’২৪-এর বিধানসভা ভোট নিয়ে বিরোধীরা যে রাজনৈতিক অভিমুখে এগচ্ছেন, তা ইতিবাচক। কিন্তু কংগ্রেস যদি বিজেপিকে ‘প্রধান শত্রু’ না করে এ রাজ্যে তৃণমূল বিরোধী জোট করে, তবে তারাও জাতীয় স্তরে ‘একলা চলো’ নীতি নেবে। এদিকে, নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতার নাম থাকলেও ‘নির্দিষ্ট’ বিকল্প অবয়ব নেই। বিশ্লেষণে জয়ন্ত ঘোষাল
২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপুল জয়লাভের পর লিখেছিলাম- ’২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মোদি-বিরোধী জোটের প্রধান রাজনৈতিক ফালক্রাম হয়ে উঠবেন মমতা। এরপর গোয়া বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল পরাস্ত হলে সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলের কতিপয় বন্ধু-সাংবাদিক ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন- কী মশাই, আপনার ফালক্রামের কী হল এবার?
ইতোমধ্যে আমরা জেনে গিয়েছি, ২৩ জুন পাটনায় বিরোধীদের যৌথ বৈঠক হতে চলেছে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের পৌরোহিত্যে। রাহুল গান্ধী, কেজরিওয়াল থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়- বৈঠকে আসতে সম্মত প্রত্যেকে।
দ্বিতীয় বড় খবর হল, রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন হচ্ছে ৮ জুলাই। এই প্রেক্ষাপটে সর্বত্র আলোচনা একটাই- কী হবে ’২৪-এ? ভোটের বৈতরণি কি পার করতে সক্ষম হবেন মোদি? দ্বিতীয় প্রশ্ন, কর্ণাটকে কংগ্রেসের জয়লাভের পর এবার কি বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে?
কলকাতায় গিয়ে বেঙ্গল ক্লাবে এক বিচক্ষণ শিল্পপতির সঙ্গে প্রাতরাশের সুযোগ হয়েছিল। জাতীয় রাজনীতির খবর তিনি রাখেন হাতের তালুর মতো, আবার মমতার রাজনীতির ব্যাকরণও আয়ত্তে। তা, সেই মানুষটি বললেন- ’২৪-এর বিরোধী রাজনীতির প্রধান চরিত্র মমতা, তিনিই নির্ধারক শক্তি। তবে স্ট্র্যাটেজি বদলে ফেলেছেন। প্রসঙ্গত বলে রাখি, কংগ্রেস এখনও সর্বভারতীয় আভিজাত্যের (‘জলসাঘর’-এর ছবি বিশ্বাস সুলভ) মনোভাব থেকে বেরতে পারছে না। পশ্চিমবঙ্গে রাহুল গান্ধী মমতা-বিরোধী জোট গঠন করবেন, আর জাতীয় স্তরে চাইবেন মমতা নতমস্তকে কংগ্রেসের জমিদারি মেনে নিক- এও কি সম্ভব? তা, আমি সেই শিল্পপতিকে জিজ্ঞেস করি, তাহলে মমতার সাম্প্রতিকতম রণকৌশল কী? জবাব এল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে নেপথ্যে রেখে গ্রিনরুমে বসে কাজ করছেন।
আর-একটি বিশ্লেষণেও ‘কমন’ একখানি ভুল অনেকেই করছেন। বিশেষত হিন্দি সংবাদমাধ্যম। তাঁরা অনেকেই বলছেন, কর্ণাটকে কংগ্রেসের জয়লাভের পর মমতা না কি ইউটার্ন নিয়েছেন। ‘মমতাজি নে পল্টি মারা’। আগে তিনি বলেছিলেন, তৃণমূলের ‘একলা চলো রে’ নীতি। এখন বলছেন, কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতায় রাজি! এখানে ভুলটা কোথায় হচ্ছে জানেন?
সাগরদিঘি উপনির্বাচনে কংগ্রেস-সিপিএম-ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট জোট বেঁধে তৃণমূল কংগ্রেসকে পরাস্ত করে, তখনই মমতা বলেছিলেন, কংগ্রেস যদি এভাবে বিজেপিকে ‘প্রধান শত্রু’ না করে তৃণমূল-বিরোধী জোট করে, তবে তৃণমূলও জাতীয় স্তরে ‘একলা চলো রে’ নীতি নেবে। মমতা এই অবস্থানে এখনও কোনও বদল করেননি, যদিও বল এখন কংগ্রেসের কোর্টে। কংগ্রেসকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ২০২৬-এ রাজ্য রাজনীতির ভোট, কিন্তু তার আগে তো সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ’২৪-এর ভোট। সেখানে মোদিকে হঠানো সম্ভব হবে কি?
বিরোধী ঐক্য-রচনায় এই মুহূর্তে অন্যতম স্থপতি নীতীশ কুমার। কর্ণাটক ভোটে কংগ্রেসের অভূতপূর্ব জয়ের আগেই সোনিয়া গান্ধী ও নীতীশ কুমারের কথা হয়েছিল। সোনিয়া বুঝতে পারছেন, মোদি-বিরোধী জনমত ক্রমবর্ধমান। আবার কংগ্রেস একা যে ৫৪৩ আসনে লড়ার অবস্থায় নেই, সেটাও বিলক্ষণ সত্য। অতএব সখ্য গড়ে তুলতে হবে আঞ্চলিক দল ও নেতাদের সঙ্গে। রাহুলের সঙ্গে আঞ্চলিক নেতাদের এই সখ্যর রসায়ন কেন এখনও সহজ, স্বতঃস্ফূর্ত নয়, সে ভিন্ন আলোচনা। কিন্তু রাহুল রাহুলের কাজ তো করুন। নীতীশ, তেজস্বীকে নিয়ে আঞ্চলিক নেতাদের সঙ্গে জনসংযোগ কর্মসূচি গ্রহণ করুন। মমতা-শরদ পাওয়ার-কেজরিওয়াল প্রত্যেককেই সমানভাবে প্রয়োজন।
ভুলে গেলে চলবে না, বাংলার লোকসভা আসন ৪২। দিল্লিতে ৭। বিহারে ৪০। কিন্তু সেখানে জেডি (ইউ) আর আরজেডি দু’-দলের জোট। মমতা সাতবার লোকসভার সদস্য হয়েছেন। দিল্লির রাজনীতিতেও নবাগত নন। শরদ পাওয়ার সম্পূর্ণ সমর্থন করেন মমতাকে। পাওয়ার-সোনিয়া সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে অসহজ। কিন্তু মমতা-সোনিয়া সম্পর্ক আজও মধুর, আবার পাওয়ার-মমতা সমীকরণও ইতিবাচক।
দশ বছর ক্ষমতাসীন থাকার পরে মোদি জমানা অ্যান্টি-ইনকাম্বেনসির শিকার হবে না, এ তো হতে পারে না। এ হল প্রকৃতির সূত্র। ‘আরএসএস’-এর মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’-এ সম্পাদক প্রফুল্ল কেতকার সম্পাদকীয় লিখেছেন, শুধু মোদির জনপ্রিয়তা আর হিন্দুত্ব দিয়ে ভোটে জেতা যাবে না। মানে, ২০২৪ সালের ভোটে রাজ্যগুলোতে আর্থিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, জনকল্যাণ বড় প্রচারের বিষয় হবে।
সেপ্টেম্বর মাসে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে ছত্তিশগড়-মধ্যপ্রদেশে বিজেপির ফল ভাল হওয়া কঠিন। ২০১৯ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও উগ্র-জাতীয়তাবাদের আবহ ছিল। এখন পাকিস্তানের যা অবস্থা, তাতে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করার পরিস্থিতি কোথায়? আর, বিরোধীরাও আগের চেয়ে অনেক বেশি উৎসাহিত। কর্ণাটকে জয়লাভের পর কংগ্রেসও যেন রক্তের স্বাদ পেয়েছে! চিদম্বরম বলেছেন, মমতার প্রস্তাব আমরা মেনে নিতেও পারি। পশ্চিমবঙ্গ মমতাকে কার্যত ছেড়ে দিতে পারে কংগ্রেস। যদিও রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী অবশ্য এ প্রস্তাব মানতে নারাজ। আর রাজ্যে অধীরের মাথায় রাহুল গান্ধীর হাত।
কিন্তু চিদম্বরম যা বলেছেন তাতে সোনিয়া গান্ধীর প্রচ্ছন্ন সমর্থন আছে বলে মনে করছেন অনেকে। মমতা প্রথম থেকেই বলছেন, কংগ্রেস ২০০ আসনে লড়ুক। বাকি আসনগুলো কংগ্রেস আঞ্চলিক দলগুলোকে ছেড়ে দিক। আসন্ন বিরোধী বৈঠকে এই আলোচনা হবে। মোট ৫৪৩টি আসনের মধ্যে কতগুলো আসনে ১:১ আসন সমঝোতা করা যায়- সেটাই দেখা প্রয়োজন।
বিজেপি কি পরাভূত হবে? প্রথমত, সর্বভারতীয় স্তরে অবক্ষয় হলেও এখনও বিজেপির সবচেয়ে জনপ্রিয় মুখ মোদি। দ্বিতীয়ত, মোদির বিরুদ্ধে রাজ্যে রাজ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক নেতা রয়েছেন, কিন্তু কোনও বিকল্প অবয়ব নেই বিরোধী শিবিরে। নানা আঞ্চলিক দল মিলে জোট হলেও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন অনেকে। বলা বাহুল্য বিরোধী শিবিরকে ছত্রভঙ্গ করতে সাম-দান-দণ্ড-ভেদ সব কৌশলই প্রয়োগ করবে বিজেপি।
দুনিয়ায় এখন ‘গণতন্ত্র’-র নামে এক ধরনের নির্বাচিত একনায়কতন্ত্র পরিলক্ষিত হয়। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোও সেই অবক্ষয়ের শিকার। নাগরিক সমাজ দু’-হাত তুলে আত্মসমর্পণ করছে শাসক কর্তৃত্বর কাছে। সম্প্রতি তুরস্কের নির্বাচনে শাসকের বিরুদ্ধে তীব্র নাগরিক অসন্তোষ থাকলেও দেখা গেল, এরদোঁয়া আবার বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতাসীন। নরেন্দ্র মোদির বিকল্প চিত্র এখনও নজরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে কই?
(মতামত নিজস্ব)
লেখক বিশিষ্ট সাংবাদিক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.