ন্যাটো আর রুশ সীমান্তের দিকে অগ্রসর হবে না, এটা নিশ্চিত করতে পুতিন ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়েছেন বলে রাশিয়ার তরফে যতই সাফাই দেওয়ার চেষ্টা হোক না কেন, মার্কিন কূটনীতিকরা সেই যুক্তিকে গুরুত্ব দিতে চান না। ন্যাটোকে শিখণ্ডী খাড়া করে ইউক্রেনের ভূখণ্ড দখল করে নেওয়াই কি পুতিনের আসল উদ্দেশ্য? লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী
রুশ বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রে ইউক্রেন কার্যত গুঁড়ো গুঁড়ো হতে চললেও এখনও বিশ্বের কাছে স্পষ্ট নয়, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের (Vladimir Putin) মূল অভিসন্ধি কী? অভিযান শুরু করার সময় পুতিন বলেছিলেন, ইউক্রেনের সামরিক ক্ষমতা খর্ব করা ও কিয়েভের বুক থেকে নাৎসিবাদী জেলেনস্কি সরকারকে সরিয়ে দেওয়া-ই তাঁর অভিযানের লক্ষ্য। কিন্তু সেটাই যদি পুতিনের লক্ষ্য হয়, তাহলে সমগ্র ইউক্রেন জুড়ে রুশ বাহিনীর এইরকম ধ্বংসলীলা কেন? কেন এত নিরীহ মানুষের মৃত্যু? কেন এই অভিযানে প্রাণ গেল শ’য়ে-শ’য়ে শিশুর? কেন ইউক্রেনের একটার পর একটা শহরের দখল নিচ্ছে রাশিয়া?
তাহলে কি ইউক্রেনের ভূখণ্ড দখল করে নেওয়াই পুতিনের আসল উদ্দেশ্য? এই প্রশ্নের উত্তরই খুঁজছে বিশ্বের কূটনৈতিক মহল। পুতিন-ঘনিষ্ঠরা বলে থাকে, ইউক্রেন ছাড়া রাশিয়া শুধুমাত্র একটি দেশ। ইউক্রেন ফের রুশ ভূখণ্ডে মিললে তবেই প্রতিষ্ঠিত হবে রুশ সাম্রাজ্য। গত শতকের নয়ের দশক জুড়ে বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে রাশিয়ার ধারাবাহিক অপমান দেখতে দেখতে প্রাক্তন কেজিবি আধিকারিকের ক্ষতবিক্ষত জাত্যভিমান কি রুশ সাম্রাজ্যর পুনরুত্থানের মধ্য দিয়েই একমাত্র জুড়োবে? এই ধরনের প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে কূটনৈতিক মহলে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি তাঁর গোপন ডেরা থেকে অসহায়ের মতো চিৎকার করে পূর্বতন সোভিয়েত সাম্রাজ্যের অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানকে বলছেন, ‘এবার আপনারা প্রস্তুত থাকুন পুতিনের বাহিনীকে মোকাবিলা করার জন্য।’
কিছুদিন আগে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, গত শতকের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক বিপর্যয় হল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন। ফের ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নকে জোড়া লাগানোই পুতিনের মূল লক্ষ্য কি না, সে উত্তর ভবিষ্যৎ দেবে। কিন্তু পুতিনের ইউক্রেন অভিযান প্রশ্ন তুলে দিয়েছে ন্যাটো-র কার্যকারিতা নিয়ে। ন্যাটো আর রুশ সীমান্তের দিকে অগ্রসর হবে না, এটা নিশ্চিত করতে পুতিন ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়েছেন বলে রাশিয়ার তরফে যতই সাফাই দেওয়ার চেষ্টা হোক না কেন, মার্কিন কূটনীতিকরা সেই যুক্তিকে গুরুত্ব দিতে চান না। তাঁদের মতে, এটা পুতিনের স্রেফ বাহানা। স্বাধীন, সার্বভৌম কোনও দেশ যদি কোনও সামরিক জোটে ঢুকতে চায়, তাহলে রাশিয়া বাধা দেওয়ার কে? ন্যাটো আর পূর্বে অগ্রসর হতে পারবে না বলে পুতিন যে সমস্ত শর্ত আরোপ করতে চাইছেন, তা যে মানা সম্ভব নয়, সেটা তিনি নিজেও ভাল বোঝেন। আসলে ইউক্রেন বা জর্জিয়ার মতো দেশের ‘ন্যাটো’ অন্তর্ভুক্তিতে আপত্তি তুলে পুতিন চান সেসব দেশে সামরিক অভিযান চালিয়ে সেখানকার ভূখণ্ড দখল করতে।
মার্কিন কূটনীতিকদের এই ব্যাখ্যা ফেলে দেওয়ার নয়। কারণ, যুদ্ধের কয়েক দিনের মধ্যেই জেলেনস্কি তাঁর বাঙ্কার থেকে ঘোষণা করে দেন- ‘ইউক্রেনের ন্যাটোয় ঢোকার কোনও অভিপ্রায়ই নেই। যুদ্ধ বন্ধ করুক রাশিয়া।’ জেলেনস্কির এই আহ্বানের পরেও ইউক্রেনে রুশ বোমাবর্ষণ বন্ধ হয়নি। উল্টোদিকে, জেলেনস্কির আর্জি মেনে ন্যাটো এখনও রাজি হয়নি ইউক্রেনের আকাশকে ‘নো ফ্লাই জোন’ ঘোষণা করতে। ন্যাটোর তরফে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়, এটা করা সম্ভব নয়। কারণ সেক্ষেত্রে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে ন্যাটো-ভুক্ত দেশগুলিও। হতাশ জেলেনস্কি বারবার বার্তা দেওয়ার পরও ন্যাটোর নিষ্ক্রিয়তা বুঝিয়ে দিচ্ছে, এই বিশ্বে এখন ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ নীতিতেই সব দেশ চলতে চায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে ঠান্ডা যুদ্ধের বিশ্বে আমেরিকা ন্যাটো তথা ‘নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন’-এর জন্ম দিয়েছিল কমিউনিজমের প্রসারকে ঠেকাতে। হিটলারকে পরাস্ত করার পর স্তালিনের সোভিয়েত বাহিনী তখন দাপাচ্ছে বিশ্ব। আমেরিকা বুঝতে পারছিল, রাষ্ট্রসংঘ যথেষ্ট নয় কমিউনিজমের প্রসারকে ঠেকানোর ক্ষেত্রে। রাষ্ট্রসংঘে ‘ভেটো’ দেওয়ার ক্ষমতা ছিল সোভিয়েতেরও। রাষ্ট্রসংঘকে অক্ষম বুঝেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান কমিউনিজমকে ঠেকাতে বাইরে থেকে সামরিক হস্তক্ষেপের তত্ত্ব সামনে আনেন। ১৯৪৭ সালে ট্রুম্যান গ্রিস ও তুরস্কে হস্তক্ষেপ করে কমিউনিস্টদের ক্ষমতা দখল রুখে দেন। সেটাই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কমিউনিজম ঠেকাতে আমেরিকার প্রথম হস্তক্ষেপের ঘটনা। ট্রুম্যানের বার্তা ছিল- ‘সশস্ত্র জঙ্গি বা বহিরাগত চাপের মধ্য দিয়ে কোনও স্বাধীন দেশের জনগণকে পদানত করার চেষ্টা হলেই আমেরিকা সেই দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াবে।’ ট্রুম্যানের নীতিই সোভিয়েতের বিরুদ্ধে সামরিক জোট গঠনের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল। ১৯৪৯ সালে ন্যাটো-র জন্মের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছিল, উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের নিরাপত্তা কাঠামোকে সাজিয়ে তোলা। ১২টি দেশ নিয়ে ন্যাটো তৈরি হয়েছিল। ন্যাটো চুক্তির ৫ নম্বর ধারাটি ছিল এই জোটের নির্যাস। যে ধারায় বলা হয়েছিল, ন্যাটো-ভুক্ত দেশগুলির কোনও সদস্য শত্রু দেশের আগ্রাসনের মুখে পড়লে অন্য সদস্য দেশও তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে যাবে। শত্রুর আগ্রাসন বলতে যে বকলমে কমিউনিজমকে বোঝানো হয়েছিল, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।
আমেরিকা শুধু কমিউনিজমের চ্যালেঞ্জ ইউরোপেই দেখেছিল, তেমনটা নয়। পশ্চিম এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও কমিউনিজমকে ঠেকাতে সে-সময় মার্কিন উদ্যোগে একাধিক সামরিক জোট গঠন করা হয়। সেটো, সেন্টো যেগুলির উদাহরণ। সোভিয়েতের পতনের পর স্বাভাবিকভাবেই কমিউনিজম ঠেকাতে তৈরি এইসব সামরিক জোটের প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। ন্যাটো ছাড়া ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ের সব সামরিক জোটই ইতিহাসের পাতায় গিয়ে লুকিয়েছে। একমাত্র ন্যাটোকেই জীবিত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে আমেরিকা। পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারণ ঘটিয়ে ১২ দেশের জোটটিকে এখন ৩০ দেশের জোটে পরিণত করা হয়েছে। কিন্তু কমিউনিজম কার্যত পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার পর যে ন্যাটোর আত্মাটাই হারিয়ে গিয়েছে, তা বলেই দেওয়া যায়। ন্যাটোকে কীভাবে সচল ও সক্রিয় রাখা যায়, তা নিয়ে সাম্প্রতিককালে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে গিয়েছে আমেরিকা। আটলান্টিকের তীর থেকে ন্যাটোকে সম্প্রসারিত করে প্রশান্ত মহাসাগরে নিয়ে যাওয়া যায় কি না, সেই ভাবনাও বিভিন্ন সময়ে এসেছে। যে ন্যাটো বাহিনীর ইউরোপে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা, তাকে দেখা গিয়েছে আফগানিস্তানের মরুকন্দরে গিয়েও বোমাবর্ষণ করতে। ন্যাটো যে তবুও প্রাণ ফিরে পায়নি, তা ইউক্রেনের যুদ্ধে স্পষ্ট। জেলেনস্কির বারংবার কাতর আবেদনের পরেও ন্যাটোর হেলদোল লক্ষ করা যাচ্ছে না।
ন্যাটো-র প্রাসঙ্গিকতা বোধহয় একমাত্র কিছুটা তৈরি করে দিয়েছেন পুতিন-ই। ইউক্রেন কিছুতেই ন্যাটোতে ঢুকতে পারবে না, এই জেদ করে তিনি একটি যুদ্ধের পটভূমি রচনা করতে পেরেছেন। পুতিন বলছেন, বার্লিনের দেওয়াল ভাঙার পর যখন ওয়ারশ চুক্তির ভিত্তিতে গড়া জোট ভেঙে দেওয়ার কথা হয়েছিল, তখন মার্কিন বিদেশসচিব জেমস বেকার তৎকালীন রুশ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ন্যাটো পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েতের কোনও বন্ধু দেশকেই তাদের সদস্য করবে না। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ন্যাটোর পাল্টা হিসাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক ব্লকের দেশগুলি নিয়ে ওয়ারশ চুক্তিভুক্ত জোট গঠন করেছিল। সেই ওয়ারশ চুক্তিভুক্ত জোটের প্রায় সব দেশই এখন ন্যাটোর সদস্য। পুতিন যখন গর্বাচভকে দেওয়া মার্কিন বিদেশ সচিবের প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করেছিলেন, তখন খোদ গর্বাচভই জানিয়েছিলেন, আমেরিকার সঙ্গে ন্যাটোর সম্প্রসারণ নিয়ে তাঁর এরকম কোনও আলোচনাই হয়নি।
তাহলে ন্যাটোকে শিখণ্ডী খাড়া করে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়া কি সত্যিই পুতিনের একটি ভাঁওতা? ইউক্রেনের ভূখণ্ডকে জুড়ে নিয়ে আমেরিকাকে নয়ের দশকের অপমানের জবাব দেওয়াই কি পুতিনের এক ও একমাত্র লক্ষ্য? যুদ্ধের আরও কয়েকটি দিন অতিবাহিত হলে অবশ্য পুতিনের মূল উদ্দেশ্য কী, তা স্পষ্ট হবে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের পরে যদি বিশ্ব ফের একটা ঠান্ডা যুদ্ধের বলয়ে ঢুকে যায়, তাহলে হয়তো ন্যাটোর মতো সামরিক জোটেরও প্রাসঙ্গিকতা ফিরবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.