বাংলাদেশকে তিনদিক থেকে ঘিরে থাকা যে-ভারত, তাকে নিয়ে একটা আশঙ্কা থাকা নতুন তৈরি হওয়া দেশের পক্ষে খুব স্বাভাবিক। দাদাগিরি করতে-করতে একদিন আমাদের গিলে খাবে না তো– ওই দেশে জন্মালে, আমরাও কি ভাবতাম না? এই আশঙ্কায় কারা রাজনৈতিক ইন্ধন জোগাচ্ছে? লিখছেন নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়।
হুমায়ূন আহমেদের বহুপঠিত ‘বহুব্রীহি’ উপন্যাসে এক পোষা টিয়াপাখির প্রসঙ্গ আছে। অচেনা লোকজন দেখলেই সে মানুষের মতো চেঁচিয়ে বলে, ‘তুই রাজাকার! তুই রাজাকার!’ এতে বড়ই বিব্রত হন তার মালিক। না-পারেন উড়িয়ে দিতে, না-পারেন কাউকে উপহার দিতে। তবে ব্যাপারটা মজাদার নেই আর। রাষ্ট্রের প্রধান যদি মুখ ফসকে এমন কিছু বলে ফেলেন, যাকে কটুবাক্য মনে করেন অনেকেই, তবে কায়েমি স্বার্থ তো তার সুযোগ নেবেই! আগুন জ্বলবে দিকে-দিকে।
১৯৭২ সালে গৃহীত বাংলাদেশের (Bangladesh) সংবিধানের ২৯(১) ধারায় বলা ছিল, যে কোনও কাজের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের থাকবে সমান অধিকার। আবার ২৯(৩)(এ) ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্র চাইলে পিছিয়ে পড়া যে কোনও জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে, যাতে রাষ্ট্রের কাজে তঁারা নিয়োজিত হয়ে যথাযথভাবে স্বজাতির প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন। ১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সংরক্ষণের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। তবে, ১৯৭৫ সালের অাগস্টে, ‘বঙ্গবন্ধু’ মুজিব নিহত হওয়ার পরে রাষ্ট্রিক পরিবর্তনে সে-প্রস্তাব হিমঘরে চলে যায়। ১৯৯৬ অবধি তেমনই ছিল।
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়ে ‘মুক্তিযোদ্ধা’-দের সন্তানসন্ততির জন্য সংরক্ষণ চালু করলেন সেই প্রথম। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ হেরে গেল। মন্থর হয়ে এল সংরক্ষণের এই ব্যবস্থা। হাসিনা ফিরলেন ২০০৯ সালে, তার দু’-বছর পর থেকে যখন ফের কার্যকর হল সংরক্ষণের বিধি, তখন ‘মুক্তিযোদ্ধা’-দের নাতিনাতনিদের প্রতিও তা প্রযোজ্য হয়েছে।
২০১৮ সালে কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হল সংরক্ষণ বিধি তুলে দেওয়ার ব্যাপারটা। কোর্ট রায় দিল, সরকারের কাজ ভুল; ‘মুক্তিযোদ্ধা’-দের ছেলেপুলে নাতিনাতনি, প্রত্যেকে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষ! মনে পড়ে, আমাদের বড় হয়ে ওঠার দিনগুলি। ক্লাস নাইন; আমাদের দেশের স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের অনুষ্ঠানের মাঝখানে এক সহপাঠী চুপি-চুপি বলে, বাংলাদেশে কী সাংঘাতিক সব কাণ্ড হচ্ছে জানিস? শেখ মুজিব খুন, সেনা অভ্যুত্থান… বলছে রেডিওতে…! নিন্দুকরা কেউ কেউ বলল, এটা হওয়ারই ছিল। মুজিব নাকি ‘ডিক্টেটর’ হয়ে বসছিলেন, একদলীয় শাসন জারি করা থেকেই বোঝা যাচ্ছিল, ইন্দিরা গান্ধীর উসকানিতে একেবারে রাশিয়ার তঁাবেতে চলে যাচ্ছিল দেশটা…। মার্কিন মুলুক তো তক্কে-তক্কে ছিল দেশের মানুষের ক্ষোভে ইন্ধন জোগাবে বলে।
আমাদের কলেজবেলায়, নকশালি আমল যখন স্রেফ অতীত স্মৃতি, তখন বাংলাদেশের সমবয়সি অনেকেরই ধারণা শুনেছি, ওই ‘মুক্তিযুদ্ধ’-টাও নাকি জাস্ট অমনই, কিছু খ্যাপাটে মানুষের ভুলভাল লড়াই, বাঙালি-বাঙালি আবেগ নিয়ে যারা হেদিয়ে মরেছিল, এখন তারা সব হেজেমজে গিয়েছে! ‘ফুটল যেন কোথায় গোলাপ, মুজিব বলে ভুল করি’, গোপনে গোপনে এমন কবিতা ছাপানো কাগজ যেমন ঘুরত কারও কারও হাতে, তেমনই আমাদের অনেকেরই মনে হত– আমাদেরই মাতৃভাষায় কথা বলা একটা দেশ ক্রমে স্বনির্ভর হয়ে উঠছে, আন্তর্জাতিক আঙিনায় প্রত্যেকের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছে, সে তো ভালই!
বাংলাদেশকে তিনদিক থেকে ঘিরে থাকা যে-ভারত, তাকে নিয়ে একটা আশঙ্কা থাকা নতুন তৈরি হওয়া দেশের পক্ষে খুব স্বাভাবিক। দাদাগিরি করতে-করতে একদিন আমাদের গিলে খাবে না তো– ওই দেশে জন্মালে, আমরাও কি ভাবতাম না? ‘বিশ্বে আনবে নতুন দিন/ ইন্দিরা মুজিব কোসিগিন’– এই আবেগ বা নবলব্ধ স্বাধীনতার উচ্ছ্বাস দু’-তিন বছরেই ফিকে হয়ে এসেছিল দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির তাপে, নাকি শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তাও কমছিল। যে কোনও ক্রিয়ারই যে বিপরীত টান থাকে একরকম, সে তো আমরা অতি সাম্প্রতিক নানা ঘটনা লক্ষ করলেই বুঝতে পারি!
অনেক দিন ধরে ঝুলে থাকা তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে চুক্তি সফলভাবে সম্পন্ন হল ভারতের সঙ্গে। আমাদের দেশের প্রযুক্তিবিদরাই যাবেন কাজটা করতে। চিন উদ্গ্রীব হয়েছিল কাজটা করবে বলে; বঁাধের পাশে জলাধার ছাড়াও উপনগরী বানিয়ে দিতে তারা ছিল উৎসুক। আওয়ামী লীগের একটি অংশও শোনা যায়, চিনের সঙ্গে চুক্তি করতে আগ্রহী ছিল। যে কোনও ছোটখাট দেশে, সাহায্য করার ছুতোয় সুচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরনোর চৈনিক অভ্যাস আমরা জানি, কিন্তু বাংলাদেশের তো সেসব মনে রাখার দরকার নেই! ঋণ দেওয়ার পরে চিন কীভাবে তা সুদে-আসলে উসুল করবে, সে ভাবনা না-হয় পরের প্রজন্ম ভাবুক। জাপান, মার্কিন, অনেক ধনী দেশের সাহায্য বাংলাদেশ আগেও নিয়েছে, নিতে হয়েছে। ভারত তো ততখানি সাহায্য দেওয়ার অবস্থায় নেই! অগ্রজ প্রতিবেশী বলেই যেন সর্বদা সন্দেহভাজন হয়ে গালি খাওয়া তার নিয়তি। তবে এ-ও তো সত্যি, বাংলাদেশের প্রায় সব সমুদ্রবন্দর ভারত ব্যবহার করছে। চিন কি তা দেখছে না? উত্তর-পূর্বাঞ্চলে রেল যোগাযোগ স্থাপন করবে ভারত, শুধুই কি মালগাড়ি চালাবে? যাত্রীবাহী ট্রেন যদি সেনাবাহিনীর চলাচলে লাগে?
‘ধ্বনিটিরে প্রতিধ্বনি সদা ব্যঙ্গ করে, ধ্বনি-কাছে ঋণী সে যে, পাছে ধরা পড়ে!’ প্রবাদপ্রতিম এই কবিতা। আবার এ-ও তো ভাবার বিষয় যে, বাংলাদেশ সৃজনের কারণ হিসাবে আমরা, বাঙালিরাই হয়তো অকারণ অনেক বেশি আবেগ দেখিয়ে ফেলেছি! আমাদের দেশের সৈন্যরা ‘মুক্তিযোদ্ধা’-দের সঙ্গে কঁাধে কঁাধ দিয়ে লড়েছেন, আত্মবলিদান হয়েছে অনেক; উদ্বাস্তুদের প্রবল চাপ সহ্য করেছে ভারত, সব সত্যি; কিন্তু এ-ও যে সত্যি, যা ভাঙার, তা কোনও একদিন ভাঙবেই, প্রকৃতির নিয়মে। সাম্রাজ্যবাদী শাসক বিদায় নেওয়ার আগে দেশটা ভেঙে দিয়ে গেল। কৃষ্টিগতভাবে বাঙালি হিন্দু আর মুসলমান যে এক, একই উৎস থেকে সৃষ্ট; এই বোধ জাগ্রত হল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের শ্বদন্ত অনুভব করার পর, আরও বেশি করে। বাংলাদেশের মানুষকে তারা তো ঠিকঠাক ‘মুসলমান’ বলেই মনে করেনি! এরও বিপরীত ক্রিয়া কি দেখা যাচ্ছে না চলমান ঘটনাপ্রবাহে? কট্টর সাম্প্রদায়িক আবহটা যেন মানুষকে ধোঁকা দিয়েছে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করার জন্য।
(মতামত নিজস্ব)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.