নিজেকে ‘অপরাধী’ স্বীকার করে ‘উইকিলিক্স’-এর প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ কেন ওয়াশিংটনের সঙ্গে সমঝোতার রাস্তা বেছে নিলেন? সেটা কি শুধুই পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো? না, এই উপলব্ধি যে, টানা আইনি লড়াই তঁার ব্যক্তিগত জীবনকে ধ্বংস করে দিচ্ছিল, যে-চাপ ৫২ বছর বয়সি অ্যাক্টিভিস্ট-সাংবাদিক আর নিতে পারলেন না! এই ক্ষমাপ্রার্থনা তঁার ‘গেরিলা’ ভাবমূর্তিকে ধাক্কা দিল না তো? লিখলেন সুমন ভট্টাচার্য।
‘মিডিয়ার চে গুয়েভারা’ কি শেষ পর্যন্ত আপস করে নিলেন? তাহলে কি ওয়াশিংটনের সঙ্গে সন্ধি করে আপাতত নিশ্চিত জীবনে চলে যেতে চান ‘উইকিলিক্স’-এর প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ? না কি কবীর সুমনের সেই গানটাই সুপ্রযুক্ত তঁার ভাবমূর্তির সঙ্গে– ‘যদি ভাবো কিনছ আমায়, ভুল করেছ…।’
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের সঙ্গে আমেরিকার সমঝোতা হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা ঠিক সেই সময় সামনে এল, যখন পৃথিবী আরও উত্তাল। একদিকে গাজায় গণহত্যা, ইউক্রেন যুদ্ধ; অন্যদিকে পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকার সঙ্গে ইরানের তিক্ত সম্পর্ক আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে টালমাটাল ও ঘোলাটে করে রেখেছে। আর, এই সন্ধিক্ষণেই কেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ওয়াশিংটনের সঙ্গে সন্ধি সম্পাদিত করে নিজের দেশ অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাওয়া এবং হয়তো-বা নিরাপদে নিশ্চিন্ত জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত বেছে নিলেন, সে-প্রশ্ন উঠবেই।
কেন আমরা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে নিয়ে আলোচনা করছি? কেন ‘উইকিলিক্স’-এর প্রতিষ্ঠাতা গত ১৮ বছর ধরে সবসময় খবরের শিরোনামে থেকেছেন? এবং ‘পোলারাইজড’ করার জন্য একেবারে উপযুক্ত চরিত্র জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ কেন বারবার পৃথিবীকে তঁার পক্ষে এবং বিপক্ষে দ্বিধাবিভক্ত করে রেখেছেন? তার অন্যতম প্রধান কারণ বোধহয় জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের এই ‘সাংবাদিক’ থেকে ‘অ্যাক্টিভিস্ট’ হয়ে ওঠার যাত্রাপথটি। যতটা বিতর্ক হয়েছে অ্যাসাঞ্জের ব্যক্তিগত যাপন বা তঁার প্রেমজীবন নিয়ে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি বিতর্ক হয়েছে কীভাবে অ্যাসাঞ্জ বা তঁার প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ‘উইকিলিক্স’ আমেরিকার ‘ডিপ স্টেট’ বা ‘আসল’ আমেরিকাকে বারবার উন্মুক্ত করে দিয়েছে, তা-ই নিয়ে। সেটা আফগানিস্তান যুদ্ধ হোক, কিংবা ইরাকে মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতি, অথবা সিরিয়াতে কী হচ্ছে– বারবার জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ওয়াশিংটনকে তছনছ করে দিয়েছেন তথ্যমোচন করে।
কার্ল বার্নস্টাইন ও বব উডওয়ার্ড, আমেরিকার দুই সাংবাদিক, যদি সেই গত শতকের সাতের দশকে ‘ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারি’ ফঁাস করে দিয়ে তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের পদত্যাগকে ত্বরান্বিত করে থাকেন, তাহলে আমাদের বলতেই হবে যে, সেই আমেরিকান ‘ডিপ স্টেট’-কে বা তথাকথিত গণতান্ত্রিক ও মুক্ত পৃথিবীর ধ্বজাধারী আমেরিকা কীভাবে চলে, সেই আখ্যানকে ফঁাস করে দিয়েছেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ এই শতকের প্রথম দশকে ‘উইকিলিক্স’ প্রতিষ্ঠা করে।
“অল দ্য প্রেসিডেন্ট’স মেন” লিখে কার্ল বার্নস্টাইন আর বব উডওয়ার্ড যেমন রিচার্ড নিক্সনের প্রেসিডেন্ট জীবনের ইতি টানার গল্প আমাদের শুনিয়েছিলেন, তেমনই জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ২০১৬ সালে যখন একের পর এক ইমেল ফঁাস করতে থাকেন, কার্যত সেটাই হিলারি ক্লিন্টনের ‘প্রথম মহিলা’ হিসাবে হোয়াইট হাউসে পৌঁছানোর স্বপ্নকে ব্যর্থ করে দেয়। সেই অর্থে বলতে গেলে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়ার নেপথ্যে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আসলে, একদিক থেকে দেখলে, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ মার্কিন রাজনীতিতে ডেমোক্র্যাটদের যত অস্বস্তিতে ফেলেছেন, রিপাবলিকানদের ততটা নয়। যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্পও ক্ষমতায় আসার পর জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে বিচার ও শাস্তি দেওয়ার প্রক্রিয়াকে চালিয়েই গিয়েছেন।
কেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে ‘মিডিয়ার চে গুয়েভারা’ বললাম? ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’-র পরে, দক্ষিণ আমেরিকায় মার্কিন রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং ‘সিআইএ’ কীভাবে অপারেট করে– সেসব বেআবরু করে দিয়েছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো এবং চে গুয়েভারা। কতকটা সে-পথের অনুসরণেই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত আমেরিকার মুসলিম-বিদ্বেষী মনোভাব আমরা জানতে পেরেছিলাম জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের ‘উইকিলিক্স’ থেকে। কীভাবে আফগানিস্তানে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, কীভাবে নিরীহ মানুষকে তুলে এনে অত্যাচার করা হয়েছে, অথবা ইরাকের সেই বিখ্যাত হেলিকপ্টার ভিজুয়াল– সবই পৃথিবীকে নড়িয়ে দিয়েছিল। মনে রাখতে হবে, এর অনেকটাই কিন্তু হচ্ছিল তখন, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক নতুন ‘ইতিহাস’ তৈরি হয়েছিল, অর্থাৎ সে-দেশে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসাবে বারাক ওবামা শপথ নিয়েছিলেন।
‘উইকিলিক্স’ আসলে ঠিক কী করেছিল? জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ যে প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন, তা আসলে সারা দুনিয়ায় শাসকের বিরুদ্ধে কথা বলতে চায়, শাসক ঠিক কতটা দমন-পীড়ন চালাচ্ছে, সেগুলি প্রকাশ করে দিতে চায়, শাসকের স্বার্থরক্ষা করে যেসব গোপন ‘তথ্য’, তা প্রকাশ্য করে দিতে চায়। গুয়ানতানামোর কারাগারে আমেরিকা যে আফগানিস্তান থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া ১৫০ জন বন্দিকে রেখে দিয়েছে, সেই তথ্য সামনে এনেছিলেন তিনি। তেমনই কাশ্মীরে কী হচ্ছে, তা-ও আমরা জানতে পেরেছি ‘উইকিলিক্স’-এর তথ্য থেকে। এখানেই জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের সাফল্য যে, তিনি কার্ল বার্নস্টাইন বা বব উডওয়ার্ডের ব্যক্তিগত উদ্যোগকে আরও বৃহত্তর আঙ্গিকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তঁার সাংবাদিকতা হয়ে দঁাড়িয়েছিল কার্যত অ্যাক্টিভিজম, যেখানে আমেরিকা বা তথাকথিত লিবারাল ওয়ার্ল্ডে কী হচ্ছে, মুক্তমনা পৃথিবী আসলে তৃতীয় বিশ্বকে কী চোখে দেখে ও দেখছে, তার স্বরূপ উদ্ঘাটিত হচ্ছিল।
তাহলে প্রশ্ন আসে, নিজেকে ‘অপরাধী’ স্বীকার করে কেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ওয়াশিংটনের সঙ্গে সমঝোতার রাস্তা বেছে নিলেন? সেটা কি শুধুই পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো? না, এই উপলব্ধি যে, টানা আইনি লড়াই তঁার ব্যক্তিগত জীবনকে ধ্বংস করে দিচ্ছিল, যে-চাপ ৫২ বছর বয়সি অ্যাক্টিভিস্ট-সাংবাদিক আর নিতে পারলেন না!
আগেই উল্লেখ করেছি, এই সময়টায় অনেক কিছু ঘটছে। প্যালেস্তাইনকে কেন্দ্র করে আমেরিকা উত্তাল, আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসাবে উতরে যেতে পারবেন কি না, তা নিয়েও গভীর সংশয় তৈরি হয়েছে। জো বাইডেন বনাম ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্ভাব্য লড়াইয়ের আগে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের এই সমঝোতা করে নেওয়া কি অন্য কোনও রাজনৈতিক তাৎপর্য বহন করে? সবটা না হলেও অন্তত এটুকু আমরা বুঝতে পারি যে, রাষ্ট্র হিসাবে আমেরিকারও হয়তো দরকার ছিল জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের সঙ্গে একটা সন্ধিপত্রে পৌঁছানোর। বিশেষ করে জো বাইডেন প্রশাসনের। যে জো বাইডেন জানেন, হিলারি ক্লিন্টনের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনাকে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ একক চেষ্টায় ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। আর তাই এখন, প্যালেস্তাইন নিয়ে তিনি এবং তঁার পররাষ্ট্র সচিব যেরকম নাকানিচোবানি খাচ্ছেন, তা জনগণের সামনে যত কম উঠে আসবে, মঙ্গল তত।
মার্কিন মুলুকে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখার বা রাষ্ট্রের মুখোমুখি দঁাড়িয়ে চ্যালেঞ্জ জানানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বা ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর এমন অনেক পোড়-খাওয়া সাংবাদিকই দেখলাম ব্যক্তিগত মতামত দিতে গিয়ে নিবন্ধে লিখেছেন– আসলে আমেরিকা, আমরা যাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ‘শক্তিশালী রাষ্ট্র’ বলে মনে করি, তার নিজস্ব চরিত্রের দিক থেকে একটু ভিতু গোত্রের, অর্থাৎ কেউ মুখোমুখি দঁাড়িয়ে চ্যালেঞ্জ করলে, আমেরিকাও একটা রফা করার পথ খোঁজে। আপাতত জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের সবচেয়ে বড় পাওনা, তিনি যাবতীয় আইনি অভিযোগ ও কারাবাস-পর্ব কাটিয়ে নিজের দেশে ফিরে যেতে পারবেন।
তাহলে কে জিতল? আমেরিকা, না কি জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ? এই নিয়ে হয়তো বিতর্ক থাকবেই। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের ক্ষমাপ্রার্থনা বা নিজেকে ‘অপরাধী’ বলে ঘোষণা করা, যদি আপাত দৃষ্টিতে তঁার ‘গেরিলা’ ভাবমূর্তিকে কিছুটা ধাক্কা দিয়ে থাকে, তবে এ-ও মনে রাখতে হবে যে, আমেরিকার জন্যও এটা যথেষ্ট অস্বস্তিকর: জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মতো একজন স্বাধীনচেতা চরিত্রের মানুষ এই বিশ্বের অন্য কোথাও বেঁচে রইলেন। কে জানে, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ আবার ফিরে আসবেন কি না! আবারও আমেরিকার ‘ডিপ স্টেট’-কে বেআবরু করে দেবেন কি না! ইতিহাস বলে, অ্যাসাঞ্জের মতো ‘গেরিলা’ চরিত্ররা, ঠিক যেমন চে, কোনও দিন বিশ্রাম নিতে জানেন না, তঁাদের জীবনে শান্তিটা আখেরে সাময়িক। হয়তো আবার ফিরে আসার জন্য নেওয়া কয়েক পলকের জরুরি ও অপরিহার্য বিরতি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.