এক মুহূর্তে স্তব্ধ পথঘাট। চোখে জল অসংখ্য মানুষের। কী সেই সম্মোহন? কেন একজনের মৃত্যুর খবরে অঘোষিত বনধের আকার নেয় গোটা রাজ্য? চেন্নাই থেকে সেই আবেগের উৎস সন্ধানে প্রকল্প ভট্টাচার্য
-হ্যাঁরে, সত্যিই?
-সত্যি।
-কিন্তু কোনও চ্যানেলে তো এখনো…
-অত সহজ নাকি! জনতা কেমন খেপে যাবে কোনো ধারণা আছে তোর? ইতিমধ্যেই শুনছি কয়েকজনের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, কেউ কেউ নাকি আত্মহত্যাও করেছেন…
-সেকিরে! পাগল নাকি!
অতিরিক্ত আবেগপ্রবণদের অবশ্য পাগল বলাই যায়। ঊনিশশো সাতাশি সালে এম জি রামচন্দ্রণের মৃত্যুতেও গোটা চেন্নাই শহর ভেঙে পড়েছিল। তিনি ছিলেন জনগণের নেতা। আর ইনি ‘আম্মা’ বা ‘মা’ নামে পরিচিতা। রাজনীতির বিন্দুমাত্র জ্ঞান না থাকা মানুষেরা এঁকে চেনে দরদী নেত্রী হিসেবে। স্বাভাবিক। তমিলনাড়ুর রাস্তায় সব সরকারি বাস চলে, এবং ন্যূনতম ভাড়া এখনো তিন টাকা। দশ টাকায় পাওয়া যায় এক লিটার ‘আম্মা’ জলের বোতল। ‘আম্মা’ ক্যান্টিনে সুলভ মূল্যে টিফিন করা যায়। এছাড়া সরকারি স্কুলে ক্লাশ টুয়েলভের ছাত্রছাত্রীদের ল্যাপটপ দিয়েছেন, সাইকেল দিয়েছেন। বছর দুয়েক আগেই ওঁর এক্তিয়ারের কাউন্সিলের সমস্ত রেশন কার্ডওয়ালা পরিবারকে টেবিল ফ্যান, মিক্সি দিয়েছেন। এছাড়া, গতবছর বন্যায় বিধ্বস্ত চেন্নাই শহরকে শক্ত হাতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। খুব অল্প সময়ের মধ্যে রাস্তা, ব্রিজ সারিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরু করিয়ে দিয়েছিলেন। রূপোলি পর্দার জীবন ছেড়ে এলেও, তাঁকে ঘিরে মায়াবী গল্পকথা কাটেনি এখনো।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে, এম জি রামচন্দ্রনের মতো নায়কের উপস্থিতি সত্ত্বেও ‘অডিমৈ পেন’, ‘কন্নি তাই’, ‘কন্নন এন কাদলন’-এর মতো ছায়াছবির নারীপ্রধান নামকরণ হয়েছিল তাঁকে প্রাধান্য দিয়েই। একাধারে নৃত্যপটিয়সী, অভিনয়শিল্পী এবং উচ্চশিক্ষিতা জয়ললিতা তাঁর চিত্রজগতের জনপ্রিয়তা রাজনৈতিক মঞ্চেও অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। কড়া প্রশাসিকা হওয়ার কারণে বহুবার বিরোধীদের দ্বারা সমালোচিতা হওয়া সত্ত্বেও, নিজের মতবাদ বা সিদ্ধান্তের সঙ্গে কোনোদিনই আপস করেননি। তাঁর বিরুদ্ধে হিসাব বহির্ভূত খরচ করবার এবং সম্পত্তির মালিকানা হওয়ার আইনি আরোপ উঠেছে, জেলেও গিয়েছেন উনি। কিন্তু তার ফলেও না পড়েছে তাঁর জনপ্রিয়তায় কোনও আঁচ, না হয়েছে তাঁর স্বভাবে কোনও পরিবর্তন। চিরকালের মহারানি ছিলেন তিনি, মহারানিই থেকে গেলেন। বেশ কয়েকমাস অসুস্থ ছিলেন। অ্যাপোলো হাসপাতালের আইসিইউ-তে ভর্তি ছিলেন যখন, গোটা গ্রীমস রোড ঘিরে দেওয়া হয়েছিল। সামনের রাস্তা দিয়ে গাড়ি যেতে দেওয়া হচ্ছিল না। ওঁর সমর্থকদের আগ্রহ আর উত্তেজনা সামলাতে না পারার ভয়ে পুলিশ ব্যারিকেড করে দিয়েছিল। রাস্তার সমস্ত অফিস বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা করা হয়েছিল একাধিকবার। তবু সকলেই কোনও একটা কারণে বিশ্বাস করত, উনি আবার সুস্থ হয়ে ফিরবেন। বনবাসী শ্রীরামের পাদুকা নিয়ে যেমন ভরত অযোধ্যায় রাজত্ব করতেন, ঠিক তেমনই চেয়ারে ওঁর ছবি বসিয়ে সংসদে কার্য নির্বাহ চলত। তারপর সুস্থ হয়ে উঠছিলেন, কাজকর্মও শুরু করবেন, এমনটাই শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু গতরাতে ওঁর হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই একটা ভয় সারা চেন্নাইবাসীদের মনে ছড়িয়ে গেল। সকাল থেকেই সবাই উসখুস করছেন, তাহলে আম্মা কি…
সমস্ত স্কুল, কলেজ বিকেল তিনটেয় বন্ধ করে দিতে বলা হল। অফিস থেকেও সকলকে বেরিয়ে পড়তে বলা হল। বাস এমনিতেই কম চলছিল, একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল। অটোও বন্ধ। বিকেল পাঁচটায় হুড়মুড়িয়ে সবাই কেনাকাটা আরম্ভ করে দিল। সবজি, দুধ, দই, শুকনো খাবার… যে সমস্ত দোকানে কার্ড নেয়, তাদের অনেকেরই সব মালপত্র বিক্রি হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। বাকিরা শাটার নামাতে আরম্ভ করে দিল। পেট্রল বাঙ্কে বিরাট লাইন। কী হতে চলেছে কী জানে না, কিন্তু ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবেই, এটাই সকলে হাবেভাবে বোঝাতে লাগল। ভক্তি বা শ্রদ্ধা যখন আবেগের সঙ্গে মিশে যায়, তখন তার একরোখা উদ্দাম আটকানো যায় না। না যুক্তি, না আইন, কিছু দিয়েই থামানো সম্ভব হয়না সেই উচ্ছ্বাসকে। আম্মা আবার তা প্রমাণ করে দিলেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.