সুতীর্থ চক্রবর্তী: জুনের গোড়ায় তিনটি কৃষি আইন নিয়ে অর্ডিন্যান্স জারির পর থেকে পাঞ্জাবে (Punjab) কৃষকদের যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে, তা থামার কোনও লক্ষণ নেই। ওই বিক্ষোভের আঁচ এখন দিল্লির উপান্তে। পাঞ্জাব ও হরিয়ানার একদল কৃষক দিল্লিতে ঢুকে বিক্ষোভ দেখাতে চাইছেন। কেন্দ্রীয় সরকারও তাঁদের ঠেকাতে মরিয়া। আলোচনার রাস্তায় কবে ফল মিলবে, তা এখনও অনিশ্চিত।
কেন্দ্রীয় সরকার জুনে তিনটি কৃষি বিল (Farm bill) অর্ডিন্যান্স হিসাবে জারি করার পর তড়িঘড়ি ডাকা সংসদের বাদল অধিবেশনে তা আইনে পরিণত করেছে। এই তিনটি কৃষি বিলের অভিঘাত নিঃসন্দেহে সরাসরি আমাদের অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের উপর রয়েছে। কিন্তু এর অভিঘাত এখনও কতটা দেশের সাধারণ কৃষকদের উপর গভীরভাবে পড়বে, তা স্পষ্ট নয়। জুন মাসের গোড়া থেকে কৃষি বিলের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে আমরা বিক্ষোভ আন্দোলন দেখতে পেলেও দেশের অন্যত্র এ নিয়ে কৃষকদের মধ্যে খুব একটা হেলদোল পরিলক্ষিত হচ্ছে না। খুব সম্প্রতি পাঞ্জাবের ঢেউ আছড়ে পড়েছে প্রতিবেশী হরিয়ানার জাঠ কৃষকদের মধ্যে। এক্ষেত্রে জাঠদের জাতিগত ঐক্য গুরুত্বপূর্ণ। গো-বলয় বা দক্ষিণ ভারতে কিংবা বাংলা-ওড়িশায় সে-অর্থে কৃষি বিল নিয়ে কৃষকদের মধ্যে কোনও বিক্ষোভ এখনও পর্যন্ত দানা বাঁধেনি।
যে তিনটি কৃষি সংক্রান্ত আইন কেন্দ্রীয় সরকার সংশোধন করেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ‘এসেনশিয়াল কমোডিটিজ অ্যাক্ট’ তথা অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন। এই আইনের সংশোধনের ফলশ্রুতি আমরা সাধারণ মানুষ রোজ বাজারে গিয়ে কিছুটা হলেও টের পাচ্ছি। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধনের মধ্য দিয়ে কেন্দ্র সমস্ত জরুরি দ্রব্যের ক্ষেত্রে মজুতদারির ঊর্ধ্বসীমা তুলে দিয়েছে। যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি কতকগুলি চরম অবস্থা ছাড়া এখন দেশের যে কোনও ব্যবসায়ী বা সংস্থা ইচ্ছামতো খাদ্যপণ্য মজুত করতে পারে। এই সংশোধনের ফলে আলু, পিঁয়াজের যথেচ্ছ মজুতদারি শুরু হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার সংশোধিত আইন প্রয়োগ করে পিঁয়াজের ক্ষেত্রে মজুতদারি রোখার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাজারে এখনও আলু-পিঁয়াজের দাম কমেনি। ব্যবসায়ীদের কৃষিপণ্য রপ্তানিতে সুবিধা করে দিতে কেন্দ্র আইনের এই সংশোধন করেছে। এর সঙ্গে সরাসরি কৃষকের স্বার্থের খুব একটা যোগ নেই।
দ্বিতীয় যে আইনটি কেন্দ্র সংশোধন করেছে, সেটি চুক্তি-চাষ সংক্রান্ত। এই আইনটির নাম ‘ফার্মার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রোটেকশন) এগ্রিমেন্ট অন প্রাইস অ্যাসিওরেন্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস অ্যাক্ট’। এই আইন সংশোধনের মাধ্যমে বস্তুত চুক্তি-চাষকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। দেশজুড়ে কৃষকরা বহুদিন ধরে অলিখিত চুক্তি-চাষে যুক্ত। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে যুক্ত বাণিজ্যিক সংস্থার জন্য চুক্তিতে কৃষকরা চাষ করে থাকেন। আমাদের এই রাজ্যে যেমন বহুদিন আগে থেকেই ‘পেপসিকো’-র মতো সংস্থার জন্য কৃষকরা চুক্তিতে আলু চাষ করছেন। কৃষকের উৎপাদিত আলু ‘পেপসিকো’ চুক্তির ভিত্তিতে আগাম কিনে নিয়ে তা থেকে পোটেটো চিপ্স বানিয়ে দেশ-বিদেশের বাজারে বিক্রি করছে। এই চাষ এখন চলে মৌখিক চুক্তির ভিত্তিতে। এবার সেটিকে আইনি মোড়ক দেওয়া হয়েছে। এই আইন নিয়েও বস্তুত কৃষকদের নতুন করে বিক্ষোভ দেখানোর কিছু নেই। সরকার—বিক্ষোভকারীরা চাক, বা না-চাক, চুক্তি-চাষ দেশজুড়েই বাস্তব।
তৃতীয় যে কৃষি আইনটি কেন্দ্র সংশোধন করেছে, তার নাম ‘ফার্মার্স প্রোডিউস ট্রেডিং অ্যান্ড কমার্স অ্যাক্ট’। এই আইনটি সংশোধন করে চাপে ফেলা হয়েছে রাজ্যভিত্তিক ‘এগ্রিকালচার প্রোডিউস মার্কেট কমিটি’ (এপিএমসি) আইনগুলিকে। রাজ্যস্তরের এপিএমসি আইনগুলোর মধ্য দিয়ে সরকারি নিয়ন্ত্রিত বাজার তথা মান্ডি তৈরি হয়েছে। সরকার বিভিন্ন কৃষিপণ্যের যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) ঘোষণা করে, তা এই এপিএমসি পরিচালিত মান্ডিগুলোর মাধ্যমে কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। ব্যবসায়ী বা বাণিজ্যিক সংস্থাকে কৃষকের পণ্য কিনতে গেলে এপিএমসি-র লাইসেন্স নিতে হয়। কৃষকরা তাঁদের পণ্য নিয়ে গিয়ে এপিএমসি নিয়ন্ত্রিত মান্ডিতে সরকারি নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে পারেন। আইনের নতুন সংশোধনীর মধ্য দিয়ে কৃষকদের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে এপিএমসি-র বাইরে গিয়ে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করার। উলটোদিকে এপিএমসি-র লাইসেন্স ছাড়াই খোলাবাজারে গিয়ে কৃষিপণ্য কেনার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ী ও বাণিজ্যিক সংস্থাকে। কৃষকদের আশঙ্কা, আইনের এই সংশোধনীর ফলে গুরুত্বহীন হয়ে যাবে রাজ্যভিত্তিক এপিএমসি-র আইনগুলো এবং এপিএমসি নিয়ন্ত্রিত মান্ডিগুলো। বড় বড় কর্পোরেট সংস্থা এই আইনের সুযোগ নিয়ে এপিএমসি-র মান্ডির বাইরে পণ্য কেনাবেচা শুরু করলে আস্তে আস্তে সর্বত্র অকেজো হয়ে যাবে মান্ডিগুলো। সেক্ষেত্রে সরকারের এমএসপি দেওয়ার দায়ও থাকবে না। পাঞ্জাব-হরিয়ানার কৃষকরা তিন নম্বর এই কৃষি আইনটির সংশোধনী নিয়েই উদ্বিগ্ন। তাঁদের আশঙ্কা, সরকার এমএসপি না দিলে তাঁরা তাঁদের ফসলের দাম আর পাবেন না।
তিন নম্বর এই কৃষি আইন নিয়ে দিল্লির (New Delhi) সীমান্তে ধুন্ধুমার শুরু হলেও, দেশের অন্যত্র কৃষকরা যে খুব উদ্বিগ্ন, তা মনে হচ্ছে না। এপিএমসি আইন পশ্চিমবঙ্গেও আছে। রাজ্যের সর্বত্র মান্ডিও রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কতজন কৃষক তাঁর পণ্য বস্তা ভরে মান্ডিতে সরকারি দামে বেচতে যান? এ রাজ্যের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কৃষক মান্ডিমুখো হন না। ফড়েরা মাঠে এসে কৃষকের কাছ থেকে ফসল কিনে নিয়ে যায়। তারাই পরে সেটা সরকারকে বেচে এমএসপি-তে। কিন্তু সবুজ বিপ্লবের দরুন পাঞ্জাব-হরিয়ানায় পরিস্থিতিটা ভিন্ন। কৃষকদের ফড়ে-নির্ভরতা কম। তাঁরাই সমাজের শক্তিশালী শ্রেণি। তাঁদের অঙ্গুলিহেলনেই ফসলের এমএসপি ঘোষণা করে সরকার।
সাতের দশকে এই ‘সবুজ বিপ্লব’-এর যখন রমরমা, তখন পাঞ্জাবের কৃষকরা দাবি তুলেছিলেন, তাঁদের উৎপাদিত ফসল সরাসরি বিদেশে রপ্তানি করতে দিতে হবে। সরকারের ঘরে অল্প মূল্যে ফসল না-বেচে তাঁরা চেয়েছিলেন, বেশি দামে বিদেশের বাজারে ফসল বেচে বিপুল আয় করতে। ১৯৭৩ সালে আনন্দপুর সাহিবে শিরোমণি অকালি দলের সম্মেলনের ঐতিহাসিক প্রস্তাব এ প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য। যেখানে দাবি উঠেছিল, কেন্দ্রীয় সরকারের কাজকর্ম শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক, মুদ্রা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ ও সাধারণ প্রশাসনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক। বাকি কাজ রাজ্য করবে। অর্থাৎ, বৈদেশিক বাণিজ্যও রাজ্য করবে। আনন্দপুর সাহিবের ওই প্রস্তাবের পর শতদ্রু দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। খলিস্তানের দাবিতে আন্দোলনে রক্তাক্ত হয়েছে স্বর্ণমন্দিরও। শহিদ হয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী। খলিস্তান আন্দোলনের বীজ কিন্তু প্রোথিত ছিল ওই আনন্দপুর সাহিবের প্রস্তাবের মধ্যে। আরও একটু এগিয়ে গিয়ে বললে হয়তো বলা যায়, সবুজ বিপ্লবের গভীরেই প্রোথিত ছিল পাঞ্জাবের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের শিকড়।
আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালের সেই আনন্দপুর সাহিবের প্রস্তাবের প্রসঙ্গ উঠে আসছে। আজ পাঞ্জাবের কৃষক মনে করছেন, সবুজ বিপ্লব সফল করতে গিয়ে তাঁরা রিক্ত। তাঁদের জমির তলায় জলের ভাঁড়ার শূন্য হয়ে গিয়েছে। উন্নত বীজ, সার ও কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার করতে গিয়ে তাঁদের জমি উর্বরাশক্তি হারিয়েছে। সবুজ বিপ্লব সফল করতে গিয়ে তাঁদের মাথার উপর এখন বিশাল ঋণের বোঝা। দেশকে খাদ্যে স্বনির্ভর করতে অর্ধশতক আগে সবুজ বিপ্লবকে মাথা পেতে নিয়েছিলেন যে পাঞ্জাবের কৃষক, সবুজ বিপ্লবে রিক্ত সেই পাঞ্জাবের কৃষকের কাছে এখন জরুরি সরকারের ‘ন্যূনতম সহায়ক মূল্য’। এই সহায়ক মূল্যের ব্যবস্থা রক্ষা করতেই আজ তারা মরিয়া। এই আন্দোলনের দাবি, তাঁরা তাঁদের পণ্য সস্তায় আম্বানি-আদানিদের হাতে তুলে দেবেন না।
এই পরিপ্রেক্ষিত বিচার করে কেন্দ্রকে এই আন্দোলন ঠেকাতে সতর্ক পদক্ষেপ করতে হবে। মাথায় রাখতে হবে, ছয় মাস ধরে আন্দোলন চলছে। এই আন্দোলনে এখন শামিল হয়ে গিয়েছে পাঞ্জাবের বহু সাধারণ মানুষ। কেন্দ্রীয় সরকার ও এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে শিরোমণি অকালি দল। আন্দোলন নিয়ে দিশাহারা পাঞ্জাবের কংগ্রেস সরকারও। ওই রাজ্যে বিজেপি কোণঠাসা। কেন্দ্রকে এখন দেখতে হবে, এই আন্দোলন যেন পাঞ্জাবের বুকে ফের বিচ্ছিন্নতাবাদের বীজ বপন না করে। আলোচনার মধ্যেই সমাধানের রাস্তা খুঁজতে হবে। তবে এই আন্দোলনে দেশের অধিকাংশ কৃষকই যুক্ত নন। বিরোধিতাও মূলত একটি আইনকে ঘিরে। কেন্দ্র এখন নমনীয় না-হলে এই আন্দোলনও ভবিষ্যতের জন্য স্ফুলিঙ্গ হয়ে যেতে পারে। তখন তাকে বাগে আনা মুশকিল হবে। শিখ ও জাঠরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গিয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত কিন্তু ইতিহাস বই ঘাঁটলেও মিলবে না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.