পুজোর মুখে বাংলাদেশের ইলিশ পেল ভারত। স্বভাবতই গদগদ বাঙালি। দুই দেশের জল-হাওয়া এক। সমুদ্র এক। নদীর চরিত্র এক। পরিকল্পনাও অভিন্ন। তবু কেন ইলিশ-আকাল এপারে? কেন এত প্রতিবেশী-নির্ভর আমরা? লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম, ইলিশ নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের কূটনৈতিক টানাপোড়েন সম্পর্কে দু’-চার কথা লিখব। ভাবনার কারণ দুটো। প্রথম, এই মাছ নিয়ে আমাদের আদিখ্যেতা ও হ্যাংলামির বিরক্তিকর পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া।
দ্বিতীয়, রাজনৈতিক পালাবদলের পর ইলিশ-কেন্দ্রিক বাংলাদেশি রাজনীতিতে ভারত-বিরোধিতার নতুন কিছু ঝলক এবং তা চাপা দিতে অবাস্তব যুক্তি-জাল বোনার চেষ্টা। এই ভাবনার মাঝেই দেশে ঢোকে ইলিশবোঝাই ট্রাক। বাজার এমনিতেই তপ্ত। বাংলাদেশি ইলিশ সেই চড়া বাজারে নতুন অগ্নিশিখা।
শেখ হাসিনার আমলে দুর্গাপুজোর সময় ভারতে ইলিশ পাঠানো চল হয়েছিল। কোনও বছর ৫ হাজার, কোনও বছর ৪ হাজার, কখনও-বা ৩ হাজার টন ইলিশ রপ্তানির ঘোষণা তিনি করতেন। পুরোটা আসত কি আসত না অন্য কথা, কিন্তু বাঙালি তাঁর নামে জয়ধ্বনি করত। কাগজে-কাগজে সাতকাহন করে লেখা হত পুজোর ‘উপহার’-এর কথা। ইলিশ ছাড়াও তিনি ফি-গ্রীষ্মে আম পাঠাতেন। কলকাতার পাশাপাশি দিল্লিতেও। রসনাতৃপ্তির এই কূটনীতি অবশ্য একতরফা ছিল না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যাও ঢাকায় আম পাঠাতে শুরু করেন।
কারণ, দেওয়া-নেওয়া সবসময় সম্পর্ককে সমৃদ্ধ করে। বাংলাদেশের ইলিশের দিকে এ-বাংলার এমন হাপিত্যেশ চেয়ে থাকা– কেন যেন কখনও মেনে নিতে পারিনি। কারণ, অভাবের জন্য আমরাই দায়ী। আমরাই দোষী। ইলিশের জন্য কিচ্ছুটি না-করে হালে আমরা নিজেদের ভিক্ষুকের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছি। পরমুখাপেক্ষী হয়ে উঠেছি। এই স্তম্ভে একাধিকবার লিখেছি, যেভাবে কৃচ্ছ্রসাধন ও পরিকল্পনা করে বাংলাদেশ ইলিশ বিপ্লব সফল করেছে, আমরাও তেমন ছক কষে একবগ্গা হয়ে এগতে পারলে বাজার ইলিশে-ইলিশে ছয়লাপ হয়ে যাবে। তখন আর পূর্ব বাংলার দিকে চাতক নয়নে চেয়ে থাকতে হবে না। কিন্তু কোথায় কী! কাকস্য পরিবেদনা! ভুল পরিকল্পনা, সরকার ও সমাজের ঔদাসীন্য , দুর্বল আইন ও তার প্রয়োগহীনতা এবং সর্বোপরি সর্বস্তরে সদিচ্ছার প্রবল অভাব এ বাংলার সমুদ্র ও নদী ইলিশশূন্য করে তুলেছে। প্রতিবেশীর দয়ানির্ভর করে তুলেছে আমাদের।
অথচ, ঠিক বিপরীত ছবি পদ্মাপাড়ে। ২০ বছর আগে যে-দেশে ইলিশের বাৎসরিক উৎপাদন ২ লাখ টনের নিচে নেমে গিয়েছিল, সেই দেশে এখন ইলিশ উঠছে সাড়ে ৫ থেকে ৬ লাখ টন! ২০ বছর আগে বেশি ধরা পড়ত খোকা ইলিশ। বাংলাদেশে যাকে বলে ‘জাটকা’। এখন পিরামিড উলটে গিয়েছে। ১ কেজি ও তার বেশি ওজনের ইলিশ ধরা পড়ছে বেশি। মনে রাখতে হবে, অতটা ওজনদার হতে একটা ইলিশের অন্তত তিন বছর সময় লাগে।
সহজ কথা, বাংলাদেশ পেরেছে, আমরা পারিনি। ওরা পেরেছে, কারণ, ওরা ইলিশ ভালবাসে। ইলিশ নিয়ে ওদের অন্তহীন গর্ব। পেরেছে বলেই এই উপমহাদেশে উৎপাদিত ইলিশের ৮৬ শতাংশ ওদের অবদান। আমরা কমতে-কমতে ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছি। ওদের মতো ভালবাসতে পারলে আমরাও ঘুরে দাঁড়াতে পারি। সেজন্য একগুঁয়ে, একরোখা হতে হবে। বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা ও তার রূপায়ণ করতে হবে। কয়েকটা বছর নির্দয় হতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। ইলিশ সংরক্ষণকে সামাজিক আন্দোলনের রূপ দিতে হবে। দুই দেশের জল-হাওয়া এক। সমুদ্র এক। নদীর চরিত্র এক। পরিকল্পনাও অভিন্ন। দরকার শুধু ওদের মতো রাজনৈতিক-সামাজিক চেতনা ও সদিচ্ছা। ইলিশ নিয়ে দু’-চার কথা লেখার দ্বিতীয় কারণ, রফতানি নিয়ে বাংলাদেশের অবাস্তব কিছু যুক্তির অবতারণা ও তার মধ্য দিয়ে অন্ধ ভারত-বিরোধিতার নতুন ঝলকের সন্ধান।
শেখ হাসিনা অপসারিত হয়েছেন তাঁর প্রতি মানুষের ক্ষোভ মাত্রাছাড়া হয়ে গিয়েছিল বলে। তাঁর ‘স্বৈরাচারিতা’-র নেপথ্যে সে-দেশের মানুষ অপরাধী খাড়া করেছে ভারতকে। ভারত-বিরোধিতার নানা প্রতিফলনও এই আন্দোলনের সময়ে দেখা গিয়েছে। তারই একঝলক দেখা গেল ইলিশ রপ্তানি নিয়ে সে-দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের গড়িমসিতে। মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার প্রথমে বললেন, দেশের মানুষকে না-খাইয়ে বিদেশে ইলিশ পাঠানোর অনুমোদন দেবেন না। বললেন, দেশের মানুষ না-খেয়ে বিদেশে ইলিশ রপ্তানি হবে– এটা হতে পারে না। আগে দেশের মানুষ, পরে বিদেশি।
সরকারের এই মনোভাব রাতারাতি বদলে যায়। ফরিদা আখতারের বিপ্লবের বেলুন চুপসে যায় অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রকের উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সিদ্ধান্তে। তাঁর যুক্তি, বৃহত্তর স্বার্থ ও সর্বোচ্চ মহলের ইচ্ছা-অনুযায়ী ভারতে ইলিশ যাবে। উপহার হিসাবে নয়, ডলারের বিনিময়ে। এই উলটপুরাণ বোঝাল, বিপ্লবের পর ভারতের সঙ্গে বিগড়ে যাওয়া সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে বাংলাদেশ ইলিশ কূটনীতির হাত ধরে এগোতে চাইছে। দিনকয়েক আগে পেঁয়াজ রপ্তানির উপর ‘নিষেধাজ্ঞা’ তুলে দিয়ে ও রফতানি শুল্ক ৪০ শতাংশ থেকে অর্ধেক কমিয়ে ভারত তাদের একটা সিগনাল দিয়েছিল। বাংলাদেশ তার প্রত্যুত্তর দিল ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়ে।
অবশ্য হঠাৎই জমাট বেঁধে যাওয়া সম্পর্কের বরফ এইটুকুতে কমছে না। সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে এখনও ঢের বাকি। নিউ ইয়র্কে মোদি-ইউনূস সাক্ষাৎ হয়নি। তবে জয়শঙ্কর-তৌহিদ হোসেনের (পররাষ্ট্র উপদেষ্টা) বৈঠক হয়েছে। সেটা ছিল পারস্পরিক চেনাজানা পর্ব। কথাবার্তাও হয়েছিল ইতিবাচক। কিন্তু সেই আবহও বিগড়ে যায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুসের কারণে। ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ফাউন্ডেশন’-এর সভায় আন্দোলনের ‘নেপথ্য মস্তিষ্ক’-র পরিচয় করিয়ে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, গোটা আন্দোলন ছিল ‘সুচারুভাবে পূর্বপরিকল্পিত’। তাঁর এই মন্তব্য বুঝিয়ে দেয়– আন্দোলন মোটেই স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না। তাঁর অপসারণ এক গভীর চক্রান্ত বলে হাসিনা যে-অভিযোগ করে এসেছেন, ইউনূসের মন্তব্য বরং তাকেই মান্যতা দিল।
দেড় দশক ধরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যা ছিল, সে-ই স্বাভাবিকতায় পৌঁছতে কত দিন লাগবে এই মুহূর্তে অজানা। ওই বিষয়ে আলোচনা করা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। ইলিশ নিয়ে শুরু করেছি, ইলিশেই থাকতে চাই। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, ফরিদা আখতারের কথায় ফিরে আসতে চাই। উনি বলেছিলেন, দেশের মানুষকে খাওয়ানোর পর ইলিশ রপ্তানির কথা ভাববেন। সেই মন্তব্য কতটা অসাড়– সেটাই তাঁকে জানাতে চাই।
ইলিশ বাংলাদেশের ৩০ শতাংশ দরিদ্র মানুষের নাগালের বাইরে। নিম্ন ও মধ্যবিত্তরও সাধ্যের বাইরে। ইলিশ তাহলে কারা কেনে? উত্তর নিষ্প্রয়োজন। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি খবরে পড়লাম, পটুয়াখালির কুয়াকাটায় আড়াই কেজির একটা ইলিশ ১৩ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে! ১ কেজি ওজনের ইলিশের দাম বাজার খুব সস্তা হলে ১২০০-১৪০০ টাকা। ক’জনের খাওয়ার সাধ্য আছে? অথচ, বছরে উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে পাঁচ-ছয় লাখ টন! সে-দেশের ইলিশ বিপ্লবের অন্যতম কান্ডারি আবদুল ওয়াহাব মনে করেন, এত উৎপাদন হলে রপ্তানি না করে উপায় নেই। রপ্তানিতে ডলার আসে। চোরাচালানে পুরোটাই লোকসান। এই সহজ সত্যটুকু ফরিদা আখতাররা কবে বুঝবেন?
সামাজিক মাধ্যমে মহম্মদ মনিরুজ্জামানের একটা লেখার কিছুটা বরং তুলে দিই। তাঁর মতে, ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ হতে পারে না। কারণ, জাতীয় খেলা হাডুডু, যা ধনী-দরিদ্র-চামার-চাষি সবাই খেলতে পারে। জাতীয় ফুল শাপলা, সবাই যা তুলতে পারে। জাতীয় ফল কাঁঠাল, যা সবার সাধ্যের মধ্যে। তাহলে জাতীয় মাছ কেন স্রেফ ধনীর রসনা তৃপ্ত করে কেন? তাঁর কথায়– গরিব, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত বাংলাদেশির জাতীয় মাছ তেলাপিয়া, পাঙাশ বা রাক্ষুসে মাগুর। ইলিশ নয়! সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে গরুপাচার ৭০ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশও ভারতের গরু-নির্ভরতা কমিয়ে ফেলছে। দশ বছরে জেলায় জেলায় গড়ে উঠেছে অগুনতি গরু খামার। অথচ, এপারের বাঙালি ইলিশ-নির্ভরতা কমাতে পারে না! হ্যাংলার মতো চেয়ে থাকে ওধারে। কেন? চরিত্রের ফারাক?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.