Advertisement
Advertisement
Pakistan

পাকিস্তানের রথের রশি কার হাতে?

ইমরানের উপর হামলায় পাক রাজনীতিতে কী প্রভাব পড়বে?

Who is controlling Pakistan | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:November 5, 2022 12:21 pm
  • Updated:November 5, 2022 12:21 pm  

প্রকাশ্যে গুলিবিদ্ধ হলেন ইমরান খান। এই ঘটনায় পাকিস্তানের অভ‌্যন্তরীণ রাজনীতিতে কী প্রভাব পড়বে? পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালত বলেছে, দেশের আর্থিক সংকট যখন চরমে, তখন এভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতাকে নৈরাজ্যের পথে ঠেলে না দিয়ে যথোচিত ব‌্যবস্থা নিতে হবে। আপাতত সেনাশাসন প্রতিষ্ঠিত করে রাজনৈতিক সংকটের নিরসন হোক। তবে পাক সেনাপ্রধান কে হবেন, এই প্রশ্নটা সে-দেশে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তার চেয়েও উত্তেজক। কলমে জয়ন্ত ঘোষাল

 

Advertisement

পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান রোড শোয়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে বেশ কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত। এই আক্রমণের পর ইমরানের লং মার্চের ভবিষ‌্যৎ কী? পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়া-র এ মাসের শেষে ইস্তফা দেওয়ার কথা। তিনি ইস্তফা দেবেন, না কি এই পরিস্থিতিতে আপাতত তাঁকেই কাজ চালিয়ে যেতে বলা হবে? এই ঘটনা পাকিস্তানের অভ‌্যন্তরীণ রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে? বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ কি এবার আহত ইমরানের সঙ্গে কোনও সমঝোতায় যেতে পারেন? পাক সেনাবাহিনী কি ব‌্যর্থ শাহবাজকে সরিয়ে আবার ইমরান খানের সঙ্গে নতুন কোনও দৌত‌্য শুরু করতে পারে? পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালত বলেছে, দেশের আর্থিক সংকট যখন চরমে, তখন এভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতাকে নৈরাজ্যের পথে ঠেলে দেওয়া যাবে না। যথোচিত ব‌্যবস্থা নিতে হবে।

ঘর-পোড়া গরু তো! পাক আদালত যে সেখানকার সেনাবাহিনী দ্বারা কতটা নিয়ন্ত্রিত সে-কথা তো আমরা সবাই জানি। অতএব, এ অবস্থায় পাকিস্তানে আবার সেনাশাসনের সম্ভাবনাই কি ভবিতব‌্য? আদালতের যুক্তি হতে পারে, এই নৈরাজ‌্য আটকাতে আপাতত সেনাশাসন প্রতিষ্ঠিত করে ধীরে-সুস্থে রাজনৈতিক সংকটের নিরসন হোক। আদালত কী বলবে তার আগাম ভবিষ‌্যদ্বাণী করা যায় না। কিন্তু ভারতের বিচারব‌্যবস্থা সম্পর্কে অভিযোগ- ক্রমশ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ বাড়ছে। সংবিধান প্রদর্শিত ক্ষমতার ভারসাম্যের সাবেক ধারণার উপর আঘাত আসছে। তবু পাকিস্তানের বিচারব্যবস্থার উপর সেনা নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে ভারতের কোনও তুলনাই চলে না।

[আরও পড়ুন: ইউক্রেনে পরমাণু হামলা কি অনিবার্য?]

ইমরান খানের আততায়ীকে ঘটনাস্থলেই ধরে ফেলেন পাকিস্তান ‘তেহরিক-ই-ইনসাফ’ (পিটিআই)-এর এক সমর্থক। তাঁর দাবি, ইমরানের কন্টেনার ট্রাকের নিচে দাঁড়িয়ে ৯ এমএম পিস্তলে গুলি ভরছিল আততায়ী। তিনি আততায়ীর হাত ধরে বাধা দিতে গেলে পিস্তলের মুখ নিচু হয়ে গুলি চলে। সেই গুলি ইমরানের পায়ে লাগে। কারণ ওটি ছিল অটোমেটিক পিস্তল। আবার সিন্ধের প্রাক্তন গভর্নর ইমরান ইসমাইল ইমরান খানের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি সমনামী প্রত‌্যক্ষদর্শী। তাঁর বক্তব‌্য, আততায়ী একে-৪৭ ব‌্যবহার করেছে। তাই হাত থেকে কেড়ে নেওয়ার পরও গুলি চলতেই থাকে। একজন নিহত হয়। সভায় আরও কমপক্ষে ১৫ জন আহত হয়েছে। কীভাবে ঠিক আক্রমণটা হয়েছিল তার সুষ্ঠু তদন্ত যদি আদৌ হয়, তবে তা জানা যাবে। পাক গোয়েন্দাবাহিনী আইএসআই না করলেও, মার্কিন গোয়েন্দা এফবিআই এমনকী ভারতীয় গোয়েন্দারাও করবেন না, এমনটা হতেই পারে না। এ ব‌্যাপারে ইজরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’-ও সক্রিয় হবে।

আপাতত যেটা প্রশ্ন, এই আক্রমণ কোনও এক ব‌্যক্তির নিজস্ব অসন্তোষ, না কি এর নেপথ্যে অাছে গভীর ষড়যন্ত্র? যেমনটা অভিযোগ করছেন খোদ ইমরান খান। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তো বলেই দিয়েছেন এই ষড়যন্ত্রের পিছনে আছে তিনজন। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লা এবং আইএসআই প্রধান মেজর জেনারেল ফয়জল নাসির।

ষড়যন্ত্রের কথা বারবার আলোচনায় আসে, কারণ দেশটির নাম পাকিস্তান (Pakistan)। জনসভায় রাজনীতিকদের উপর আক্রমণ হানার ইতিহাস আছে সে-দেশে। এখন তো জনমাধ্যমে ফিরে ফিরে আসছে ২০০৭-এর ২৭ ডিসেম্বরের ভয়াবহ স্মৃতি। সেবার রাওয়ালপিণ্ডিতে নির্বাচনী প্রচারে গুলি ও আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত হন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানকে ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে হত‌্যা করা হয় একই শহরে। ২০০৮ সালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি আক্রান্ত হন। প্রাণে বেঁচে যান তিনি। বেনজিরের বাবা জুলফিকার আলি ভুট্টোকে তো ১৯৭৯ সালে এক সামরিক অভ্যূত্থানের পর ফাঁসি দেওয়া হয়।

ইমরান খানের ভবিষ‌্যৎ কী হবে তা আমরা এখনও জানি না। এটা বলতে পারি, তিনি ক্রিকেটার হিসাবে ছিলেন লড়াকু, আক্রমণাত্মক। পিচে টিকে শেষ বলটাতেও ছক্কা হঁকানোর একটা হিম্মত তো তাঁর মধ্যে আছে। ইসলামাবাদে গিয়ে তাঁর দল শহরকে অচল করে দেয়। তিনি ধরনায় বসেন। তিনি তখন বিরোধী নেতা। আমেরিকা ও পাক সেনাবাহিনীর পছন্দের। বীরবিক্রমে সেদিন তিনি নওয়াজকে ক্ষমতাচ্যূত করেন। সেই নওয়াজ এখন কখনও দুবাই, তো কখনও লন্ডন। ভাই ও সেনা-সাহায্যে দেশে ফিরতে তৎপর। আর ইমরান খানের প্রতিজ্ঞা– বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ‌্যগ্র মেদিনী।

পাক সেনাপ্রধান এবার কে হবেন, আসলে এই প্রশ্নটাই সে দেশে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন তার চেয়েও বড় প্রশ্ন। সম্প্রতি ইমরান প্রধানমন্ত্রী শরিফের সঙ্গে সেনাপ্রধানের পদপ্রার্থী নিয়ে আলোচনা করেন। সংবিধান অনুসারে প্রধানমন্ত্রী নাম দেন, প্রেসিডেন্ট সেনাপ্রধানকে মনোনীত করেন। শরিফের সঙ্গে ইমরান এ ব‌্যাপারে বোঝাপড়ার চেষ্টা করেন। শরিফ বলেন, আপনি আপনার নাম দিন, সরকার সরকারের নাম দিক। তারপর ঐকমত্যের ভিত্তিতে নাম চূড়ান্ত হোক। এসব শুনতে ভাল লাগে। আসলে জেনারেল বাজওয়া নিজে চারটি নাম দিয়েছেন। লেফটেন‌্যান্ট জেনারেল অসিম মুনির এঁদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র। আরও আছেন- লেফটেন‌্যান্ট জেনারেল আজহার আব্বাস, লেফটেন‌্যান্ট জেনারেল ফইজ হামিদ, শাহির শামশাদ মির্জা, মহম্মদ আমির ও জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া।

সম্প্রতি কামার জাভেদ বাজওয়া ওয়াশিংটন যান। সেখানে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিবের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়। এই সফরে পাক সেনাপ্রধানের নভেম্বরে অবসর নিয়েও নাকি কথা হয়। বাজওয়া এ সফরে সঙ্গে নিয়ে যান চিফ অফ জেনারেল স্টাফ আজহার আব্বাসকে। অনেকের ধারণা, আব্বাসকেই বসাতে চান তিনি। ইমরান খানের প্রার্থী জেনারেল ফইজ হামিদ। ইমরান প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ই নিজের পছন্দের আইএসআই প্রধানকে নিয়োগ করতে পারেননি। তা নিয়েই বাজওয়ার সঙ্গে তাঁর বিরোধ বাধে। নভেম্বরের এই ঘটনা পাক-রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলে সেটাই দেখার।

এদিকে, পাক অর্থনীতির সঙ্গিন অবস্থা। আইএমএফের ঋণ পাওয়া সবচেয়ে জরুরি। তার জন‌্য আমেরিকার সঙ্গে সখ‌্য বাড়াতে চাইছে ইসলামাবাদ। চিন-পাক অক্ষ যা-ই হোক, এখন প্রতিরক্ষা খাতেও মার্কিন অস্ত্র কিনতে হবে। বাইডেনের আমেরিকা আধুনিকীকরণ ঘটাচ্ছে পাকিস্তানের। যার ফলে ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর অসন্তোষ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, এই কারণেই ভারতকে রাশিয়ার কাছ থেকেও অস্ত্র কিনতে হচ্ছে। ভারসাম্যের কূটনীতি। জেনারেল বাজওয়া দুটো টার্মে ছিলেন। তবে আর এই পদে থাকবেন না, এ কথা তিনি আমেরিকায় গিয়ে ঘোষণা করে এসেছেন।

চিন-আমেরিকা ও ভারত এখন এই পরিস্থিতির দিকে কড়া নজর রাখছে। চিন ও আমেরিকার প্রভাব এখন পাকিস্তানের আসন্ন ভবিষ‌্যতের উপর পড়বে। জেনারেল বাজওয়া পাঞ্জাবি। তাঁর সঙ্গে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের একটা ‘ওয়ার্কিং’ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বাজওয়া ভারতের সঙ্গে আলোচনা আবার শুরু করতে প্রস্তুত। কিন্তু এখন পাকিস্তানের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধান যিনি-ই হোন, তিনি যদি বাজওয়ার লোক হন, তাহলে হয়তো নয়াদিল্লির জন‌্য ভাল। জেনারেল বাজওয়াকে যদি নতুন সেনাশাসন আপাঙ্‌ক্তেয় করে দেয়, তবে তা ভারতের জন‌্য ভাল হবে না হয়তো বা।

তবে কি এই ব‌্যর্থ শরিফ প্রশাসনকে সরিয়ে পাক সেনা ‘ক্যূ’ হবে আবার?সম্ভাবনা কম। কারণ পাকিস্তানে নির্বাচন আসন্ন। ২০২৩-এই ভোট। সেক্ষেত্রে সামরিক শাসনের বদলে সেনার মনোনীত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হতে পারে। জেনারেল জিয়া ও আসলাম বেগের পর জেনারেল বাজওয়া সবচেয়ে ক্ষমতাশালী সেনাপ্রধান ছিলেন। ভারত-ও মনে করে, বাজওয়া আফগানিস্তানে নয়া তালিবান সরকার গঠনের পর ভারতকে সাহায‌্য করেন কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণরেখায় সংঘর্ষ বিরতি বজায় রেখে। কাশ্মীরেও ২০১৬-র পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি চাননি এবং ৩৭০ ধারাকে মূলধন করে সন্ত্রাস বাড়ানোর পথে হাঁটেননি। বাজওয়া সেনাপ্রধান না থাকলেও তাঁর মনোনীত ব‌্যক্তি সেনাপ্রধানও প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। পাকিস্তানের এখন এমন অবস্থা- ভারতবিরোধী সন্ত্রাসের চেয়ে দেশের অভ‌্যন্তরীণ অবস্থা সামলানো বেশি জরুরি।

তাই দেখার বিষয়, এবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রথের রশি কার হাতে যায়? স্টিফেন ফিলিপ কোহেনের বিখ‌্যাত বই ‘দ‌্য আইডিয়া অফ পাকিস্তান’-এ লেখা সেই উক্তিটাই আবার মনে পড়ছে- পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যে-পথে চলে, সে পথেই চলে পাকিস্তান।

[আরও পড়ুন: থমকে ভারত-ব্রিটেন মুক্ত বাণিজ্যে, সুনাক কি সেই জট খুলতে পারবেন?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement