২০০১ সালে পার্লামেন্টে হামলার পরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়। সাংবাদিকদের ‘পাস’ করে দেওয়া হয় সচিত্র। কমানো হয় প্রবেশকারী সাংবাদিকদের সংখ্যা। মিডিয়া উপদেষ্টা কমিটি তুলে দেওয়া, সাংবাদিকদের পাসের সংখ্যা কমানো, বিভিন্ন মিডিয়া সংস্থার মধ্যে রোটেট করে পাস দেওয়া– সিকিউরিটির এত শ্রীবৃদ্ধি সত্ত্বেও কেন সিঁধ কেটে বিপদ ঢুকছে সংসদ ভবনে? কলমে জয়ন্ত ঘোষাল
সদ্য হওয়া পার্লামেন্টের হামলার কাহিনি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল চিত্তরঞ্জন পার্কের ভবন কফি লাউঞ্জে। অবসরপ্রাপ্ত একজন অধ্যাপক শাহি দিল্লির অতীতের গপ্প শোনাচ্ছিলেন। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তিনি তখন। বাড়ি ফেরার পথে বন্ধুরা দল বেঁধে রাষ্ট্রপতি ভবন, নর্থ ব্লক, সাউথ ব্লকের সামনে লাল পাথরের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আড্ডা মারতেন। একদিন আড্ডার সময় হঠাৎ কোনও ভিভিআইপি-র কনভয় এসে গেল। বন্ধুরা চিৎকার করে বলে, ‘বগ্গি’ এসে গিয়েছে। পালা, পালা। এভাবে দৌড়ে রাস্তা পেরতে গিয়ে এক সতীর্থর হাতের বইটি পড়ে যায় রাস্তায়।
ওদিকে, ঘোড়ার শকটও থেমে গেল। পাগড়ি পরা এক নিরাপত্তাকর্মী নেমে বইটি তুলে ছাত্রটিকে ডাকল। ‘ভাগ কিঁউ রহে হো? কিতাব তো লেকে যাও।’ছেলের দল ফিরে এল। গাড়িতে উপবিষ্ট ভিভিআইপি বইটি নেড়েচেড়ে দেখলেন। দর্শনের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রের বই। বিশিষ্ট ব্যক্তিটি সে ছাত্রকে বললেন, ‘বই হল সরস্বতী। তাকে রাস্তায় ফেলে পালিও না।’
এর পর অধ্যাপকমশাই আমাকে বললেন, জানেন সেদিন ওই ভিভিআইপি-টি কে ছিলেন? তিনি ছিলেন তদনীন্তন রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন। সময় কত বদলে গিয়েছে! ১৯৮৭-তে প্রথম পার্লামেন্টে যাই। তখন রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু একদিন তিনি নিজেই জিপ চালিয়ে এলেন। আমরা দোতলার বারান্দা থেকে সে-দৃশ্য দেখে শিহরিত। কিছু দিন আগেও নর্থ ব্লক, সাউথ ব্লকে বিজয় চক এলাকায় সাধারণ মানুষ নিয়মিত হাঁটতে হাঁটতে রাষ্ট্রপতি ভবন পর্যন্ত চলে আসত। অগুনতি টু্যরিস্ট ছবি তুলত। সাংবাদিকদের ছিল অবাধ বিচরণ।
২০০১ সালে সংসদের উপর আক্রমণ হয়েছিল এরকমই এক ১৩ ডিসেম্বরে। ছজন পুলিশকর্মী, দুজন সাংসদের নিরাপত্তাকর্মী এবং এক মালি নিহত হন। পাঁচজন আক্রমণকারীকে নিরাপত্তাকর্মীরা মেরেও দেয়। সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৯। ১৮ জন গুরুতর জখম। লস্কর-ই-তইবা ও জইশ-ই-মহম্মদ এই আক্রমণের দায় স্বীকার করে।
এই ঘটনার পর সংসদের নিরাপত্তা আরও বেড়ে যায়। ভিতরে প্রবেশের কর্ডন বাড়তেই থাকে। নানা স্তর। নানা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। সাংবাদিকদেরও ‘পাস’ করে দেওয়া হল সচিত্র। সেই ছবি তুলে দিতেন সংসদের কর্মীরাই। মেটাল ডিটেক্টর। বিশেষ ধাতুর গেটগুলোর ভিতরে প্রবেশের সময় কম্পিউটার মাধ্যমে তৈরি কার্ডটি স্পর্শ করলেই সামনে বিরাট স্ক্রিনে সংশ্লিষ্ট প্রবেশকারী ব্যক্তির ছবি ফুটে উঠত।
মনমোহন সিংহ জমানা। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় স্পিকার। সেই সময় গাড়ির পার্কিং থেকে কীভাবে বহিরাগতদের গাড়ি বাইরে রাখা হবে, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। সাংসদ ছাড়া অন্য কারও গাড়ি ভিতরে থাকবে না। এমনকী, সরকারি অফিসারদের জন্য বরাদ্দ হয় সংসদের গেটের বাইরে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। সে-সময় লোকসভার স্পিকার ও রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের মিডিয়া পরামর্শদাতা কমিটি ছিল। তখন সে-কমিটিতে আমি সচিব। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বিভাগে প্রস্তাব পেশ হল– সাংবাদিকরাও আর গাড়ি নিয়ে আসতে পারবেন না ভিতরে। এমনকী, সাংবাদিকদের প্রবেশও কমাতে হবে। এতজন সাংবাদিক ঢুকলে নিরাপত্তার সমস্যা হয়। কমিটির বৈঠকে প্রতিবাদ জানালাম আমরা। রীতিমতো যুদ্ধ বেধে গিয়েছিল গোয়েন্দাদের সঙ্গে মিডিয়ার। আপনারা নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে ব্যর্থ হচ্ছেন, আর শুধু ‘টার্গেট’ করছেন মিডিয়াকে– এ কেমন কথা!
সাংসদের অতিথি হয়ে ঢুকে তাণ্ডব নৃত্য হচ্ছে। অথচ এখনও পর্যন্ত কোনও রিপোর্টারের ভুয়া পরিচয়পত্র নিয়ে সংসদে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেনি। নরসিংহ রাও যখন প্রধানমন্ত্রী, প্রেম পাল নামে এক ব্যক্তি গ্যালারি থেকে সংসদ কক্ষে ঝাঁপ মারেন। পরে ক্ষমা চান এবং তাঁকে শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দেওয়া হয়। এ ছিল ৯৪ সালের কথা। সেদিনও সেই ব্যক্তিকে কেন কঠোরতম শাস্তি দেওয়া হয়নি, তারও তদন্ত হোক।
এখন তো শুনলাম, মিডিয়া উপদেষ্টা কমিটিই তুলে দেওয়া হয়েছে। সাংবাদিকদের পাসের সংখ্যা কমে গিয়েছে। এখন বিভিন্ন মিডিয়া সংস্থার মধ্যে রোটেট করে পাস দেওয়া হয়। সেন্ট্রাল হল এখন পুরনো সংসদ ভবনের মিউজিয়াম। প্রবীণ সাংবাদিকদের সঙ্গে রাজনেতাদের আড্ডার পরিসরটুকুও অবলুপ্ত। নতুন পার্লামেন্ট নির্মাণের সময় নিশ্চয়ই নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে অনেক ভাবনাচিন্তা হয়েছে। এখন এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল বজ্র আঁটুনি, কিন্তু ফসকা গেরো।
চোর পালালে আমাদের বুদ্ধি আরও বাড়ে। তাতেও কোনও অন্যায় দেখি না। মানুষ তো ঠেকেই শেখে। একসময় তো ট্যুরিস্টরা কুতুবমিনারের চুড়োয় পর্যন্ত উঠত। ভিতরের সরু সিঁড়ি দিয়ে দেবানন্দ আর নূতন ‘তেরে ঘরকে সামনে’ ছবির ‘দিল কি ভ্রমর করে পুকার’ গাইতে গাইতে শুটিং করেন। তারপর কারও একটা ঝাঁপ দেওয়ার ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। সেই থেকে এখনও পর্যন্ত কুতুবউদ্দিন আইবক নির্মিত এই অলিন্দে পর্যটকের প্রবেশ নিষেধ। গ্যালারি থেকে ঝাঁপ দেওয়ার এই ঘটনাটি ঘটে ৯৬-তে, অথচ এখনও গ্যালারিকে বুলেট প্রুফ কাচ দিয়ে ঘেরা হয়নি। রাষ্ট্র সংঘের সাধারণ সভার দোতলা, তিনতলাও উন্মুক্ত। সেখানেও সাউন্ডপ্রুফ কাচের প্রাচীর নেই, এখনও। তবে এখনও পর্যন্ত সুরক্ষার কোনও বিঘ্ন ঘটেনি। কারণ বাইরে কঠোরতম নিরাপত্তা। মাছি পর্যন্ত গলতে পারে না।
এবার নিশ্চয়ই আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। গ্যালারিগুলোতে বসবে বুলেটপ্রুফ কাচের প্রাচীর। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা নিয়মিত ১০০-২০০ জনের টিম নিয়ে আসত সংসদ দেখতে। এবার জানি না, সেসবও কার্যত বন্ধ হয়ে যাবে কি না। পেপারলেস সংসদের পর এবার আমরা হয়তো দেখব ভিজিটর-লেস পার্লামেন্ট।
এবারের সংসদ হামলা কে বা কারা করেছে, তা নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। কমিটি হয়েছে। তদন্তের ফল আসার আগেই তদন্তমূলক প্রতিবেদনের ঝড় টিভি চ্যানেলে চ্যানেলে। কেউ বলছে নীলম নামের মহিলা কংগ্রেস করত। বলা হচ্ছে, কোনও মুসলিম সদস্য নেই। লস্কর বা খালিস্তানের স্লোগান নেই। অতএব এরা মূলত অতি বামপন্থী। ‘তানাশাহি নেহি চলেগা’ স্লোগানের মাধ্যমে মোদি-বিরোধী অসন্তোষ ব্যক্ত হয়েছে। কেউ কেউ আবার কোনও প্রমাণ ছাড়াই সোশাল মিডিয়ায় প্রচার চালাচ্ছে, এ হল গোয়েন্দাদের ‘মক সিকিউরিটি ড্রিল’– নিরাপত্তা ব্যবস্থার খামতিগুলো বোঝা ও তার জন্য এখনই আরও কড়া আরও নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা নেওয়া।
এই তদন্ত করার কোনও অধিকার আমার নেই। আমি গ্রাউন্ড জিরো-য় কর্মরত রিপোর্টারও নই। কে এই অপরাধমূলক কাজ করেছে, তার তদন্ত হোক। যে-ই করে থাকুক, দোষীদের শাস্তি দেওয়া হোক। আমার বিনীত প্রশ্ন– এত বড় নিরাপত্তার গাফিলতির জন্য কেউ কোনও দায়িত্ব নেবে না? সংসদের প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কি ইস্তফা দেবেন? কর্মরত পুলিশ ও নিরাপত্তাকর্মীদের কার কী দায়িত্ব ছিল, সেটা নিয়ে কেন কোনও প্রকাশ্য আলোচনা হবে না? দিল্লি পুলিশ সংসদ চত্বরের নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত। দিল্লি পুলিশ কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালের অধীনে নয়, বরং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অধীন। দিল্লির পুলিশ কমিশনার থেকে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই নিরাপত্তার এত বড় ব্যর্থতার কোনও দায়িত্বই নেবেন না? স্প্রে-র জায়গায় তো গুলিও চলতে পারত, সাংসদদের মৃত্যু হতে পারত। এই ব্যর্থতার দায় কার?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.