন আমলা বললেন, শুনুন, যদি কোনও ডিপ্লোম্যাট বলেন ‘হ্যাঁ’, তার মানে জানবেন ‘হয়তো’। আর যদি তিনি বলেন, ‘সম্ভবত’, তবে তার মর্মার্থ হল ‘না’। যদি তিনি বলেন, ‘না, বৈঠক করব না’- তাহলে তিনি ‘ডিপ্লোম্যাট’ নন।
উজবেকিস্তানের সমরখন্দে যাওয়ার আগে নানা সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল, চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে মোদির (Modi) সাইডলাইন দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হতে পারে। ‘সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন’ সংগঠনের সদস্য পাকিস্তানও। পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফও চেয়েছিলেন, ভারতের সঙ্গে পৃথক দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করতে। পাকিস্তান তো দূর অস্ত, মোদি চিনের সঙ্গেও কোনও বৈঠক করলেন না!
সাংহাই বৈঠকে (‘এসসিও’) প্রথম থেকেই চিনের দাপট বেশি। ‘এসসিও’ আর ‘ব্রিকস’-এর মাধ্যমে চিন তার প্রভাব-প্রতিপত্তি এই এলাকায় কায়েম রাখতে চায়। ভারতকে তো প্রথমে সদস্য পর্যন্ত করা হয়নি। পরে, রাশিয়ার মধ্যস্থতায় ভারত সদস্য হয় ‘এসসিও’-তে। পাকিস্তানকেও একইভাবে চিন সদস্য করার শর্তে অন্তর্ভুক্তিতে রাজি হয়। ‘এসসিও’-তে চিনের ভূমিকা বেশি হলেও এবার ভারত সম্পর্কে চিন নরম মনোভাব নেয়। বৈঠক শুরু করার আগে গালওয়ান উপত্যকা থেকে সম্প্রতি ঢুকে পড়া সেনা প্রত্যাহার করার ঘটনা ইতিবাচক বন্ধুত্বের বার্তাও দেয়। চিনের ভাব-ভালবাসা দেখে অনেকে ভেবেছিলেন, তাহলে হয়তো চিঁড়ে ভিজছে। পাকিস্তানের বন্যা নিয়েও মোদির সাহায্যের আশ্বাসে পাক প্রধানমন্ত্রীর মনে আশা জাগে, বৈঠক হোক আর না হোক এবার ‘এসসিও’-তে একটা উষ্ণ করমর্দন তো হতেই পারে। পাক সেনা-ও তাই চেয়েছিল।
তাহলে মোদি-পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করলেও চিনের সঙ্গে করলেন না কেন?
নরেন্দ্র মোদি যা করেন যথেষ্ট ভেবে-চিন্তে করেন। তিনি এবার নিউ ইয়র্ক রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভায় নিজে যোগ না দিয়ে বিদেশমন্ত্রী জয়শংকরকে পাঠান। নিজে গেলেন সমরখন্দ। রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দু’-বছরের জন্য ভারত সদস্য হবে। এই দায়িত্ব গ্রহণের দু’-মাস আগে সংস্থার প্রেসিডেন্ট হিসাবে মোদি ভারতের প্রতিনিধিত্ব করতে নিউ ইয়র্ক যাচ্ছেন সম্ভবত ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু ‘এসসিও’-তে গিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে বৈঠক করলেও কেন চিনের সঙ্গে বৈঠক করলেন না?
পুতিনের সঙ্গে এই বৈঠক জরুরি কয়েকটি কারণে। প্রথমত, রাশিয়ার সঙ্গে বৈঠক করে, আর চিনের (China) সঙ্গে না-করে প্রধানমন্ত্রী চিনকেই বিচ্ছিন্ন করলেন। দ্বিতীয়ত, পুতিনের সঙ্গে সু-সম্পর্ক রেখেও ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে মোদি কড়া সমালোচনা করেন বৈঠকে। বাইরে মোদি বলছেন, ‘যুদ্ধ আমরা চাই না, যুদ্ধ বন্ধ হোক’। কিন্তু বিদেশমন্ত্রক সূত্র বলছে, বৈঠকের ভিতর মোদি পুতিনকে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ স্বরেই বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য ভারতের খুব আর্থিক ক্ষতি হয়ে গিয়েছে।’ রাশিয়া থেকে ভারত তেল, সার নেয়। তেলের দাম বাড়ায় খাদ্যদ্রব্যর দাম বেড়েছে। ভারতের অর্থনীতিতে ধাক্কা লেগেছে। রাশিয়া চাপের মুখে ভারতকে আরও বেশি তেল দিতেও রাজি হয়েছে এবার। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার অবস্থা শোচনীয়। পুতিন ভেবেছিলেন, ইউক্রেন দখল করা সহজ, কিন্তু বাস্তব তা নয়। দুর্বল পুতিনের সঙ্গে মোদির বৈঠক তাই ফলপ্রসূ। আমেরিকা-রুশ সংঘাত থাকলেও ভারত তার ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ বিদেশনীতি অনুসারে রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষার পক্ষে। যুদ্ধ এবার থামবে এমনটাই ভাবনা ভারতের। তৃতীয় ও সবচেয়ে বড় কারণ হল, ২০২৩ মানে, সামনে বছর, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দু’বার বৈঠক করতেই হবে শি-এর সঙ্গে।
‘জি-২০’-র আগামী বৈঠক দিল্লিতে। সামনের বছর শেষের দিক নাগাদ এই বৈঠক হওয়ার কথা। আবার ২০২৩-এ ‘এসসিও’-র বৈঠকও হওয়ার কথা দিল্লিতে। সেখানেও ভারতই আয়োজক। প্রথা অনুসারে চিন, পাকিস্তান, এমনকী, তালিবান সরকারের সঙ্গেও দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করতে হবে ভারতকে। সেটা সৌজন্যমূলক অতিথিবৎসলতা। তাড়াহুড়ো করতে মোদি চাইছেন না। চিনের ফাঁদে পা না দিয়ে আগামী এক বছরে গালওয়ান থেকে আরও ৬০ হাজার সেনা প্রত্যাহারের জন্য তিনি চিনের উপরে চাপ সৃষ্টি করতে চান। আমেরিকা-চিনের বিবাদে ভারতের লাভ তো বেশি।
চিনের ২০তম ‘পার্টি কংগ্রেস’ সমাসন্ন। শি তৃতীয়বারের জন্য বেনজিরভাবে দেশের প্রেসিডেন্ট হবেন। চিনে আবাসন সম্পত্তির বাজার ডুবেছে ব্যাপকভাবে। চিনের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিতে ‘ওয়ান বেল্ট অ্যান্ড ওয়ান রোড’ প্রকল্পের কাজ শ্লথ গতিতে চলছে। শেয়ার বাজারে পতন। এই অবস্থায় চিন-ও ভারতের সঙ্গে প্রকাশ্যে বন্ধুত্বের প্রস্তাব দিচ্ছে। তবে ভারত আলোচনা চায়, অন্ধবিশ্বাসে এগতে আর চায় না।
পাকিস্তানেও ভোট আগস্ট মাসে। ইমরান খান কী করতে পারেন, সেনাপ্রধান রশিদ বাজওয়া-র পর কে সেনাপ্রধান হবেন, শাহবাজ শরিফ ক্ষমতায় আবার আসবেন কি না- এসব ভারত খতিয়ে দেখতে চাইছে। নওয়াজ শরিফ লন্ডন থেকে ফিরে আসতে পারবেন কি না তাও বিচার্য। পাকিস্তান কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা ফেরানোর দাবি সরকারিভাবে না করলেও এখনও অনেক মন্ত্রী প্রকাশ্যে আলোচনা করছেন। এদিকে, পাকিস্তানকে আমেরিকা নতুন ‘এফ ১৬’ যুদ্ধবিমান-ও দেয়নি। পুরনো চুক্তি অনুসারে পুরনো অস্ত্রর ‘আপগ্রেড’ ও ‘আপডেট’ করা বাধ্যতামূলক। আমেরিকা তা না-করলে পাকিস্তান আদালত পর্যন্ত যেতে পারে।
মোদি জানেন, বাইডেন পাকিস্তানের উপর যথেষ্ট রুষ্ট। এখনও পর্যন্ত কোনও দ্বিপাক্ষিক বৈঠক তো দূরের কথা, শাহবাজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও মার্কিন প্রেসিডেন্ট সৌজন্য-ফোন করেননি, যেটা মোদি বরং করেছিলেন।
পাকিস্তানের আর্থিক অবস্থা তথৈবচ আগেও বলেছি। ’৪৮ সালের পর এই দেশ একুশবার ‘আইএমএফ’-এর কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে। আবার নেওয়ার জন্য আমেরিকার কাছে পাকিস্তান অপেক্ষারত। এই অবস্থায় পাকিস্তানের আক্রমণ হানার ক্ষমতা নেই। সেই অবসরে সামনে বছর কাশ্মীরের ভোটও সেরে ফেলতে চাইছেন মোদি। কাজেই চিন-ই হোক আর পাকিস্তান, মোদি কখনওই বলছেন না যে, আলোচনায় বসবেন না। বরং বলছেন, হ্যাঁ, দেখা করবেন। তার মানে, ‘সম্ভবত’ বৈঠক হবে। তবে এখনই নয়। সামনের বছর ২০২৩ সালে, ‘সম্ভবত’। অবশ্য মোদি যদি তখন মনে করেন, পরিস্থিতি অনুকূল।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.