প্রশ্নটা তুলেছেন পদ্মা লক্ষ্মী। অন্তর্বাসশোভিতা, উন্মুক্তবক্ষা নিজের এক ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে। সেই মাতৃমূর্তি দেখে কত না ধিক্কার, কত না বাহবাও! কিন্তু, এই দেবীপক্ষে যাঁদের পূজা করব আমরা, তাঁদের মন্ত্রেও স্তনবর্ণনা অন্তহীন! তাহলে? উত্তর খুঁজতে পুরাণ-পথে হাঁটলেন অনির্বাণ চৌধুরী
এ বড় কূট জিজ্ঞাসা!
সম্প্রতি যার মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন বছর ছেচল্লিশের এক মা। নাম তাঁর পদ্মা লক্ষ্মী। পূর্ব পরিচয়ের রেখা ধরে এগোলে যাঁর সঙ্গে জুড়ে আছে প্রাক্তন মডেল এবং লেখক সলমন রুশদির প্রাক্তন-পত্নীর তকমাও!
তো, দিন কয়েক আগেই ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে নিজের একটি ছবি পোস্ট করে প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েছেন তিনি! সেই ছবিতে তাঁকে দেখা যাচ্ছে মোহিনী, লাস্যময়ী মূর্তিতে। পরনে শুধুই অন্তর্বাস!
এরকম এক মাতৃমূর্তি উপস্থাপনার জন্য যে সমালোচনার মুখে পড়তে হবে, সেটা কিন্তু বিলক্ষণ জানতেন এই মা! তাই সেই পোস্টেই লিখে দিয়েছিলেন তিনি- আমাকে ঘৃণা করো না! যদিও কিছু লোকে ঘৃণা করল, বাকিরা দিল বাহবা! আর, দেখতে দেখতে ট্রেন্ডিং খবরের শিরোনামে জায়গাও করে নিলেন পদ্মা লক্ষ্মী।
বেশ কথা! খ্যাতিলাভ, তা সে যে পথেই হোক, অন্তত এই যুগে সমাদরণীয়। সে কাজটি সেরে ঘৃণা-বাহবা-খ্যাতি সব কুড়িয়ে নিয়ে পদ্মা লক্ষ্মী তো ফিরে গেলেন তাঁর জীবনে।
আর প্রশ্নটা? সেটা কিন্তু পিছু ছাড়ল না।
সত্যিই তো, মায়েদের সেক্সি হতে বাধা কোথায়? অন্তত, ভারতের প্রাচীন সাহিত্য এবং মন্ত্রের দিকে যদি একটু উঁকিঝুকি দিই, তেমন নজিরই কিন্তু চোখে পড়বে। মা বলে যাঁদের আমরা সম্বোধন করছি, কেউ কিন্তু নিখাদ স্নেহময়ী, সংসারের দিকে তাকাতে গিয়ে নিজের প্রতি অমনোযোগী, আঁচলে তেল-হলুদ-মশলার দাগধরা, এলো খোঁপার মা নন! তাঁরা প্রত্যেকেই সৌন্দর্যতত্ত্ব এবং কামশাস্ত্রের বাঁধাধরা গতে সাক্ষাৎ যৌনপ্রতিমা! এই পদ্মা লক্ষ্মীরই মতন!
জগজ্জননী বলে যাঁকে চিনছি, যিনি আদ্যাশক্তি, সৃষ্টির কারণও বটে, সেই মহাদেবী পার্বতীর রূপবর্ণনা কেমন করে করছেন কবি কালিদাস? দেবীপক্ষে সেই দিকে ফিরে তাকালে দোষ কিছু হবে না। ‘কুমারসম্ভবম’ কাব্যের প্রথম সর্গেই পার্বতীর রূপবর্ণনা শুরু হয়েছে পায়ের নখ থেকে। ধীরে ধীরে শরীরের উপরের দিকে উঠছে কবির বর্ণনা। পায়ের নখ থেকে জঙ্ঘা বা ঊরু, তা সুগোল এবং মসৃণ! অতঃপর নাভি- ঈষৎ রোমাবলী সংযুক্ত সেই নাভিমূল এক রত্নের সমান! এর পরেই ৪০ নম্বর শ্লোকে এসেছে দেবী পার্বতীর নারীঅঙ্গের বর্ণনা- ”অন্যোন্যমুৎপীড়য়দ্যুৎপলাক্ষ্যাঃ স্তনদ্বয়ঃ পাণ্ডু তথা প্রবৃদ্ধম/মধ্যে যথা শ্যামুখস্য তস্য মৃণাল-সূত্রান্তরমপ্যলভ্যম”- ”কমলনয়না পার্ব্বতীর পরিবর্দ্ধমান স্তনদ্বয় পরস্পরে ঠেলাঠেলি করিয়া এতটাই বাড়িয়া উঠিয়াছিল যে, সেই পাণ্ডুবর্ণবিশিষ্ট ও কৃষ্ণ-বৃন্ত স্তন-যুগলের মধ্যে এমন একটু ফাঁকও ছিল না, যাহাতে অতি সূক্ষ্মতম এক সূত মৃণালের খেইও ঢুকিতে পারে।” নিঃসন্দেহে জগৎমাতারই স্তুতি করছেন কবি, কিন্তু সেই বর্ণনায় মাতৃভাব তেমন আছে কি?
এবার একটু চোখ রাখা যেতে পারে সীতার দিকে। হরণের পূর্বে তাঁকে এক ঝলক দেখেই কী বলছেন রাবণ? রাবণের বকলমে বাল্মীকি লিখেছেন সেই কথা- ”তোমার নাক-মুখ-চোখ এমনকী দাঁতগুলোও কী সুন্দর, সমান। তোমার জঘনদুটি স্থূল এবং বিস্তৃত, ঊরুদুটি করিশুণ্ড, স্তনদ্বয় তালফলের মতো, যেমন গোল, তেমনই সমুন্নত, তেমনই পরস্পর ঘন সন্নিবিষ্ট, জড়িয়ে ধরার জন্য যেন প্রস্তুত হয়ে আছে!” খেয়াল করুন, সারা ভারতভূমি যাঁকে মা বলে মেনে নিচ্ছেন, তাঁর প্রত্যঙ্গ বর্ণনা কেমন? না, দেখলেই জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে! এখানেও আমাদের সেই অতি পরিচিত মাতৃভাবটা কোথায়?
প্রতি যুক্তি আসতেই পারে, এঁরা সকলেই কবির বর্ণনায় ধারণ করেছেন শরীর! অতএব, এমন ভাবে মাকে দেখাটাও কবিদের বিকার! তাই যদি হয়, তবে একটু জোড় হাতেই মুখ তুলে তাকানো যাক দুর্গা, লক্ষ্মী আর সরস্বতীর দিকে। আর দিন কয়েক পরেই তো অঞ্জলি দেওয়ার সময়ে তাঁদের ধ্যানমন্ত্র উচ্চারণ করব আমরা। আর কী বলব দুর্গার সেই ধ্যানমন্ত্রে? ‘নবযৌবনসম্পন্না’ বলে সেই মন্ত্র শুরু হবে, শেষ হবে ‘পীনোন্নতপয়োধরাম’ বলে! অর্থাৎ, দুর্গা নবযুবতী, তাঁর স্তনদ্বয় আঁটোসাঁটো এবং উন্নত!
সরস্বতীর ধ্যানমন্ত্রের দ্বিতীয় ছত্রেই আমরা বলব, তিনি ‘কুচভারনমিতাঙ্গী’, স্তনদ্বয়ের ভারে ঝুঁকে পড়েছে তাঁর কায়া! আর, লক্ষ্মী? তিনি ‘ক্ষৌমাবদ্ধনিতম্বভাগললিতাম’! বেশ কষে পরা রেশমি শাড়িতে যাঁর নিতম্ব প্রকট হয়ে লালিত্য বৃদ্ধি করেছে! মা বলেই ডাকি তো এঁদের, তাই না?
যদিও প্রতিযুক্তি শেষ হওয়ার নয়। তর্কের খাতিরে বলা যেতে পারে, লক্ষ্মী-সরস্বতীর মা দুর্গা নন! তিনি গণেশ, কার্তিকেরও মা নন! সবাই তাঁর অংশজাত। গর্ভজাত কেউ নন! অতএব, সন্তানের জন্ম দেননি বলে তাঁর শরীরে তো যৌবনের দীপ্তি থাকবেই! তেমনই, লক্ষ্মী-সরস্বতীও সন্তানহীনা! কিন্তু, তার পরেও তাঁদের মা বলে ডেকে এই স্তন-নিতম্বের প্রশংসা করাটাকে কী ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? বা, লজ্জাগৌরীর মূর্তিকে? যাঁর মস্তকের স্থলে রয়েছে একটি পদ্ম, পা দুটি বিস্তৃত, যোনি উন্মুক্ত প্রসারিত এবং স্তনদ্বয় বর্তুলাকার! তিনিও তো মা, জগতের আধারস্বরূপা!
আরও এক দেবীর কথা এখানে না বললেই নয়! তিনি স্বয়ং রাধা! তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বর্ণনা যিনি করছেন, তিনি কিন্তু ভগবান! মথুরার হাটে যাওয়ার সময় পথ আটকে রাধার শরীরের মূল্য কেমন স্থির করলেন কৃষ্ণ? হিসেবটা কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত করা যাক- যুগ্ম শ্রীফলের মতো শ্রীমতীর দুটি স্তন- তেরো লক্ষ, সুন্দর ছিপছিপে কোমর- চোদ্দ লক্ষ, সুডৌল ঊরু- পনেরো লক্ষ আর সোনার কপাটকে লজ্জা দেওয়ার মতো উজ্জ্বল, প্রশস্ত নিতম্ব? তার মূল্য নির্ধারণ করলেন খোদ ভগবানই- চৌষট্টি লক্ষ! শ্রীকৃষ্ণের আহ্লাদিনীশক্তি, যিনি প্রায় মাতৃরূপাই, তাঁর এমন বর্ণনা?
এবার এই সব যুক্তির পথ আটকাতে পারে ভক্তি! বক্তব্য উঠতেই পারে, দেবীদের পক্ষে যা স্বাভাবিক, মর্ত্যের মানবী মায়ের পক্ষে তা নয়। তা, এই বক্তব্যকেই সঙ্গে নিয়ে আমরা যদি যশোদার দিকে তাকাই?
‘ভাগবত’-এর দশম স্কন্ধে যশোমতীর চমৎকার এক বর্ণনা দিয়েছেন ব্যাসদেব। সেখানে আমরা দেখছি, সকালে স্নান সেরে পরিপাটি করে সাজ করেছেন নন্দগৃহিণী। ওই সকালে হাজার ব্যস্ততা এবং কৃষ্ণকে খাওয়ানোর জন্য দধিমন্থনের মাঝেও খোঁপায় মালতী ফুল দিতে ভোলেননি সেই মা। তার পরে কী হল? না, দধিমন্থনের সময় কাঁপতে লাগল যশোদার ভারী নিতম্ব, তালে তালে খোঁপা থেকে খসে পড়ল সেই মালতী ফুল! একটু পরেই আবার দেখা যাবে বালক কৃষ্ণকে ধরার জন্য ধাওয়া করেছেন যশোদা, ছুটতে গিয়ে তাঁর বৃহৎ নিতম্ব ওঠা-নামা করছে- ”অন্যঞ্চমানা জননী বৃহচ্চল/চ্ছ্রোণীভারাক্রান্ত গতিঃ সুমধ্যমা!” পৃথিবীর কর্মব্যস্ত, স্নেহাতুরা এই মা লাস্যময়ী নায়িকার চেয়ে কম কীসে?
আসলে, মা যে এক নারী, তাঁরও যে আছে এক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব, সেটা আমরা খেয়ালই রাখি না! সেই স্বতন্ত্র অস্তিত্বের কথাটাই কিন্তু বার বার মনে করিয়ে দেয় এই রূপবর্ণনারা। যে দেবীদের আমরা মা বলে সম্বোধন করছি, তাঁরা প্রত্যেকেই নারীজাতির উদাহরণস্বরূপা! সেই নিয়মেই তাঁদের অঙ্গসংস্থানও অনির্বচনীয় হতে বাধ্য।
আরও আছে! মাতৃত্বের সঙ্গে স্তন্যদানের ধারণাটিও কোথাও একটা গিয়ে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। এবার যিনি সারা জগতের মা, তাঁর স্তনবর্ণনাও সেই জগৎব্যাপী শক্তিরই দ্যোতক! পদ্মা লক্ষ্মীর ছবিতেও সেই কুচযুগেরই জয়গান! মাতৃত্বের চিরন্তন প্রতীকের!
তাহলে?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.