আতঙ্ক কেন? করোনা সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত বলে? একদমই নয়। আসলে সংক্রমণ নিয়ে কেউ বিন্দুমাত্র শঙ্কিত নয়। প্রাণের ভয়ও নেই। ভয় করোনার অভিঘাতে। তার সর্বগ্রাসী প্রভাবে। কী দিন পিছনে ফেলে এসেছে তা আজ ভাবলে শিউরে উঠি সবাই। কাদের কপালে ভাঁজ? বিশেষ করে ক্ষুদ্র ব্যবসার সঙ্গে যারা যুক্ত, ঠিকা শ্রমিক, কাজের বিনিময়ে প্রতিদিন বেতন পায়, পথে হকারি করে, নানা সামাজিক পেশার সঙ্গে যুক্ত- এমন কোটি কোটি মানুষের। বড়দিন থেকে তাদের সবার মুখ ভার। এই বুঝি সব বন্ধ করার নির্দেশ আসে! কলমে কিংশুক প্রামাণিক
মানুষকে আবার ভয় পাইয়ে দেওয়া হল। আরও স্পষ্ট করে বললে- ভয় পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে অবিরত। ভাবখানা এমন, করোনা আসতে পারে ধরে নিয়ে সবাই কাজকর্ম গুটিয়ে ঘরে ঢুকে যাক। স্কুল-কলেজ অফিস-আদালত আবার বন্ধ হয়ে যাক। মাস্কে মুখ ঢেকে নিক সমাজ। নতুন বছর আসছে। বাঙালির ঘরে একদিকে ক্রিসমাস কেক, অন্যদিকে পৌষের পিঠেপুলি। মনটা উড়ু-উড়ু। উৎসব-উৎসব। খুশির মেজাজ। যথারীতি ‘বাৎসরিক রুটিন’-এর মতো ডিসেম্বর পড়তেই চিনে করোনা নাকি বাড়তে শুরু করেছে। যদিও ইউরোপ-আমেরিকায় তার বিন্দুমাত্র প্রভাব নেই। অথচ আমাদের কেন্দ্রীয় সরকারের ঘুম নেই!
আবার করোনা এসে গিয়েছে এমন প্রচার সামনে রেখে ভ্যাকসিন, অক্সিজেন, অক্সিমিটার, পিপিই কিট, মাস্ক, স্যানিটাইজার নিয়ে যুদ্ধকালীন তৎপরতা। তাকে হাতিয়ার করে আবার সর্বনাশা লকডাউনের গুজবে সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড়। অতীতের ভুল শুধরে নিয়ে মহামারির মোকাবিলায় যদি সরকার সচেতনতামূলক ব্যবস্থা নেয় তার চেয়ে ভাল কিছু হতে পারে না। সেটাই সঠিক। কিন্তু এ-ও দেখতে হবে, মানুষের মনে যেন ভয় দেখা না দেয়। এই প্রেক্ষাপটে দেশজুড়ে দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি। সাধারণ মানুষ দিশাহারা। আমরা, যারা কর্মসূত্রে জনতার মধ্যে থাকি, তারা অনুভব করতে পারছি কী পরিমাণ আতঙ্ক করোনা নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সমাজে। ট্রেন, বাস, বাজার, হকার- সবার মুখে সংশয়, অনিশ্চয়তা। গৃহকর্তা মন দিয়ে খবর রাখছেন সত্যিই কি করোনা এসে গিয়েছে!
আতঙ্ক কেন? করোনা সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত বলে? একদমই নয়। আসলে সংক্রমণ নিয়ে কেউ বিন্দুমাত্র শঙ্কিত নয়। প্রাণের ভয়ও নেই। ভয় করোনার অভিঘাতে। তার সর্বগ্রাসী প্রভাবে। কী দিন পিছনে ফেলে এসেছে তা আজ ভাবলে শিউরে উঠি সবাই। কাদের কপালে ভাঁজ? বিশেষ করে ক্ষুদ্র ব্যবসার সঙ্গে যারা যুক্ত, ঠিকা শ্রমিক, কাজের বিনিময়ে প্রতিদিন বেতন পায়, পথে হকারি করে, নানা সামাজিক পেশার সঙ্গে যুক্ত- এমন কোটি কোটি মানুষের। বড়দিন থেকে তাদের সবার মুখ ভার। এই বুঝি সব বন্ধ করার নির্দেশ আসে! কে আবার রটিয়ে দিয়েছে- ৩ জানুয়ারি থেকে দেশে নাকি আবার লকডাউন হবে। এর জেরে বর্ষবরণের প্রস্তুতিতে প্রশ্নচিহ্ন। অনুষ্ঠানে বিধিনিষেধ জারি হবে না তো! জমায়েতে রাশ টানার নির্দেশ আসবে না তো! পর্যটনক্ষেত্রগুলিতেও ছড়িয়েছে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। খুব বেশি সংখ্যায় না হলেও বুকিং ক্যানসেল হতে শুরু করেছে।
বেশি চিন্তা বয়স্কদের মধ্যে। অবসরপ্রাপ্ত মানুষ এই সমাজে সবচেয়ে অসহায়। করোনা এ-যাবৎ পর্যন্ত বয়স্কদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাস চালিয়েছে। প্রবীণরা ভাবছেন, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পার্কে হাঁটতে যাওয়া ঠিক হবে তো? বাজারে গেলে মাস্ক পরে যাওয়া উচিত কি উচিত নয়? অ্যাকাউন্টে ভয়ে ভয়ে চোখ বোলাচ্ছেন কেউ কেউ। আবার সেই ভয়ংকর দিন এলে শেষ সঞ্চয়ই সম্বল। যেহেতু স্কুলে ক্রিসমাসের ছুটি চলছে সেজন্য রক্ষা। না হলে হইচই পড়ে যেত। দু’-বছর পড়াশোনা লাটে উঠেছিল। তবু স্কুল আবার খুলবে কি না তা নিয়ে অভিভাবকরা খোঁজ নিতে শুরু করেছেন। আমার ১২ বছরের কন্যা আমাকে দু’বার প্রশ্ন করেছে, বাবা ৩ তারিখ থেকে কি লকডাউন? অবাক হয়ে ওকে বুঝিয়েছি। পরক্ষণে মনে হয়েছে, কে রটাল এসব মিথ্যা! ও যেহেতু বলছে, তখন ভ্রান্ত সংবাদ সমাজে ভাইরাল।
এখন সবচেয়ে ভয়ংকর সোশ্যাল মিডিয়া! যার-যা খুশি লিখে ‘পোস্ট’ করে দেওয়া হয়। নেই সামাজিক দায়িত্ব, নেই মূল্যবোধ। নেই পড়াশোনাও। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তি ছড়াতে পোস্ট করে। কেউ আতঙ্কে তা ফরওয়ার্ড করে যায়। আবার কেউ নিজেকে জাহির করতে আকর্ষণীয় কিছু ছড়িয়ে দেয়। যেটা পোস্ট করা হল, তার সত্য-মিথ্যা অনুসন্ধান করার দায় কারও নেই।
আমি নিজে সংবাদমাধ্যমের লোক। জানি উপর দিকে থুতু ছেটালে সেটা নিজের গায়েই আসে। তবু বলতে বাধ্য হচ্ছি, কিছু মিডিয়া যেভাবে প্রচার শুরু করে দিল যাতে মনে হতে পারে দুয়ারে কড়া নাড়ছে করোনা। আবার সেই মৃত্যুমিছিল শুরু হবে। অক্সিজেনের অভাবে চলে যাবে প্রাণ। পিপিই কিটে সজ্জিত হবে ডাক্তাররা। মাস্কে মুখ ঢাকবে সভ্যতা। অথচ আজ এই মুহূর্ত পর্যন্ত ১৩০ কোটির দেশে করোনা আক্রান্ত মাত্র ৩০০।
সংবাদ পরিবেশন করাই মিডিয়ার কাজ। এমন কোনও সংবাদ করা উচিত নয়, যাতে সমাজে আতঙ্ক তৈরি হয়। অতিমারীর মতো ভয়ংকর অধ্যায়ে খবর পরিবেশের চেয়েও সামাজিক দায়বদ্ধতা দেখানো বড় হয়ে ওঠে। মানুষকে সচেতন করা যেমন কর্তব্য, তেমনই কোনও সংবাদ যাতে তাদের রুটিরুজিতে আঘাত না করে সেটাও সমানভাবে ভাবা দরকার। করোনার অভিঘাত কতটা সাংঘাতিক তা আমরা তিন বছর ধরে বুঝে যাচ্ছি। লকডাউন অন্তত পঁচিশ-তিরিশ কোটি মানুষের জীবনে সরাসরি অর্থনৈতিকভাবে প্রভাব ফেলছে। তারা জীবনযুদ্ধে দুর্বল হয়ে গিয়েছে। কাজ হারানো, বেতনে কোপ, নতুন কাজ তৈরি না হওয়া, ব্যবসার মৃত্যু- ইত্যাদি নানা বিষয় সমাজে এতটা প্রভাব ফেলেছে যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জাতীয় অর্থনীতিও। অন্য ক্ষেত্র বাদ-ই দিই, মিডিয়ারও কম ক্ষতি হয়নি। সাংবাদিক-অসাংবাদিকের চাকরি চলে গিয়েছে। বেতন কমে গিয়েছে। বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট আটকে গিয়েছে। প্রোমোশন হয়নি। বহু মিডিয়ার অবস্থা হয়েছে শোচনীয়। সার্কুলেশন তলানিতে ঠেকেছে। বিজ্ঞাপনদাতারা পিছিয়ে যাওয়ায় আগামী দিনে সংকট আরও বাড়বে বই কমবে না।
বস্তুত এই পরিস্থিতি সর্বক্ষেত্রে। করোনাভাইরাস মানব জীবনে যা না ক্ষতি করেছে, তার চতুর্গুণ বেশি ক্ষতি করেছে সমাজে। তাই এখন আমাদের সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে। করোনা কতটা ক্ষতি করবে আমরা জেনে গিয়েছি। ভাইরাসকে মানুষ আর ভয় পায় না। পরিস্থিতিটা ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মতো নয়। সেদিন আমাদের কাছে করোনার কোনও উত্তর ছিল না। সংক্রমণ রোখার ক্ষমতা ছিল না। ওষুধ, ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি। অসহায় পরিস্থিতি ছিল বিশ্বে। মানবজাতি থাকবে কি না প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিয়েছিল। কিন্তু আজ তেমন অবস্থা নয়। মানুষ তাকে মোকাবিলা করেছে। মানুষ নিজেই বুঝেছে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তাকে সংকল্প দিয়ে পরাজিত করা যায়। সে আসে আবার চলে যায়। সব বন্ধ করে বাড়িতে খিল এঁটে বসে থাকা ভুল।
এই আতঙ্ক নিয়ে রাজনীতির বাজার বেশ সরগরম। নানা যুক্তি। কেউ বলছেন, সরকার ঠিকই করছে। আগাম প্রস্তুতি তো ভালই। অনেকের বক্তব্য, এই তৎপরতা অস্বাভাবিক। করোনা যখন এল, তাকে পাত্তা দেওয়া হয়নি। এখন দেশে করোনা নেই। হঠাৎ কী হল সরকার ঝঁাপিয়ে পড়ল। নিশ্চয়ই কারণ আছে। এই উদ্যোগ প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় কোনও ঢেউ আসার সময় দেখা যায়নি। ২০২১ সালে যখন তীব্র সংক্রমণের মধ্যে বাংলায় বিধানসভা ভোট হচ্ছে, তখনও নীরব ছিলেন কেন্দ্রীয় শাসক দলের নেতারা। গত বছর যখন ওমিক্রন হানা দিল তখনও তৎপরতা কিছুই ছিল না।
কংগ্রেসের অভিযোগ তাৎপর্যপূর্ণ। তারা বলছে, রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’-য় হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে ভয় পেয়ে গিয়েছে বিজেপি। গো-বলয়ে যাত্রা থামাতেই বিধিনিষেধ জারি করার চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে হিমাচল প্রদেশ ও দিল্লি কর্পোরেশন বিজেপির হাতছাড়া হওয়ায় তারা খুব চিন্তিত। রাজনীতির অঙ্ক যা-ই হোক, সবসময় ভিকটিম হয় সাধারণ মানুষ। ফলে করোনা নিয়ে আতঙ্কে সবাই দিশাহারা।এই প্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সাফ বলেছেন, করোনা এলে তার মোকাবিলা করতে রাজ্য প্রস্তুত। কিন্তু করোনা কোথায়? আগে আসুক। চিহ্নমাত্র না দেখে উৎসবে রাশ টেনে গরিব মানুষকে কেন সমস্যায় ফেলবে সরকার! হক কথা মুখ্যমন্ত্রীর। পরিশেষে একটাই কথা বলি, আর লকডাউন হবে না। সংক্রমণ খুব বেড়ে গেলেও নয়। কারণ লকডাউন সাধারণ মানুষ আর মানবে না। দিল্লি সেটা জানে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.