ভারত-কানাডা সম্পর্ক তলানিতে। ভারতের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, ট্রুডোর লিবারাল পার্টি কানাডার বুকে খলিস্তানপন্থী কার্যকলাপকে উৎসাহ দিয়ে থাকে। এবং সেখানে খলিস্তানি জঙ্গিদের সক্রিয়তা রোধে যথেষ্ট পদক্ষেপ করেনি কানাডা। কিন্তু প্রশ্ন হল, কানাডায় কিছু খলিস্তানপন্থীদের কার্যকলাপে এত উদ্বিগ্ন কেন ভারত? বিশ্লেষণে সুতীর্থ চক্রবর্তী
ভারতের সামনে আরও একটা পাকিস্তান এসে হাজির হয়েছে। কানাডার বিরুদ্ধে ভারত এখন যেসব চোখা-চোখা শব্দ ব্যবহার করছে, তা পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও কখনও করতে হয়নি। গত ২১ সেপ্টেম্বর থেকে কানাডার নাগরিকদের ভারতীয় ভিসা দেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। প্রায় ১৪ লক্ষ ভারতীয় কানাডার অভিবাসী। এদের একটা বড় অংশ ভারতীয় বংশোদ্ভূত হলেও কানাডার পাসপোর্টধারী। এই সমস্ত অভিবাসী এখন চাইলেও আর স্বদেশে আসতে পারবে না। শুধুমাত্র যাদের ‘ওভারসিজ সিটিজেনশিপ অফ ইন্ডিয়া’ তথা ‘ওআইসি’ কার্ড আছে, তারা ছাড়া। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সর্বশেষ নির্দেশ দিয়েছেন, সন্দেহভাজন খলিস্তানিপন্থীদের ‘ওআইসি’ কার্ড-ও বাতিল করতে। সব মিলিয়ে বলা যায়, প্রতিদিনই ভারত-কানাডা সম্পর্ক তলানিতে চলে যাচ্ছে।
ভারত-কানাডা সম্পর্ক এইভাবে তলানিতে চলে যাওয়ার পরিণতি মোটেও সুখকর নয়। একদা কানাডা থেকে প্রতি বছর ভারতে বিপুল আর্থিক সাহায্য আসত। মনমোহন সিংয়ের আমলে ভারত বিদেশি আর্থিক সাহায্য গ্রহণ বন্ধ করেছে। কিন্তু এখনও বহু পণ্যর জন্য ভারত কানাডার উপর নির্ভরশীল। বিশেষত, ভারতের পারমাণবিক চুল্লিগুলির জন্য কানাডার ইউরেনিয়াম গুরুত্বপূর্ণ। কানাডায় যে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় পড়ুয়া প্রতি বছর যায়, তাদের নিরাপত্তাও দু’-দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব জরুরি বিষয়। ইতিমধ্যে ভারতীয় বিদেশমন্ত্রক কানাডায় বসবাসকারী পড়ুয়াদের সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছে, সেদেশে যেভাবে ভারতীয়দের প্রতি জাতিবিদ্বেষ তৈরি করা হচ্ছে, তাতে সবার সাবধানে থাকা দরকার।
কানাডার ক্ষমতায় জাস্টিন ট্রুডো-র উদার বামপন্থী দল আসার পর থেকেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে শুরু করেছে। একই ধরনের অবনতি জাস্টিন ট্রুডোর বাবা পিয়ার ট্রুডোর আমলেও ঘটেছিল। ভারতের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, ট্রুডোর লিবারাল পার্টি কানাডার বুকে খলিস্তানপন্থী কার্যকলাপকে উৎসাহ দিয়ে থাকে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সতর্ক করার পরও ট্রুডোর আমলে কানাডার বুকে খলিস্তানি জঙ্গিদের সক্রিয়তা রোধে যথেষ্ট পদক্ষেপ করা হয়নি বলে ভারতের বরাবরের অভিযোগ। পাঞ্জাবে চার পুলিশকর্মী খুন করে কানাডায় আশ্রয় নিয়েছিল খালিস্তানি জঙ্গি তলবিন্দর সিং পারমার। ইন্দিরা গান্ধী পারমারকে ভারতে প্রত্যর্পণ করার জন্য তৎকালীন কানাডার প্রধানমন্ত্রী পিয়ার ট্রুডোকে অনুরোধ করেছিলেন। এই পারমার-ই ১৯৮৫ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার জাম্বো জেট ‘কণিষ্ক’ উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে মূলচক্রী ছিল। ১৯৮৫ সালে আটলান্টিকের বুকে কয়েকশো যাত্রী নিয়ে ‘কণিষ্ক’-র বিস্ফোরণ গোটা পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। অত বড় জঙ্গি হানার ঘটনা সে-যুগে বিরল ছিল।
‘কণিষ্ক’ বিমানে বিস্ফোরণ যখন ঘটেছিল, তখন সন্ত্রাসবাদের আগুনে দগ্ধ হচ্ছিল গোটা পাঞ্জাব। তার কয়েক মাস আগেই ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডও ঘটে গিয়েছে। কিন্তু, এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। গোটা পাঞ্জাব ঘুরলেও এমন কোনও ব্যক্তির সন্ধান মিলবে না যে প্রকাশ্যে খলিস্তানের পক্ষে সমর্থন জানাচ্ছে। পাঞ্জাবের মানুষ সন্ত্রাসের সেই দিনগুলো এখন পুরোপুরি ভুলে যেতে চায়। খলিস্তানপন্থীদের দেখা শুধুমাত্র মেলে লন্ডন, সানফ্রান্সিসকো অথবা কানাডার শহরগুলিতে। কানাডার ভারতীয় অভিবাসীদের মধ্যে দশ লক্ষ পাঞ্জাবি। তার মধ্যে আট লক্ষ শিখ। বলা হয়ে থাকে যে, এই আট লক্ষ শিখ ভোটের স্বার্থেই নাকি ট্রুডোর পার্টি খলিস্তানপন্থীদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করে না। হরদীপ সিং নিজ্জর নামে যে কানাডার অভিবাসী খলিস্তানি জঙ্গির হত্যা ঘিরে সাম্প্রতিক দুই দেশের টানাপোড়েন, সে বেশ কিছুদিন ধরে ছিল কানাডায় সক্রিয় ‘খলিস্তানি টাইগার ফোর্স’-এর নেতা। নিজ্জর পেশায় একজন ছোটখাট কলের মিস্ত্রি ছিল। কিন্তু তার মূল কাজই ছিল খলিস্তানের পক্ষে কানাডায় বসে ভারত-বিরোধী কার্যকলাপ চালানো।
জুন মাসে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় একটি গুরুদ্বারের সামনে নিজ্জর খুন হয়। তিন মাস বাদে ভারতে নয়া সংসদ ভবনে বিশেষ অধিবেশন শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে অটোয়ায় কানাডার সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো আচমকা ঘোষণা করেন, নিজ্জরের হত্যার পিছনে ভারতীয় এজেন্সি তথা ‘র’-এর হাত রয়েছে। এই কথা বলার ঠিক এক সপ্তাহ আগেই জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে দিল্লি ঘুরে গিয়েছেন ট্রুডো। দিল্লিতে তাঁর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও হয়েছে। সেই বৈঠকে দু’-দেশের তরফেই দু’-দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিদেশি হস্তক্ষেপের প্রসঙ্গ ওঠে। সে-সময় ট্রুডো সরাসরি নিজ্জর হত্যার প্রসঙ্গ তোলেননি। নিজ্জর হত্যার জন্য ‘র’-কে দায়ী করে ট্রুডো কানাডার ভারতীয় হাই কমিশন থেকে এক প্রবীণ কুটনীতিককেও বরখাস্ত করেন। পাল্টা ভারতও কানাডার এক কুটনীতিককে দেশে ফেরত পাঠায়। ট্রুডোর অভিযোগের পর ক্ষিপ্ত ভারতীয় বিদেশমন্ত্রক কানাডার বিরুদ্ধে কড়া বিবৃতি জারি করে। যে বিবৃতিতে বলা হয়, কানাডা ভারতবিরোধী জঙ্গি, চরমপন্থা ও সংগঠিত অপরাধের নিরাপদ ঘাঁটি হয়ে উঠেছে। পুরনো কৌশলগত সহযোগী ও দীর্ঘদিনের বন্ধু দেশ কানাডার বিরুদ্ধে ভারতীয় বিদেশমন্ত্রকের কড়া বিবৃতি সবাইকে চমকে দিয়েছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও ভারতীয় বিদেশমন্ত্রককে এইরকম কড়া বিবৃতি দিতে দেখা যায়নি। কানাডা জি-৭ ও ন্যাটো গোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য দেশ। ফলে, আন্তর্জাতিক কূটনীতির বিচারেও এটি ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
পাঞ্জাবে যখন খলিস্তানপন্থীদের অস্তিত্ব বলে কিছু নেই, তখন ভারত কানাডায় কিছু খলিস্তানপন্থীদের কার্যকলাপে কেন এত উদ্বিগ্ন? খলিস্তানবিরোধী জিগির কি ভারতে কোনওভাবে বিজেপিকে রাজনৈতিক সুবিধা করে দিচ্ছে? লোকসভা ভোটের আগে এই ঘটনা কি মোদির পেশিবহুল জাতীয়তাবাদ প্রদর্শনের একটা সুযোগ তৈরি করছে? এসব প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ঘটনাপ্রবাহে উদ্বিগ্ন পাঞ্জাবের শিরোমণি আকালি দল। তাদের তরফে বলা হয়েছে, শিখদের দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত। এই উত্তেজনার রেশ যেন দেশে শিখবিরোধী প্রচারে পর্যবসিত না হয়। অযথা খলিস্তানবিরোধী জিগির তোলার রাজনৈতিক পরিণাম সম্পর্কে সচেতনতা অবশ্যই জরুরি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.