ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের জনমত সমীক্ষার সাফল্যের হার মাত্র ৪০ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যেই সীমিত। কেন জনমত সমীক্ষকরা বারবার ‘প্রকৃত’ জনমত তুলে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছেন? লিখছেন বিশ্বনাথ চক্রবর্তী।
সংসদীয় ব্যবস্থার পীঠস্থান ব্রিটেনে সম্প্রতি ৬৫০ সদস্যবিশিষ্ট ‘হাউস অফ কমন্স’-এর নির্বাচন সম্পন্ন হল। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে চলা কনজারভেটিভ পার্টির শাসনের অবসান ঘটল। লেবার পার্টি ৪১২টি আসন নিয়ে ক্ষমতায় ফিরল। লিবারাল ডেমোক্র্যাট-রা ব্রিটেনের সংসদীয় নির্বাচনে ৭১টি আসন পেয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। নির্দল ও অন্যান্য ছোট দল মিলে ৪৫টি আসন পেয়েছে। নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকেই সেই দেশের একাধিক সমীক্ষক সংস্থা এবারের নির্বাচনের ঋষি সুনকের কনজারভেটিভ পার্টির বড় পরাজয়ের এবং লেবার পার্টির ৪০০-র বেশি আসন পাওয়ার সম্ভাবনার কথা বলেছিল। ফলপ্রকাশের পর দেখা গেল, সমীক্ষার সঙ্গে বাস্তবের ফল হুবহু মিলে গিয়েছে। উন্নত দেশগুলিতে শতকরা ৭৫ থেকে ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে জনমত সমীক্ষা মিলে যাওয়ার রেকর্ড যেখানে রয়েছে, সেখানে ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের জনমত সমীক্ষার সাফল্যের হার মাত্র ৪০ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে।
তবে কেন পশ্চিমবঙ্গে জনমত সমীক্ষকরা বারবার ‘প্রকৃত’ জনমতকে তুলে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছেন? জনমত সমীক্ষা বৃহত্তম গণতন্ত্রের অঙ্গ। এই সমীক্ষাগুলির মাধ্যমে সমাজের নানা ‘ইস্যু’ নিয়ে সমীক্ষকরা মানুষকে প্রশ্ন করেন। এতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মতো বিষয় যেমন থাকতে পারে, তেমনই দুর্নীতি বা নেতৃত্বের প্রশ্নে গান্ধী পরিবার না মোদি সরকার– কে এগিয়ে সেই সমস্ত প্রশ্নও থাকে। স্বভাবতই জনমত ও সমীক্ষা কেবলমাত্র কোন দল ক’টি আসন পাবে সেটি প্রকাশ করে না, এর মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন কাজ সম্পর্কে বা নেতৃত্বের বিষয়েও মানুষকে প্রশ্ন করে মতামত জানতে চাওয়া হয়।
ভারতে জনমত সমীক্ষার অভিজ্ঞতা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমাজবিজ্ঞান চর্চায় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মনস্তত্ত্ব অনুশীলনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। সমাজবিজ্ঞানের চর্চায় যা ‘আচরণবাদ’ নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। কোনও একটি অঞ্চল, বা দেশের জনগণের ভাবনা বোঝার জন্য নমুনা সমীক্ষা করা হয়। কোনও উৎপাদিত দ্রব্যর বিষয়ে ক্রেতার পছন্দ জানার জন্য যেমন নমুনা সমীক্ষা করা হয়, তেমনই ভোটের ফলাফল আগাম জানার জন্য বুথফেরত সমীক্ষাও করা হয়। আমাদের দেশে আটের দশক থেকে মূলত প্রণয় রায়ের হাত ধরে নির্বাচনে জনমত সমীক্ষা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে এই ধরনের সমীক্ষার কাজ ইউরোপ বা আমেরিকায় যত নির্ভুলভাবে করা সম্ভব হয়, তা ভারতের ক্ষেত্রে হয় না।
কারণ, ভারতের বহুত্ববাদী সমাজব্যবস্থায় জাত, ধর্ম, বর্ণের প্রভাবে একটি অঞ্চলের বা সমগ্র দেশের নমুনা স্থির করা পদ্ধতিগতভাবে যেমন জটিল, তেমনই নমুনা অধিক হওয়ার জন্য তথ্যসংগ্রহ ব্যয়বহুলও বটে। ১৯৮৪ সাল থেকে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত যতগুলি প্রতিষ্ঠিত জনমত সমীক্ষা এ-দেশে হয়েছে, তা থেকে বলা যায় মাত্র শতকরা মাত্র ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে জনমত সমীক্ষার আগাম অনুমান বাস্তব ফলাফলের সঙ্গে নির্ভুলভাবে মিলেছে। অন্যদিকে, বাকি ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে জনমত সমীক্ষার সঙ্গে বাস্তবে নির্বাচনী ফলাফলের কোনও সম্পর্ক ছিল না। আমেরিকা বা ইউরোপের কোনও কোনও দেশে নির্বাচনে জনমত সমীক্ষার সাফল্যের হার শতকরা ৮৫ ভাগ। আমাদের দেশে মূলত যথার্থ নমুনা চয়ন করার ব্যর্থতার জন্যই সমীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে বাস্তব ফলাফলের কোনও সম্পর্ক থাকে না।
সমীক্ষা ও ‘মডেল’
ভারতে জনমত সমীক্ষায় মূলত দু’টি মডেল প্রয়োগ করা হয়।‘মডেল ১’ অনুসারে, সমগ্র দেশের বা কোনও একটি রাজ্যের নির্বাচন ক্ষেত্রগুলির মধ্যে থেকে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের (মূলত রাজনৈতিক) ভিত্তিতে জনমত সমীক্ষার জন্য কিছু আসন বেছে নেওয়া যায়। এরপর জনসংখ্যার নিরিখে আনুপাতিক হারে নির্বাচকমণ্ডলের সংখ্যা স্থির করা হয় সমীক্ষার জন্য। এক্ষেত্রে স্তরবিন্যস্ত নমুনা সংগৃহীত করা হয়, যাতে করে মানুষের মতামত সমগ্র সমাজের ভাবনাকে প্রতিফলিত করে। স্তরবিন্যস্ত সমীক্ষায় লিঙ্গ, জাতি, ধর্ম, আর্থিক আয়, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশাগত বিষয়ের পাশাপাশি বয়সের মাপকাঠিও প্রয়োগ করা হয়।
‘মডেল ২’-এ সব লোকসভা বা বিধানসভার সমস্ত আসনকেই সমীক্ষার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর জনসংখ্যার অনুপাতে প্রথম মডেলটির ন্যায় স্তরবিন্যস্ত উত্তরদাতা সাক্ষাৎকারের জন্য নির্বাচিত করা হয়। এই দু’টি মডেল ছাড়াও পূর্বে নির্বাচনী ফলাফলের নিরিখে স্ট্যাটিস্টিক্যাল পোলের মাধ্যমে নির্বাচনের আগাম ফলাফল বোঝার চেষ্টা হয়। ‘স্ট্যাটিস্টিকাল পোল’-এর ক্ষেত্রে ‘IOU’ বা ‘Index of Opposition Unity’ এবং ‘Split Factor’-কে মূল চাবিকাঠি হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
ভারতের মতো দেশে জনমত সমীক্ষায় ‘টেলিফোন সাক্ষাৎকার’ বা ‘অনলাইন’ মাধ্যমে জনমতের আগাম ইঙ্গিত দেওয়া অসম্ভব। ভারতের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিতে মূলত সমীক্ষকদের মাধ্যমে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতেই জনগণের মতামত সংগ্রহ করা হয়। তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহকারীর সততা এবং প্রশ্ন করার ধরনের উপর উত্তরদাতার থেকে যথার্থ তথ্য পাওয়া অনেকটা নির্ভর করে। প্রতিটি বিধানসভা বা লোকসভা আসনের রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক চরিত্রের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। ফলে, সমীক্ষা থেকে উঠে আসা দলগুলির সম্ভাব্যপ্রাপ্ত ভোট দিয়ে কত আসন পাবে– তার বিচার করা কঠিন। বহু ক্ষেত্রেই ‘ভোট শেয়ার’-এর সঙ্গে ‘সিট শেয়ার’-এর কোনও সম্পর্ক থাকে না।
জনমত সমীক্ষা কেন মেলে না?
বাম আমলেও বারবার লক্ষ্য করা গিয়েছে যে-সমস্ত সংস্থা ভোটের আগে জনমত সমীক্ষা করেছিল, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই সমীক্ষার সঙ্গে বাস্তবের ফলের কোনও মিল ছিল না। ২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জাতীয় স্তরের একাধিক সংস্থা বামেদের পরাজয়, তৃণমূল কংগ্রেস এবং কংগ্রেসের জয়ের সম্ভাবনার কথা বলেছিল। কিন্তু বাস্তবে বামেদের ফিরে আসতেই দেখা গিয়েছিল।
২০০৪ সালের লোকসভা, ২০০৬ সালের বিধানসভাতেও কিছু সমীক্ষা সংস্থার ফলাফল মিললেও বেশিরভাগ সমীক্ষক পূর্বানুমান করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তবে ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের ক্ষমতার পরিবর্তনের পূর্বানুমান প্রায় সমস্ত সমীক্ষক সংস্থাই আগাম জানিয়েছিল। আবার ২০১১ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে নির্বাচনের পূর্বানুমান সঠিকভাবে করতে অধিকাংশ সমীক্ষক সংস্থা ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৬-র বিধানসভা, ২০২১-এর বিধানসভা এবং ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে অধিকাংশ সমীক্ষক সংস্থার ফলাফলের সঙ্গে বাস্তব ফলাফলের কোনও মিল ছিল না। কেন সমীক্ষক সংস্থাগুলি রাজ্যের মানুষের নির্বাচনী ভাবনা বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে, তা সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রদের কাছে গভীর অনুসন্ধানের বিষয়ও বটে।
নির্বাচনী সমীক্ষকরা প্রশ্নপত্র নিয়ে মানুষের কাছে মতামত জানতে যান। কাদের কাছে যাচ্ছেন? কী প্রশ্ন করছেন? তার যথার্থতা উঠে আসে সমীক্ষায় যঁারা প্রশ্ন তৈরি করছেন, নমুনা চয়ন করছেন, এবং তথ্য বিশ্লেষণ করছেন, তঁাদের রাজনৈতিক উপলব্ধির যাথার্থ্যের উপর। একেবারে স্থানীয় স্তরে যথার্থ রাজনৈতিক বোঝাপড়ার যদি অভাব থাকে, তবে প্রশ্ন তৈরি করা থেকে শুরু করে নমুনা চয়ন ও বিশ্লেষণ ব্যর্থ হতে বাধ্য। স্থানীয় স্তরে যথার্থ রাজনৈতিক বোধের অভাব থাকায় স্থানীয় সংগঠন এবং নেতৃত্বের সবলতা ও দুর্বলতা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানের অভাব সমীক্ষকদের মধ্যে বারবার লক্ষ করা যাচ্ছে। কোন-কোন রাজনৈতিক উপাদানকে গুরুত্ব দেওয়ার দরকার, কোনগুলোকে কম গুরুত্ব দিলেও চলবে– সেই বিষয়ে সমীক্ষকদের বোঝাপড়ার অভাব থেকে যায়। এই বোঝাপড়ার অভাবের ফলে নমুনা চয়ন, প্রশ্নপত্র তৈরি করা, এবং বিশ্লেষণে সমীক্ষকের ভাবনা ও উপলব্ধির সঙ্গে বাস্তবিক ও মাটির রাজনীতির পার্থক্য থেকে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে সমীক্ষার ফল না মেলার নেপথ্যে এটাই মূল কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। এই মূল কারণের পাশাপাশি আরও যে সমস্ত কারণে সমীক্ষা না-মেলার সম্ভাবনা থাকে সেগুলির কথা বলি এবার।
ভারতের মতো বিশাল বৈচিত্র ভরা দেশে যেখানে ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতি ও ভাষার বিভিন্নতার পাশাপাশি শিক্ষা বা সাক্ষরতার হারে বিপুল ফারাক রয়েছে, যেখানে অসম বিকাশের ফলে পিছিয়ে পড়া মানুষের, বিশেষ করে তফসিলি জাতি ও উপজাতির বঞ্চনার যন্ত্রণাকে পুঁজি করে, রাজনৈতিক কারবারিরা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যেখানে স্বাধীনভাবে মানুষের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করা এবং জনমত সমীক্ষার মধ্যে তা সম্পৃক্ত করা খুবই কঠিন কাজ, এমনকী এটি বাস্তবে আদৌ সম্ভব কি না, সে প্রশ্ন থেকে যায়। আর, এই বক্তব্যের মূল ভাবনাকে মেনে নিয়ে বলা দরকার– সমাজবিজ্ঞান চর্চায় সেই ঝুঁকি সবসময় ছিল, এবং আগামী দিনেও থাকবে। এমনকী বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রেও কিছু ঝুঁকি অস্বীকার করা যায় না। এক্ষেত্রে গবেষককে অবশ্যই বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে।
দ্বিতীয়ত, এখনও বিপুল অংশের মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক বিমুখতা, কোথাও-বা অসচেতনতা রয়েছে। ফলে সমীক্ষার রিপোর্টেই দেখা যায়, উল্লেখযোগ্য শতাংশের উত্তর– ‘জানি না’। অর্থাৎ, হয় তঁাদের বিমুখতা, নয়তো মতামত প্রকাশ করার ক্ষেত্রে অনীহা রয়েছে। ধরা যাক, যেখানে লড়াই হাড্ডাহাড্ডি, সামান্য শতাংশের ব্যবধানে যেখানে ফল নির্ধারিত হয়, সেক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য শতাংশের মতপ্রকাশের অনীহা সমীক্ষাকে কতটা কঠিন জায়গায় নিয়ে যেতে পারে, সে-বিষয়ে সংশয় থেকে যায়।
তৃতীয়ত, ভারতে কোনও একটি বিধানসভা কেন্দ্রে যেখানে গড় ভোটার দু’লক্ষ, অথবা লোকসভা আসনে গড় ভোটার ১৫ লক্ষ, সেখানে নমুনা সমীক্ষার মাধ্যমে কিছু মানুষের মতামতের ভিত্তিতে ফলাফলের পূর্বানুমান বোঝা কতটুকু সম্ভব? এই অভিমতের নিরিখে বলা যায়, যে কোনও সমীক্ষায় যথাযথ নমুনা চয়ন করার মাধ্যমেই সমগ্রকে বোঝা সম্ভব। সেই কারণে সমীক্ষককে অবশ্যই পদ্ধতিগত দিক থেকে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে।
চতুর্থত, নির্বাচনে জয়ের জন্য মরিয়া প্রয়াসে নির্বাচকমণ্ডলীকে প্রভাবিত করার জন্য কোনও রাজনৈতিক দল নিজের মতো করে সমীক্ষককে দিয়ে ফল প্রকাশ করবে না– এর গ্যারান্টি কে দেবে? এক্ষেত্রে সতর্কতামূলক কিছু ব্যবস্থা নির্বাচন কমিশন নিতে পারে। যেমন: যে সংস্থা সমীক্ষার কাজ করবে, তাদের পরিচয়, নমুনা সংখ্যা, পদ্ধতি এবং নমুনা সংগ্রহের প্রমাণও ইত্যাদি গোপন রাখা আবশি্যক।
পুনশ্চ আমাদের সমাজব্যবস্থার বহুত্ববাদ একদিকে যেমন নমুনা সংগ্রহে বাস্তব সমস্যা তৈরি করে, তেমনই তাকে করে তোলে ব্যয়বহুল। এর ফলে, যথার্থ মাত্রার চেয়ে যদি পরিমাণে কম নমুনা সংগৃহীত হয়, তাহলে অল্প মানুষের মতামতের উপর নির্ভর করেই পূর্বানুমান করতে হবে– এটা শর্ত হয়ে দঁাড়ায়, এবং তা ভুল হওয়ার দিকে এগতেও পারে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.