প্রস্তাবিত ‘স্বাধীন’ প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের শীর্ষে কাকে বসানো হবে সেই নিয়ে আমেরিকা ইতিমধ্যেই অনেক নামের তালিকা করে রেখেছে। তবে যতক্ষণ না ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও গাজা স্ট্রিপের পুনর্মিলন হচ্ছে, আর ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইন-কে দু’টি পৃথক রাষ্ট্র হিসাবে মেনে নিয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে, ততক্ষণ এই দ্বন্দ্ব চলবে, চোরাস্রোতের মতো- এই আশঙ্কা স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের। কলমে অমিতাভ সেন
২০২০ সালের ২০ মে আব্বাস ঘোষণা করেন, ‘ওসলো চুক্তি মৃত এবং সমাহিত’। ইজরায়েল-প্যালেস্টাইনের সম্ভাব্য শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে আমেরিকার প্রচেষ্টায় জল ঢেলে দেওয়া ছাড়া একে আর কী বলা যেতে পারে! উল্লেখ্য, তার কয়েকমাস পরেই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন জো বাইডেন।
১৯৯৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনেরই উপস্থিতিতে সব ধরনের সন্ত্রাসমূলক ও হিংসাত্মক কাজকর্ম থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতিই শুধু নয়, ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন শান্তি চুক্তিতে সম্মতি জানিয়ে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে আগামীর ভাবী রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ‘প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন’-এর (পিএলও) চেয়ারম্যান ইয়াসের আরাফত। জাতীয়তাবাদী ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী আরাফত ছিলেন প্যালেস্তিনীয় রাষ্ট্রনায়ক তথা ‘আইকন’। তাঁর মৃত্যুর (১১ নভেম্বর, ২০০৪) পর ‘আরব লিগ’-এর সম্মতিক্রমে পিএলও-র প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মাহমুদ আব্বাস।
দায়িত্ব নেওয়ার পনেরো বছরের মাথায় আমেরিকা এবং ইজরায়েলকে দায়ী করে ২০২০ সালের ২০ মে আব্বাস ঘোষণা করেন, ‘ওসলো চুক্তি মৃত এবং সমাহিত’। ইজরায়েল-প্যালেস্টাইনের সম্ভাব্য শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে আমেরিকার প্রচেষ্টায় রীতিমতো জল ঢেলে দেওয়া ছাড়া একে আর কী বলা যেতে পারে! উল্লেখ্য, তার কয়েকমাস পরেই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন জো বাইডেন।
কিন্তু আব্বাসের এত ঝুঁকিপূর্ণ এবং কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ ঠিক কী? জবাবটা সম্ভবত লুকিয়ে আছে প্যালেস্টাইন সম্পর্কে ২০২২ সালের ২৭ অক্টোবর মার্কিন কংগ্রেসের পেশ করা একটি রিপোর্টে। কী রয়েছে সেই রিপোর্টে? বাইডেনের পূর্বসূরি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলা হয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি সুস্পষ্টভাবে প্যালেস্টাইনের তুলনায় অনেক বেশি ইজরায়েলের অনুকূলে ছিল। স্থগিত রাখা হয় প্যালেস্টাইনের জন্য আমেরিকান সাহায্য; জেরুজালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ও সেখানে একটি দূতাবাস খোলা হয়। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে বসবাসকারী ইজরায়েলিদের জন্য প্যালেস্তিনীয়দের তুলনায় অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধার ব্যাবস্থা করা হয়।
২০২০ সালের শেষ দিকে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি (ইউনাইটেড আরব এমিরেটস বা ‘ইউএই’) বাহরিন, সুদান ও মরক্কো এই চারটি দেশের সঙ্গে ইজরায়েলের সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যস্থতায় যে-চুক্তি হয়, ‘পিএলও’ এবং ‘পিএ’-র (প্যালেস্তিনিয়ান অথোরিটি) নেতৃত্ব তার বিরোধিতা করে। আশঙ্কা ছিল- এর ফলে প্যালেস্টাইন ও ইজরায়েল সম্পর্কের উন্নতির জন্য যেসব দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনা চলছে, তা নিয়ে আরব দুনিয়ার দেশগুলি নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে।
নিরাপত্তা পরিষদে রাষ্ট্রসংঘের মধ্যপ্রাচ্যের সমন্বয়কারী তাঁর ভাষণে ২০২২ সালকে ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘর্ষের ‘সবচেয়ে মারাত্মক বছর’ ঘোষণা করার অনেক আগে থেকেই- প্রস্তাবিত ‘স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র’ (স্পষ্টভাবে ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন’ ও ‘প্যালেস্টাইন অথোরিটি’) পরিচালনার শীর্ষনেতৃত্ব হিসাবে কাকে বসানো যায়- এই নিয়ে বাইডেন সরকারের ভাবনাচিন্তা শুরু হয়ে গিয়েছিল। সম্ভাব্য ‘বিকল্প’ নামের যে-তালিকা মার্কিন কংগ্রেসের কাছে পেশ করা রিপোর্টে দেওয়া হয়েছে, তাতে খুব স্বাভাবিকভাবেই রয়েছে বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নাম। শীর্ষেই। তবে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টে প্যালেস্তিনীয় নেতৃত্ব ও সে-দেশের গণতন্ত্রর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার কথা বলা হয়েছে। যে-তিনটি প্রশ্ন মার্কিন প্রশাসনকে ভাবাচ্ছে, সেগুলি হল-
১) কে শেষ পর্যন্ত মাহমুদ আব্বাসের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে?
২) আগামী দিনে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না এবং থাকলে কী-কী বিষয় ওই নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে?
(৩) ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে আইনের শাসন ও সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা সংক্রান্ত কোন-কোন সমস্যা রয়েছে।
এই মুহূর্তে প্যালেস্টাইনের যা পরিস্থিতি, তাতে ‘যুদ্ধোত্তর অবস্থা’ সামাল দিতে এমন মুখের সন্ধান চলছে, যার আন্তর্জাতিক স্তরে খ্যাতি না হোক, অন্তত পরিচিতি আছে। আব্বাসের পরে নাম রয়েছে শাসক দল ফাতা-র নেতা মারওয়ান বারঘউতির, যিনি মাঝে-মাঝেই ইজরায়েলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাকে এবং ইজরায়েলের বিরুদ্ধে অস্ত্র সংবরণের নীতিকে সমর্থন করতেন। ২০২১ সালে জাতীয় সংসদের নির্বাচনী প্রচারের সময় মতান্তরের কারণে তিনি আব্বাস-বিরোধী ভোটার তালিকায় নাম লেখান। বারঘউতিকে পিএলও বা পিএ-র শীর্ষে বসানোর পক্ষে সবচেয়ে বড় বাধা হল ২০০২ সালে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও গাজায় জমি দখলদারির বিরুদ্ধে প্যালেস্টাইনের ‘দ্বিতীয় বিদ্রোহ’ (ইন্তিফাদা) চলাকালীন একাধিক হত্যার দায়ে তিনি ইজরায়েলের জেলে অন্তরিন ছিলেন। অবশেষে ২০০৪ সালে দোষী সাব্যস্ত হন।
চর্চা চলছে মহামেদ দাহালানের নাম নিয়েও। তিনি আরাফতের অধীনে গাজার এক শীর্ষ নিরাপত্তা পদাধিকারী ছিলেন। বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে থাকেন। আপাতদৃষ্টিতে যেহেতু তিনি ইজরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে যুক্ত, তাই অনেকের ধারণা- ভবিষ্যতে যদি তাঁকে শীর্ষ পদে আনা যায়- তাহলে হয়তো প্যালেস্টাইন নানা বিষয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমর্থন পেতে পারে। আব্বাস-বিরোধী দাহালানের ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও গাজাতে কিছু রাজনৈতিক সমর্থন থাকলেও সামগ্রিকভাবে শাসক দল ফাতা-র নেতৃত্বের কাছে তিনি অবাঞ্ছিত ও জাতিচ্যুত। ২০১১ সালে আব্বাসের সঙ্গে মন কষাকষির পর তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তাঁর অনুপস্থিতিতে ‘প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল অথোরিটি’-র কোর্টে মানহানি, অপবাদ ও বিভিন্ন প্যালেস্তিনীয় প্রতিষ্ঠানকে অবজ্ঞা করার জন্য তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
দাহালান ছাড়া উল্লেখযোগ্য নামের মধ্যে রয়েছে প্রাক্তন কূটনীতিবিদ, যিনি সম্পর্কে আরাফতের ভাইপো, সেই নাসের আল-কুদয়া-র নামও। আব্বাস-বিরোধী কাজকর্মর জন্য ২০২১ সালে দল থেকে বহিষ্কৃত হন তিনিও।
এছাড়া ওই তালিকায় রয়েছেন ২০১৯ সাল থেকে পিএ-র প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন মোহাম্মেদ শাতায়েহ্ যিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এক পরিচিত ব্যক্তিত্ব। আরেক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সালাম ফায়াদ, দেশের মধ্যে যাঁর খুব কম সমর্থন থাকলেও আন্তর্জাতিক স্তরে পরিচিত মুখ। একই সঙ্গে নাম আছে আব্বাস-ঘনিষ্ঠ পিএ নেতা হুসেন আল-শেখের। আর আছে আব্বাসের সবচেয়ে বিশ্বস্ত নিরাপত্তা আধিকারিক মাজেদ ফারাজের নাম। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অভিজ্ঞতা না-থাকলেও দলের অভ্যন্তরে বিশ্বাসযোগ্যতা আছে, এমন যে-দু’জনের নাম ওই তালিকায় উঠে এসেছে তাঁরা হলেন- মাহমুদ আল-আলওউল এবং জিব্রিল রাজওউব।
প্যালেস্টাইনের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে যে-দু’টি বিষয়ের উপর আব্বাসের শীর্ষপদে বহাল থাকা বা না-থাকা অনেকাংশে নির্ভর করছে বলে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন তা হল: তাঁর বয়স এবং গাজা স্ট্রিপ- যেখানে তাঁর কোনও প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। আব্বাস নব্বই ছুঁইছুঁই। অন্যদিকে কয়েক বছর আগেই জাতীয় আইনসভার যে নির্বাচন হয়, তাতে সবচেয়ে শক্তিশালী বিরোধী দল হামাস (‘ইসলামিক রেজিস্ট্যান্স মুভমেন্ট’) গাজা স্ট্রিপে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। তখন থেকেই আব্বাসের গাজা স্ট্রিপের উপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে যায়।
কয়েক দিন আগেই চিনের প্রেসিডেন্ট ও কমিউনিস্ট পার্টির সর্বাধিনায়ক শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সান ফ্রানসিস্কোয় শীর্ষ বৈঠকের পর বাইডেন সাংবাদিকদের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, যতক্ষণ না ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও গাজা স্ট্রিপের পুনর্মিলন হচ্ছে- এবং ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইনকে যতক্ষণ না দুই পৃথক পৃথক রাষ্ট্র হিসাবে মেনে নিয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে- ততক্ষণ এই দ্বন্দ্ব চলবে- চোরাস্রোতের মতো। আদৌ কোনও নির্বাচন হবে, না কি পিএলও এবং পিএ পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে প্যালেস্টাইন এক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে, তার উপরেই নির্ভর করছে প্রস্তাবিত ‘নতুন প্যালেস্টাইন’-এর উপর আমেরিকার দখলদারি কতটা থাকবে, যেমনটা এখন আছে ইজরায়েলের উপর।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.