রিংকা চক্রবর্তী: অন্যকে কোণঠাসা করে দেওয়ার মধ্যে একটা ‘সুখ’ আছে। আপনি কতটা প্রাজ্ঞ এবং পরিশ্রমী, অন্যরা, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম কতটা অজ্ঞ এবং অকর্মণ্য– এটা জাহির করার মধ্যে যখন গর্বে আপনার সিনা চওড়া হয়, তখন আসলে বোঝা যায়– মানসিকতা কতটা প্রবীণ! পৃথিবীটা ছোট হতে হতে যখন আজ ‘রিল’-এ বন্দি, এই প্রজন্মকে যখন আমরা ‘স্বার্থপর’, ‘আত্মকেন্দ্রিক’ বলে দেগে দিই, তখন সেখানে অনন্য নজির গড়ল আয়ুষ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইটি-র ছাত্র আয়ুষ শর্মা। চলতি বছর প্লেসমেন্ট সিজনে সর্বোচ্চ বেতনের প্রস্তাব সে-ই পেয়েছে। জীবনের প্রথম বড় চাকরি। আমেরিকায়। মাইনে ভারতীয় মুদ্রায় বছরে দেড় কোটি টাকা! উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। তাও সে হেলায় ফিরিয়ে দিল। কিন্তু এমন ভালো সুযোগ কেন হাতছাড়া করল সে?
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চাকরিপ্রার্থীদের জীবনে একটা টানাপোড়েন ঘুরে-ফিরে আসে– কেরিয়ার না কি পরিবার? সেক্ষেত্রে কোনটা আগে বেছে নিতে হবে, তা নিয়ে বেশ কিছুটা দ্বিধায় পড়ে যায় অনেকেই। তবে শেষ পর্যন্ত মোটা মাইনের চাকরির লোভ ছাড়তে পারে না কেউই। কিন্তু এই গতানুগতিক ধারণা থেকে বেরিয়ে এসেছে বাগুইআটির আয়ুষ শর্মা। সে জানিয়েছে, সে এখনই দেশ ছেড়ে যেতে প্রস্তুত নয়। খুব বেশি দূরে চলে গেলে কে দেখবে তার বাবা-মাকে? হঠাৎ বিপদ এলে! প্রাণপাত করে যাঁরা ওকে বড় করলেন, টাকার পিছনে ছুটতে গিয়ে ওঁদেরই সে একা করে দেবে? তাছাড়া বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনকে ছেড়েও তো সে কখনও একলা থাকেনি! মনখারাপ করলে কীভাবে মুখ লুকোবে সে মায়ের কোলে? ইউএসএ থেকে ফেরা তো এত সহজ নয়! একা থাকেনি মানে সে কিন্তু দুর্বল নয়। তার কাছে চাকরিটা যেমন প্রয়োজন, তেমনই বাবা-মা, বাড়ি, সম্পর্কের বন্ধন– সবটাই জরুরি। যার মেধা উর্বর, তার কি কখনও কাজের অভাব হয়? দেশ ছাড়ার সুযোগ আসবে আরও। শোনা গিয়েছে, ওই কোম্পানির অফার ছাড়াও ডয়েশ ব্যাঙ্ক এবং ওয়ার্নার ব্রাদার্স থেকে চাকরির অফার ছিল তার কাছে।
আয়ুষ ওয়ার্নার ব্রাদার্সের চাকরিটা নিয়েছে। বার্ষিক আয় ২৪ লক্ষর আশপাশে। এই কাজের জন্য তাকে যেতে হবে বেঙ্গালুরু। কলকাতা থেকে ফ্লাইটে মাত্র দু’-তিন ঘণ্টার জার্নি। চাইলেই আসা যাবে যখন-তখন। আয়ুষ প্রমাণ করে দিল সব মেধাবী দেশ ছেড়ে যায় না। দেশের জন্যও কিছু করতে চায়। যে প্রজন্ম দেশের হাল ধরতে চলেছে আগামীতে, সেই প্রজন্মর যত্ন নেওয়া এবং ভবিষ্যতে সে প্রজন্মকে স্থান করে দেওয়া আমাদেরই কর্তব্য। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলো এভাবেই পেরয় একঝাঁক উজ্জ্বল মুখ, তরতাজা প্রাণ, সম্ভাবনার রামধনু।
মা-বাবার জন্য আয়ুষের এই ত্যাগ মনে রাখবে সবাই। কিন্তু আরও যে অসংখ্য ছেলেমেয়ে নীরবে পালন করে চলেছে তাদের নীতি-কর্তব্য! ব্যতিক্রমের জন্য সমস্ত নব্য প্রজন্মকে গড্ডলিকা প্রবাহে ফেলা যায় না। ‘জীবন ধারা’ ছবিতে আমরা দেখেছি রেখা অভিনীত ‘সংগীতা’ চরিত্রটি একজন আদর্শবাদী মেয়ে। সে স্বেচ্ছায় বিবাহিত নয়, কারণ তাকে একটি বড় পরিবারের দায়িত্ব সামলাতে হয়। তার বাবা ঘরছাড়া বহুদিন, মা একজন গৃহিণী, বেকার মদ্যপ ভাইটি বিবাহিত এবং তিন সন্তানের জনক। এক বোন বিধবা, আরেকটি ছোট বোন এবং ছোট ভাই রয়েছে, যারা পড়াশোনা করছে। সকল সদস্য একসঙ্গেই থাকে। পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সংগীতা। সিনেমা এবং বাস্তব এখানেই মিলেমিশে যায়।
অল্প বয়সেই যার কাঁধে দায়িত্বের বোঝা, ‘সংসার’ চেপে বসে, সে পারে না নিজের জন্য আলাদা স্বপ্ন দেখতে। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে হন্তদন্ত হয়ে সেবা করতে হয় অসুস্থ মায়ের। সকাল থেকে শুধু ছুটছে সে। তার বসার বিরাম নেই। আনন্দের ছুটি নেই। জীবন খুব সহজ নয় তার কাছে। সবেধন নীলমণি চাকরিটা সে খোয়াতে চায় না অনেক অপমান, তাচ্ছিল্য সহ্য করার পরেও। শুধুমাত্র একমাত্র সন্তান হওয়ার জন্যই নয়, অনেক সময়ই হয় কী, অন্য ভাইটি বা বোনটি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও দায়িত্ব-বিমুখ হয়। সেক্ষেত্রে যার নীতিবোধ প্রবল, সে পারে না কর্তব্য এড়িয়ে যেতে। পারে না বলেই তাকে বাঁধা ছকে ফেলা যায় না।
তরুণ প্রজন্ম অনেক বেশি সাহসী। যে কোনও দুর্ঘটনাস্থল কিংবা বন্যা কবলিত অঞ্চলে পুলিশ-প্রশাসনের তৎপরতার আগেই উদ্ধারকাজে পৌঁছে যায় স্থানীয় যুবকরাই। ক্রিকেট থেকে দাবা সবেতেই এগিয়ে তরুণ প্রজন্ম। কে বলে তারা নিজের জীবন নিয়ে সিরিয়াস নয়! কর্তব্যবোধ-বিমুখ তারা নয়। জীবনের মূল স্রোত থেকেও বিচ্ছিন্ন নয়।
২০১৮ সালে বাংলাদেশে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনে বিভিন্ন জায়গায় সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেছে শিক্ষার্থীরা। যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গাজায় গণহত্যা বন্ধ, যুদ্ধবিরতি ও ইসরায়েলকে আর্থিক-সামরিক সহায়তা বন্ধের দাবিতে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন বিক্ষোভ চলছে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে হামলার প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও। বিক্ষোভ দমনে ইতিমধ্যে দুই হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সিএএ (CAA) বিরোধী আন্দোলনেও উঠেছিল প্রতিবাদের ঝড়। সম্প্রতি বাংলাদেশের (Bangladesh) কোটা ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে ছাত্র আন্দোলন হচ্ছে। রক্তক্ষয় হয়েছে। প্রাণ দিয়েছে আবু সাঈদ। এই আন্দোলনের প্রথম শহিদ। যে অবিচার চলছিল, সকলের হয়ে প্রতিবাদ করেছিল সে। কিন্তু প্রকাশ্য দিবালোকে সাঈদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ। ২২ বছরের এক তরতাজা প্রাণ। আবু সাঈদের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই আন্দোলনের বীজ রোপিত হল।
এত এত ঘটনা, এত গ্রেপ্তার, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার, হত্যা কোনও কিছুই থামাতে পারেনি ছাত্র আন্দোলনকে। যে ‘পৃথিবী’ আজ শাসকের হয়ে কথা বলে, তাকে পাল্টা জবাব দেয় তরুণ প্রজন্মই। আমেরিকার মতো বিত্তশালী ও পরাক্রমশালী রাষ্ট্রে সুখে থাকার সমস্ত সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ জীবনকে হেলায় উড়িয়ে দিয়ে আয়ুষ যে দেশের জন্য, বাবা-মায়ের জন্য ত্যাগ করল বিদেশের ঝলমলে জীবন– একে আপনি কোন স্বার্থপরতা দিয়ে ব্যাখ্যা করবেন?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.