Advertisement
Advertisement

Breaking News

Mamata Banerjee

‘তৃণমূল’ নামকরণ কেন করেছিলেন মমতা?

আজ তৃণমূলের জন্মদিন।

Why did Mamata Banerjee name it 'Trinamool'?
Published by: Amit Kumar Das
  • Posted:January 1, 2025 10:59 am
  • Updated:January 1, 2025 11:58 am  

কিংশুক প্রামাণিক: ‘তৃণমূল’ নামটি কীভাবে এল? কেনই-বা ‘নতুন’ দলের এমন নামকরণ করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? সেই প্রামাণ‌্য ইতিহাস প্রবীণরা অনেকেই ভুলে গিয়েছেন। নবীন প্রজন্ম তো প্রায় জানেই না মমতা কেন তাঁর নতুন দলের নাম ‘তৃণমূল কংগ্রেস’ রাখলেন। আজ তৃণমূলের জন্মদিন। সেই প্রেক্ষাপটের খোঁজ করা যাক।

সময় দ্রুত গড়িয়ে যায়। ২৬ বছর কেটে গিয়েছে। তবু ১৯৯৭ সালের ৯ আগস্ট মেয়ো রোডের মুখে তৃণমূল নেত্রীর সাহসী ঘোষণা কানে বাজে। বিশাল সেই মঞ্চের দু’-ধারে শুধু মানুষ আর মানুষ। আমাদের খবর সংগ্রহের জন্য বসতে দেওয়া হয়েছিল মঞ্চের উপরই– যাতে সবকিছু ভাল করে প্রত্যক্ষ করা যায়। তখন ‘দূরদর্শন’ ও একটি-দু’টি ছাড়া কোনও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ছিল না। তা-ও তারা স্যাটেলাইট চ্যানেল নয়। সংবাদপত্রও হালের তুলনায় কম। সোশ‌্যাল মিডিয়ার থাকার প্রশ্নই নেই। স্বভাবতই হাতেগোনা কয়েকজন সাংবাদিকের জায়গা হয়ে গিয়েছিল মঞ্চে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কি সেদিন ভাবতে পেরেছিলেন তাঁর নতুন দল আজ এমন এক ফাঁকা এক্সপ্রেসওয়েতে এসে দাঁড়াবে– যেখানে একটিই গাড়ি দৌড়চ্ছে? আশপাশে কেউ নেই। মসৃণ এক পথ। তৃণমূল কংগ্রেসের পাশে লেখা: ২২২ বিধায়ক। লোকসভা ও রাজ্যসভা মিলিয়ে ৪২ সাংসদ। তিন-তিনবারের মুখ্যমন্ত্রীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই সময়ই দু’বারের রেলমন্ত্রী, একবারের কয়লামন্ত্রী। ভাগ্যের নির্দয় পরিহাস, ২৭ বছর আগে তিনি যে-দল করতেন, সেই কংগ্রেসের ভোট নেমেছে আড়াই শতাংশে। যে-সিপিএমকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য তাঁর রাজনীতি– তাদের কোনও প্রতিনিধি নেই লোকসভা, বিধানসভায়। ভোট মাত্র ৫-৬ শতাংশ। মমতা বলতেন বটে, একবার ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিলে সিপিএমের পার্টি অফিস খোলার লোক থাকবে না। তিনি পোড়খাওয়া নেত্রী, তাই হয়তো দেওয়াললিখন পড়তে পেরেছিলেন।

Advertisement

কিন্তু ১৯৯৭ সালে দাঁড়িয়ে আমরা কেউই সেদিন ভাবতে পারতাম না, তৃণমূলের দাপটে দুটো শতাব্দী-প্রাচীন দল দৈত্য থেকে বামন হয়ে যাবে। লাল পতাকা কর্পূরের মতো উবে যাবে গ্রামবাংলা থেকে। ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারিকে বঙ্গ রাজনীতিতে এক সন্ধিক্ষণ হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। মমতাকে দল থেকে তাড়িয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছিল কংগ্রেস। সিপিএমও চেয়েছিল তাঁকে বহিষ্কার করুক কংগ্রেস। প্রখর মস্তিষ্কের নেতাদের অনুমান ভুল হয়েছিল। তাঁরা মনে করেছিলেন, কংগ্রেসের পতাকাটা কেড়ে নিলে মমতা একা হয়ে যাবেন। নতুন দল করে তিনি হারিয়ে যাবেন। তাঁদের কাছে উদাহরণ ছিল প্রণব মুখোপাধ্যায়।

একদা কংগ্রেসকে চ্যালেঞ্জ করে রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস অর্থাৎ নতুন দল গড়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। রাজনীতিতে অগাধ পাণ্ডিত‌্য, বুদ্ধি, মেধার জন্য যাঁকে ‘ভারতীয় রাজনীতির চাণক্য’ বলা হত। অনেকের ধারণা ছিল, প্রণববাবুর নতুন দল রাজ্যে কংগ্রেসকে বেকায়দায় ফেলে দেবে। ১৯৮৭ সালের বিধানসভা ভোটে বহু আসনে প্রার্থী দিলেন প্রণববাবু। সবার জমানত যায়। উঠে যায় তাঁর দল। অচিরে রাজীব গান্ধীর কাছে ভুল স্বীকার করে কংগ্রেসে ফিরে যান তিনি। ফলে ১৯৯৮ সালে অনেকের ধারণা হয়, প্রণববাবু যখন পারেননি, মমতা কে? তাঁরও শোচনীয় পরিণতি হবে। হাতে-পায়ে ধরে কংগ্রেসে ফিরতে হবে।

ভুল হয়েছিল এখানেই। প্রণব ও মমতার রাজনীতি এক সাগরের ঢেউ নয়। প্রণববাবু তাত্ত্বিক নেতা। মানুষের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক ছিল না। সেই সময় ভোটে লড়ার অভিজ্ঞতাও ছিল না। বার বার রাজ্যসভা থেকে নির্বাচিত। পক্ষান্তরে মমতা জননেত্রী। তিনি লালদুর্গ যাদবপুর চূর্ণ করে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে এসেছেন। যুব কংগ্রেস সভানেত্রী হয়ে ব্রিগেড ভরিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। সিপিএমের আর এক দুর্গ দক্ষিণ কলকাতাও ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। সেই সময় জেলায় গিয়ে কর্মীদের পাশে দাঁড়াতে ভয় পেতেন কংগ্রেস নেতারা। মমতা কিন্তু ‘মমতা’ হয়েছেন কর্মী-সমর্থকদের পাশে দাঁড়িয়েই। তিনি চলে যেতেন অত্যাচারিত কর্মীর বাড়ি। তখনই জেলায় তাঁকে দেখতে মানুষের ঢল। এহেন নেত্রী নতুন দল গড়তেই কংগ্রেসে ভাঙন শুরু হয়ে যায়।

অদ্ভুত এক পরিস্থিতি। একদিকে রাজ্য কংগ্রেসের তাবড় নেতারা, অন্যদিকে মমতার পাশে কর্মীরা। কী ঘটতে চলেছে, স্পষ্ট হয়ে যায়। ১৯৯৮-এ দল গড়েই লোকসভা ভোটের মুখোমুখি হন মমতা। ফল প্রকাশ হলে দেখা যায়, তৃণমূল ৭টি আসনে জিতেছে। কংগ্রেস পেয়েছে ১টি। কেন্দ্রে সরকার পড়ে যাওয়ায় এক বছর পর আবার লোকসভা ভোট। তৃণমূল বেড়ে ৮। কিছু দিনের মধ্যে কমিউনিস্ট নেত্রী গীতা মুখোপাধ্যায়ের আচমকা প্রয়াণের পর পাঁশকুড়া লোকসভা আসন ছিনিয়ে তৃণমূল ৯। নতুন দলের বয়স তখন দেড় বছর। তাতেই এত সাফল্য। হইচই ফেলে দিলেন তৃণমূলনেত্রী। তাহলে কি সিপিএমর যম এসে গেল! জোঁকের মুখে নুন দেওয়ার কাজটা মমতার ঘাড়ে পড়ল।

‘তৃণমূল’ অর্থাৎ ‘গ্রাসরুট’ কথাটা নেহাত একটি সাধারণ শব্দ ছিল। এটি রাজনৈতিকভাবে ১৯৯৭ সালে প্রদেশ কংগ্রেসের নির্বাচনের সময় শোনা যেতে থাকে মমতার গলায়। কংগ্রেস সংগঠনে তখন সোমেন মিত্র-রাজ চলছে। অন্যদিকে, কংগ্রেসের ভিতরে থেকে নানা বাধায় অস্থির হয়ে উঠছেন মমতা। সিপিএমের বিরুদ্ধে তিনি অল-আউট যেতে চান। কিন্তু বাধা হয়ে উঠছে বিপরীত লবি, যাদের সঙ্গে সিপিএমের যোগাযোগ বলে অভিযোগ। এই অবস্থায় মমতা চেয়েছিলেন প্রদেশ কংগ্রেসের রাশ নিজের হাতে নিতে। কিন্তু সোমেনবাবুও ছিলেন ঘোড়েল রাজনীতিক। প্রদেশ নির্বাচনের ভোটার লিস্ট এমনভাবে তৈরি করলেন যাতে মমতা হালে পানি না পান। শুধু তা-ই নয়, জেলায় জেলায় মমতার অনুগামীরা যাতে কমিটিতে জায়গা করতে না পারেন তার সব আয়োজন করা হল। ক্ষিপ্ত মমতা প্রকাশ্যে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। বললেন– প্রদেশ কংগ্রেস নির্বাচনে তৃণমূল স্তরের কর্মীরা মর্যাদা পায়নি। এই নির্বাচন অবৈধ, মানি না। সব কমিটি বাতিল করে স্বচ্ছ ভোটার তালিকা তৈরি করে ভোটে নতুন করে নির্বাচন করতে হবে এআইসিসি-কে। মর্যাদা দিতে হবে কংগ্রেসের তৃণমূল স্তরকে।

বার-বার ‘তৃণমূল, তৃণমূল’ কথাটা সেই থেকে মিডিয়ায় হাইলাইট হতে লাগল। মমতার নাম হয়ে গেল কংগ্রেসের ‘তৃণমূল নেত্রী’। সেই সময় আমরা কয়েকজন সাংবাদিক নিয়মিত কালীঘাটের ৩০বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে যাচ্ছি। সেখানেই অাসল খবর। বঙ্গ কংগ্রেসে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে দিয়েছেন মমতা। সাধারণ মানুষ তাঁর অবস্থান জানতে চাইছে। কী করবেন মমতা? সোমেন মিত্রকে মেনে নিয়ে কংগ্রেস করবেন, না কি নতুন দল গড়ে সিপিএমের বিরুদ্ধে নামবেন!

ইতিমধ্যে এসে গেল ২১ জুলাইয়ের সমাবেশ। মমতা তাঁর শক্তি দেখালেন। কোনও পদে না-থেকেই জনজোয়ার বইয়ে দিলেন ধর্মতলায়। সেদিনও মমতার মুখ থেকে বার বার ‘তৃণমূল’ শব্দটা উচ্চারিত হল। কংগ্রেস হাইকম্যান্ডকে তিনি হুঁশিয়ারি দিলেন– প্রদেশ নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করে তৃণমূল স্তরের কর্মীদের মর্যাদা দিতে হবে, অন্যথায় তিনি চরম সিদ্ধান্ত নেবেন। এই সিদ্ধান্ত কি নতুন দল? তুঙ্গে উঠল জল্পনা।

ঘটনাচক্রে এই সময়ই হাইকম্যান্ড ঘোষণা করল, ৯ আগস্ট কলকাতায় নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে হবে কংগ্রেসের ‘প্লেনারি সেশন’। তখন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট সীতারাম কেশরী। প্লেনারি সফল করার জন্য তিনি প্রদেশ সভাপতি সোমেন মিত্রকে দায়িত্ব দিলেন। এতে মমতা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। কেশরী তাঁর অভিযোগে কর্ণপাত করছেন না, উলটে যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তাঁর ঘাড়ে দায়িত্ব তুলে কার্যত স্বীকৃতি দিচ্ছেন। ২১-এর মঞ্চ থেকে মমতা ঘোষণা করলেন, তিনি প্লেনারি অধিবেশনে যোগ দেবেন না। তৃণমূল স্তরের কর্মীদের নিয়ে বসে থাকবেন গান্ধীমূর্তির পাদদেশে। ওটা যদি ইন্ডোর হয়, তবে তিনি থাকবেন আউটডোরে। মমতা এও বললেন, তিনি নতুন পথে চলবেন কি না সেই সিদ্ধান্ত গান্ধীমূর্তির পাদদেশ থেকে ঘোষণা করবেন।

কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের উপর প্রবল চাপ দিলেও সোনিয়া গান্ধী কিন্তু সেদিন মমতার পাশে থাকেননি। হাওয়া বুঝে রাজ্য কংগ্রেসের কোনও নেতা মমতার পাশে দাঁড়ালেন না। মমতাও বুঝে গেলেন, সিপিএমের বিরুদ্ধে যে-লড়াই তিনি করতে চাইছেন, তা কংগ্রেসে থেকে আর সম্ভব নয়। পাশে কেউ থাকবে না। তাঁর মুক্ত বিহঙ্গ হওয়ার সময় এসেছে। তাঁর মনে বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল, কংগ্রেস ত্যাগ করে একা লড়াই করলে পশ্চিমবঙ্গে যারা বাম শাসনের অবসান চায়, তারা পাশে দাঁড়াবে। সেই লক্ষ্যে ৯ আগস্ট থেকে তাঁর নতুন ইনিংস শুরু। ‘তৃণমূল’ শব্দটা সামনে রেখে তিনি প্রদেশ কংগ্রেসের সমান্তরাল একটি ‘সেট-আপ’ ওই মঞ্চ থেকে তৈরি করে দিলেন। এখনও স্পষ্ট মনে আছে– বিশাল জনসভায় তিনি বলছেন, ‘তৃণমূল কংগ্রেস’ মঞ্চ নিয়েই চলব। কারণ, এটাই আসল কংগ্রেস। শাখা সংগঠনও হবে তৃণমূলের নাম দিয়ে। যেমন ‘তৃণমূল যুব কংগ্রেস’ ‘তৃণমূল ছাত্র পরিষদ’, ‘তৃণমূল মহিলা কংগ্রেস’, ‘তৃণমূল সেবাদল’ ইত্যাদি। ঠিক যেমন কংগ্রেসে থাকে।

কংগ্রেস তাঁকে রাখবে না বুঝেই নিজের হাতে জোড়া ফুলের প্রতীক এঁকে ‘তৃণমূল কংগ্রেস’ নাম দিয়েই নির্বাচন কমিশনে নতুন দলের আবেদন করলেন মমতা। জানতে পেরে ২২ ডিসেম্বর তাঁকে ‘বহিষ্কার’ করা হল। ঘরের লক্ষ্মীকে তাড়িয়ে দেওয়া হল। ১ জানুয়ারি মুক্ত মমতা, চোখে জল। নতুন দলের প্রথম প্রেস কনফারেন্স। এ-ই হল তৃণমূলের সংক্ষিপ্ত জন্মবৃত্তান্ত। আসলে এই সিদ্ধান্ত ছিল অনেক অনেক শক্ত। মমতা ‘মমতা’ হলেন সেই সাহসেই।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement