বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনের জেরে সরকারি মতে, এখনও পর্যন্ত প্রায় ১৫০ জন প্রাণ হারিয়েছে। এত হিংসা, ঘৃণা, প্রাণহানি, সরকারি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষতি সত্ত্বেও ভারত চুপ। কারণ, সাউথ ব্লক জানে এই পরিস্থিতিতে বাড়তি কিছু বলা ঘৃতাহুতির সমতুল্য। লিখেছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
টানা দু’সপ্তাহ অতিবাহিত অথচ এখনও ভারত সরকার বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আন্দোলন ও তার হিংসাত্মক হয়ে ওঠা নিয়ে নির্বাক! আন্দোলনের অকুস্থল যদি সুদান বা নিকারাগুয়া হত, তাহলে নয় কথা ছিল। কিন্তু একেবারে ঘরের পাশের দেশ, যার সঙ্গে রয়েছে ভারতের দীর্ঘতম সীমান্ত, যে-দেশ ভারতের অকৃত্রিম, বিশ্বস্ত বন্ধু এবং গত ১৫ বছর ধরে দু’-দেশের নেতারা যে-সম্পর্ককে ‘সোনালি অধ্যায়’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন, সেখানকার ঘটনাবলি নিয়ে এত উদাসীনতা? বিষয়টি বিস্ময়কর, বিশেষ করে আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে যখন মুহুর্মুহু ভারত-বিরোধী স্লোগান উঠেছে!
আরও বিস্ময়কর, কারণ, এদিকে ওই আন্দোলনের বলি সরকারি মতে, প্রায় ১৫০ হলেও বেসরকারি মতে তা ২০০ পেরিয়ে গিয়েছে। এখনও প্রতিদিনই কোনও না কোনও হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাধীন এক-দু’জনের মৃত্যুর খবর আসছে। আহত কতজন, তার কোনও ঠিকঠাক হিসাব এখনও নেই। সংখ্যাটা পঁাচ থেকে দশ হাজার– যে কোনও কিছু হতে পারে। বছর কয়েক আগে কাশ্মীর উপত্যকায় পুলিশের ছোড়া পেলেট যেভাবে বহু মানুষকে দৃষ্টিহীন করেছিল, ঠিক সেইভাবে বাংলাদেশে পুলিশের ছোড়া পেলেট কেড়ে নিয়েছে কয়েকশো মানুষের দৃষ্টিশক্তি।
রাষ্ট্র ও আন্দোলনকারীদের এই অদৃশ্যপূর্ব হিংসার তুলনা সাম্প্রতিক অতীতে আছে কি না গবেষণার বিষয়। শ্রীলঙ্কার সরকার-বিরোধী গণ-অভ্যুত্থান, বেলারুশে স্বৈরাচারী লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধাচারীদের ঠেকাতে সেনা অভিযান কিংবা পাকিস্তানে শাহবাজ শরিফ সরকারের বিরুদ্ধে পিটিআইয়ের বিক্ষোভ, কোনও আন্দোলনেই নিহতের সংখ্যা দু’-ডজনের বেশি ছিল না। একমাত্র ব্যতিক্রম ২০১১ সালে মিশরে প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান। সেই আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় ৮৫০ জন।
সেই নিরিখে বাংলাদেশে (Bangladesh) এত হিংসা, এত ঘৃণা, এত প্রাণহানি, এত সরকারি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষতি সত্ত্বেও ভারত চুপ কেন? এই নীরবতার বহু কারণ। সেই কারণগুলোর বিশ্লেষণ ভারতকে নানা বিষয়ে সন্দিগ্ধ রাখার পাশাপাশি গভীর দুশ্চিন্তাতেও ফেলে দিয়েছে। এতটাই যে, এখনও পর্যন্ত যা ঘটছে ও ঘটে চলেছে, তা সে-দেশের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলা ছাড়া বাড়তি একটি শব্দও খরচ করা হয়নি। করেনি, কারণ, ভারত জানে, এই পরিস্থিতিতে বাড়তি কিছু বলা হবে ঘৃতাহুতির সমতুল্য। অপেক্ষার নীতি গ্রহণই এখন শ্রেয়। সাউথ ব্লকের সেই বিশ্লেষণের আগে কয়েকটা বিষয় স্পষ্ট করা দরকার। যেমন, ১) সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ ব্যবস্থা বা কোটার সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন শুরু থেকে ছিল পুরোপুরি অরাজনৈতিক। ২) শুধু কোটা সংস্কার নয়, পড়ুয়ারা আন্দোলনের যে প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে, তার নাম ‘বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। এর অর্থ, দেশের সর্বস্তরে যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে, তাদের প্রতিবাদ তার বিরুদ্ধে। ৩) পরিস্থিতির মোকাবিলায় সরকারের প্রাথমিক গড়িমসি ও অবিবেচক মন্তব্যের ফলে আন্দোলনের নেতৃত্ব অরাজনৈতিক ছাত্রদের হাতছাড়া হয়ে যায়। ৪) আন্দোলনরত ছাত্রদের মোকাবিলায় শাসক দলের ছাত্র সংগঠন আওয়ামী লীগকে মাঠে নামানো ছিল মারাত্মক ভুল। ৫) আন্দোলনের রাশ অরাজনৈতিক ছাত্রদের হাত থেকে সরকার-বিরোধী শক্তির হাতে চলে যাওয়া ও তাদের বেপরোয়া ‘জ্বালাও-পোড়াও’ নীতি গোটা আন্দোলনকে বেপথু করে তোলে। এরপর থেকে তার চরিত্র হয়ে দঁাড়ায় সরকার ও বিরোধী পক্ষর টক্কর।
এখন বিষয়টি দঁাড়িয়েছে এইরকম, একদিকে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধর চেতনা-সম্পন্ন শক্তি, অন্যদিকে জামাত, তার ছাত্র সংগঠন ‘শিবির’, রাজাকার ও বিএনপি। অরাজনৈতিক ছাত্র সমাজ ও তাদের বৈষম্য-বিরোধী আন্দোলন এই মুহূর্তে হয়ে গিয়েছে গৌণ। এই বিভাজন রেখার কোনদিকে ভারতের অবস্থান, তা সবার জানা। ভারত কখনও এমন কোনও পক্ষকে মদত দেবে না যা ভারতের স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর। সেই বিচারে শেখ হাসিনা-ই ভারতের কাছের। কিন্তু সাউথ ব্লকের কাছে সেটাও হয়ে দঁাড়িয়েছে প্রবল দুশ্চিন্তার। কিছুটা বিড়ম্বনারও। উপর্যুপরি নির্বাচনী কারচুপি, সার্বিক গণতন্ত্রহীনতা, আইনের শাসনের অনুপস্থিতি, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি দুর্বল করে তোলা ও তাদের সরকারের আজ্ঞাবহ করে রাখার অগুনতি অভিযোগে হাসিনা সরকার ক্রমাগত বিদ্ধ হয়ে চলেছে। সে-দেশের অরাজনৈতিক জনগণের এক বড় অংশ মনে করছে, এই ‘অরাজকতা’ সম্ভব হচ্ছে ভারতের জন্যই। ভারতের প্রশ্রয়ই হাসিনাকে বেপরোয়া করে তুলেছে। ভারতের কাছে এ এক অদ্ভুত সসেমিরা হাল! ‘মাদার অফ ডেমোক্রেসি’-র তকমা ধরে রাখতে হলে বাংলাদেশকে প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রী করে তোলা তার নৈতিক কর্তব্য। অথচ তা করার অর্থ ইসলামি মৌলবাদীদের আবাহন করা। এমতাবস্থায় কী করা উচিত, সেই দোলাচল ভারতকে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বাক্যবন্ধে আটকে রেখেছে।
আন্দোলন হাইজ্যাক হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের আনাচকানাচে, আন্দোলনকারীদের মধ্যে এবং সামাজিক মাধ্যমে ভারত-বিরোধী স্লোগান ও প্রচার তুঙ্গে উঠেছে। সাউথ ব্লকের কাছে তার ভূরি-ভূরি প্রমাণও রয়েছে। আন্দোলনে সাধারণ মানুষের সমর্থন কতটা স্বতঃস্ফূর্ত সেই প্রমাণও সাউথ ব্লকের কাছে আছে। বর্তমানে কোটা আন্দোলনকে ‘জামায়াত-রাজাকার-বিএনপি’ চক্রান্ত বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। তা যে অতি সরলীকৃত– বিদেশমন্ত্রকের তাও জানা।
হাসিনা সরকার এখন ‘অল আউট’ আক্রমণে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ধ্বংসের দায় পুরোপুরি জামাত শিবিরের উপর চাপিয়ে তাদের ‘নিষিদ্ধ’ করার পথে এগচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি মনে করছেন, কোটা কমিয়ে দেওয়ার পর এখন নমনীয় হওয়ার অর্থ নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা ও বিরোধীদের হাতে বাড়তি হাতিয়ার তুলে দেওয়া। সেই রাস্তায়
না-হেঁটে তিনি লড়াইটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপন্থী বনাম তার বিরোধিতাকারীদের মধ্যে চিহ্নিত করে দিতে চাইছেন। গত ১৫ বছর ধরে বারবার এভাবেই তিনি জিতেছেন।
এবারও সেই সুযোগ বিরোধীরাই তঁার হাতে তুলে দিল দেশজুড়ে ভয়ংকর রকমের ‘জ্বালাও-পোড়াও’ কর্মসূচি নিয়ে। মেট্রো রেল, পদ্মা সেতু, টোল প্লাজা, সরকারি অফিস, বিটিভি কেন্দ্রের ধ্বংসের ছবি এটাই প্রমাণ করে পড়ুয়ারা ওই ধ্বংসযজ্ঞের খলনায়ক নয়। প্রমাণ হয়েছে আরও কিছু বিষয়।
‘দ্য ইকোনমিস্ট’ সে সম্পর্কে সংক্ষেপে বলেছে, শেখ হাসিনা এত উন্নয়ন সত্ত্বেও বাস্তব থেকে দূরে থেকেছেন। দলের নেতারাও তা জানেন। বোঝেন। কিন্তু কেউ ভয়ে কিছু বলেন না। এই সংকট দীর্ঘায়িত হলে আওয়ামী লীগ ও হাসিনার পক্ষে তা বিপর্যয়কর হতে পারে। সংকট যতটা হাসিনার, ততটা ভারতেরও। বাংলাদেশের আনাচকানাচে ভারত-বিরোধী মনোভাব কেন চাগাড় দিচ্ছে, ভারতের তা মোটেই অজানা নয়। বিভিন্নভাবে তার প্রতিফলনও ভারত দেখেছে। স্বাধীনতার ৫০তম বর্ষপূর্তিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফর ঘিরে সারা দেশে ৭০টিরও বেশি বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছিল। কেন হয়েছিল তাও কি অজানা?
এত সাহায্য, এত যোগাযোগ, এত দ্বিপাক্ষিক সফর, এত উন্নয়ন, এত অর্থনৈতিক বিকাশ সত্ত্বেও বিরোধিতার বহর কেন দিন দিন বেড়ে চলেছে, ভারতীয় নীতি নির্ধারকদের তা গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে। শুধু কি বাংলাদেশ? নেপাল ও মালদ্বীপেও কি এমন হচ্ছে না? তাহলে কি ধরে নিতে হবে ভারতের বিদেশনীতি ও তার রূপায়ণে কোথাও অসামঞ্জস্য রয়েছে? কোথাও একটা ভুল হচ্ছে? আমলাশাহির কাঠিন্য কি অন্যতম হেতু হতে পারে? কারণ যা-ই হোক, মাটির কাছে দঁাড়িয়ে ঘ্রাণ না নিলে বাস্তবের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায় না। ভারতীয় নেতৃত্বকে মাটির কাছাকাছি নেমে আসতে হবে। গজদন্ত মিনারে বসে থাকলে ভগবান ভরসা। সন্দেহ নেই, বাংলাদেশে শেখ হাসিনাই ভারতের স্বীকৃত ও পরীক্ষিত মিত্র। ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশে তঁার অবস্থান দৃঢ় থাকা ভারত এখনও জরুরি মনে করে। কিন্তু সেই সঙ্গে হাসিনাকে জনপ্রিয়ও থাকতে হবে। দুই ক্ষেত্রেই ভারতের করণীয় অনেক কিছুই। সেই দায়িত্ব থেকে মুখ ফেরালে বিপর্যয় দুই দেশেরই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.