Advertisement
Advertisement

Breaking News

Conflict

সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের নেপথ্যে কারা? প্রিজমটা ঘুরিয়ে নাও

হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের গোলমেলে ধারণাগুলো চিরকালই আমাদের ভুল ভাবিয়েছে।

Who is behind the communal conflict?
Published by: Kishore Ghosh
  • Posted:May 26, 2024 9:36 pm
  • Updated:May 26, 2024 9:37 pm  

সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ভুক্ত ভারতবাসীর মধ্যে অধিকাংশের ধারণা, যাবতীয় দাঙ্গার মূলগত কারণ সংখ্যালঘু মুসলমান। অথচ, ইতিহাসে তদ্বিপরীত কিছু সাক্ষ্য প্রমাণ জ্বলজ্বল করছে। লিখছেন দেবাশিস পাঠক

বহু সম্প্রদায়-অধ্যুষিত ভারতে সাম্প্রদায়িক বৈরিতা কোনও নতুন বিষ নয়। বরং, একটি কালিক বিষয়। এবং তাতে অস্বাভাবিকত্বের লেশমাত্র নেই। সম্প্রদায় থাকলেই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষও থাকবে। শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী তঁার গুরু স্বামী বিবেকানন্দর কাছে এ বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে যে-জবাব লাভ করেছিলেন, সেটা এই প্রেক্ষিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী বলেছিলেন, ‘এমন যে উদার হজরত মহম্মদ (সঃ)-এর ধর্ম তার মধ্যেও ঢাকা শহরে দেখেছি, শিয়া সুন্নিতে লাঠালাঠি হয়।’ বিবেকানন্দর তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া, ‘সাম্প্রদায় হলেই এটা অল্পাধিক হবে’। সেজন্যই, তিনি বলেন, রামকৃষ্ণ মিশন ‘সম্প্রদায়বিহীনতা’-র আদর্শে বিশ্বাসী।

Advertisement

এহেন অতি স্বাভাবিক সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ভুক্ত ভারতবাসীর মধ্যে অধিকাংশের ধারণা, যাবতীয় দাঙ্গার মূলগত কারণ সংখ্যালঘু মুসলমান। অথচ, ইতিহাসে তদ্বিপরীত কিছু সাক্ষ্য প্রমাণ জ্বলজ্বল করছে। প্রাক্-স্বাধীনতা পর্ব হোক বা স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে, সব ক্ষেত্রেই মুসলমান সম্প্রদায়কে তাবৎ দাঙ্গার জন্য দায়ী করাটা অনৈতিক, অযৌক্তিক এবং সত্য সংস্রবহীন ধারণা।

ঔরঙ্গজেবের আমল থেকে শুরু করা যাক। ঔরঙ্গজেব সন্দেহাতীতভাবে গোঁড়া সুন্নি মুসলমান ছিলেন। কিন্তু, কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য, আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রাখার প্রণোদনায় তিনি যে হিন্দু-মুসলমানে বাছবিচার করতেন না, এটাও সমান সত্য। এই বক্তব্যের সপক্ষে দু’টি কাহিনি।

 

[আরও পড়ুন: লোকসভা ভোট চলাকালীনই বাড়ল সেনাপ্রধানের মেয়াদ]

সদলবলে সুবে বাংলায় যাচ্ছিল ঔরঙ্গজেবের বাহিনী। সেই বাহিনীতে হিন্দু রাজন্যবর্গের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। যাওয়ার পথে পড়ল কাশী। রাজাদের ইচ্ছা হল বিশ্বনাথ দর্শনের। রানিদের বাসনা, তঁারা সেই সুযোগে গঙ্গাস্নানও করবেন। সবার ইচ্ছা মেটানোর উদ্দেশে একদিনের জন্য তঁাবু পড়ল কাশীতে।

রাজমহিষীরা গঙ্গাস্নান করে বিশ্বনাথ দর্শন করলেন। বাহিনী ফের রওনা দিল বাংলার দিকে। কিন্তু যাওয়ার সময় অনেক খোঁজাখুঁজি করেও একজনকে পাওয়া গেল না। তিনি হলেন কচ্ছের রানি। কথাটা ঔরঙ্গজেবেরও কানে গেল। দিল্লি থেকে তিনি উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের পাঠালেন বিষয়টা তদন্ত করে দেখার জন্য।

তদন্তকারী রাজকর্মচারীরা কচ্ছের রানিকে ধর্ষিতা ও ক্রন্দনরতা অবস্থায় উদ্ধার করলেন মন্দিরে বিগ্রহের তলদেশে এক গোপন স্থান থেকে। মন্দির অপবিত্র হয়ে গিয়েছে নারী নির্যাতনের ঘটনায়। তাই বিগ্রহ অন্যত্র সরিয়ে ফেলে মন্দির ভাঙার নির্দেশ দেন মুঘল বাদশা। অর্থাৎ, হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষবশত নয়, প্রশাসক হিসাবে নিজের ভূমিকা অসমালোচিত রাখার প্রণোদনাতেই বিশ্বনাথ মন্দির ভাঙার, বিগ্রহ অপসারণের আদেশ দিয়েছিলেন ঔরঙ্গজেব। এবং সেই জনশ্রুতির কথা জনসমক্ষে এনেছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক হিন্দু ইতিহাসবিদ। নাম ড. বিশ্বম্ভরনাথ পাণ্ডে। তঁার ভাষ্যে এসব বৃত্তান্ত সেমিনার ইত্যাদিতে আলোচিত হলেও জনজীবনে হইচই ফেলে দেওয়ার মতো করে প্রকাশিত বা প্রচারিত হয়নি কোনও দিনই।
একইভাবে গোলকুন্ডার জামা মসজিদ ভেঙে ফেলার আদেশ দেন ঔরঙ্গজেব। অন্য কোনও কারণে নয়, একটা খবরের ভিত্তিতে।

খবর পেয়েছিলেন, দিল্লির কয়েক বছরের প্রাপ্য কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য গোলকুন্ডার নবাব তানাশাহ সেই অর্থ মাটির তলায় পুঁতে তার উপর মসজিদ তৈরি করেছেন। মাটিতে পেঁাতা টাকা উদ্ধারের জন্যই মসজিদ ভাঙার আদেশ দিতে ইতস্তত করেননি ঔরঙ্গজেব।

 

[আরও পড়ুন: ‘মোদি আবার মুখ্যমন্ত্রী হবেন’, মঞ্চে সগর্বে ঘোষণা নীতীশের, নয়া ছক?]

এসব কথা আমাদের পাঠ্যেতিহাসের বইয়ে কখনও লেখা হয়নি, ঠিক যেভাবে আমাদের পাঠ্য ইতিহাস বইয়ে হুমায়ুনকে লেখা বাবরের চিঠির কথা চির-অনুল্লেখিত একটি বিষয় হিসাবে রয়ে গিয়েছে। বাবর হুমায়ুনকে লিখেছিলেন, ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞ থেকো, কারণ তিনি তোমাকে বহু ধর্মবিশিষ্ট হিন্দুস্তানের বাদশাহ করেছেন। নিরপেক্ষভাবে সবার প্রতি ন্যায়-বিচার করবে এবং সকল ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি সমদৃষ্টি রাখবে।…
হালে এই যে অর্বাচীন হিন্দুত্ববাদীরা শিবাজি মহারাজকে ‘আইকন’ জ্ঞানে পূজা করে, তারা কি দেখাতে পারবে, তিনি নিজের জীবদ্দশায় একটাও মসজিদ ভেঙেছেন বা লুঠ করেছেন? পাশাপাশি, কোনও দিন নারী কিংবা কোরানের অসম্মান করেছেন? অথচ, তঁার মত ও পথে আস্থাশীল বলে যারা দাবি করে, তারা মসজিদ ভেঙে গর্ব প্রকাশ করতে অভ্যস্ত।

ঔরঙ্গজেব শাসক ও প্রজার সম্পর্ক-সমীকরণ বজায় রাখার প্রণোদনায় যেরকম হিন্দু মন্দির ভেঙেছেন, ঠিক একইভাবে শিবাজি মহারাজ অত্যাচারী শাসকের মোকাবিলা করার জন্য তরবারি তুলে নিয়েছিলেন। উভয়ের আচরণ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপ্রসূত, এমন কোনও কথা ইতিহাস লেখে না। এ ব্যাপারে, রামধারী
সিং ‘দিনকর’ তঁার ‘ভারতীয় সংস্কৃতির চার অধ্যায়’-এ যা লিখেছেন, তা বিশেষ উল্লেখের
দাবি রাখে। তঁার মতে, ‘যেহেতু অত্যাচারী শাসক ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছিলেন, সেহেতু লোকে অন্যায়ভাবে শিবাজি মহারাজকে সাম্প্রদায়িক বলে ধরে নিয়েছেন’।

হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের এই গোলমেলে ধারণাগুলো চিরকালই আমাদের ভুল ভাবিয়েছে। আমাদের বাঙালি সমাজের একাংশ যখন হিন্দু-হিন্দুত্বের বশে রামকে নিয়ে অতি আদিখ্যেতার প্রাবল্যে মুসলমানকে আমাদের জাতশত্রু ভেবে নেয়, তখন তারা ভেবেও দেখে না, বাংলা ভাষায় লেখা ‘পরাগলী মহাভারত’ আদতে হিন্দু মহাকাব্যের বঙ্গানুবাদ হলেও মুসলমান সমাজে তা ব্যাপকভাবে সমাদৃত ছিল। সংস্কৃত ভাষা থেকে অন্য কোনও ভাষায় ‘মহাভারত’-এর প্রথম অনুবাদ ‘পরাগলী মহাভারত’। অনুবাদকের নাম, কবীন্দ্র পরমেশ্বর। ষোড়শ শতকের চট্টগ্রামের বাসিন্দা। সংস্কৃতজ্ঞ বাঙালি কবি। তিনি হোসেন শাহর সেনাপতি ও চট্টগ্রামের শাসনকর্তা পরাগল খঁা-র সভাকবি ছিলেন।

সমসাময়িক লেখক সৈয়দ সুলতান জানাচ্ছেন, সে এমন একটা সময়, যখন একদিকে উগ্র ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বলে বেড়াচ্ছে– অষ্টাদশ পুরাণ আর রামায়ণ-মহাভারত যদি কেউ সংস্কৃত ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় পড়ে বা শোনে, তবে তার গতি হবে রৌরব নরকে। আর, ওদিকে আম মুসলিম জনতা, যারা কেবল বাংলাই জানত, তাদের ঘরে-ঘরে ‘পরাগলী মহাভারত’ পঠিত হচ্ছে। কেউই এই মহাভারতের কাহিনি শোনার সময় নিজেদের ঈশ্বর ও তঁার পয়গম্বরের কথা মনে রাখত না। অর্থাৎ, সেই জনচৈতন্য সমসাময়িক যুগেই বাঙালি রামকৃষ্ণর ‘যত মত তত পথ’ কথাটিকে বুকে গেঁথে নিয়েছিল।

এবার বাংলা নয়, কেরলের কথা। মালাবার উপকূল, আরব সাগরের তীর। সেখানেই কোড়ুঙ্গাল্লুর মন্দির। শোনা যায়, একদা ওটি ছিল জৈন সাধ্বীদের সাধনকেন্দ্র। সশস্ত্র হিন্দুরা সেটি আক্রমণ করল। কুৎসিত গালিগালাজ করতে করতে তারা হানা দিল সেখানে। মান আর প্রাণ বঁাচাতে সাধ্বীরা আক্রমণকারীর দল সেখানে পৌঁছনোর আগেই পালিয়ে যান। হিন্দু হানায় জৈন সাধ্বীদের সাধনকেন্দ্র বদলে যায় হিন্দু মন্দিরে। কিন্তু সেদিনের ওই ঘটনার রেশ মেলায়নি আজও। ফি বছর ওই মন্দিরে একটি অনুষ্ঠান হয়। ২৬ দিনের অনুষ্ঠান। বছরের ওই ২৬ দিনই মন্দিরটিতে অন্ত্যজদের প্রবেশাধিকার থাকে। বছরের অন্য দিনগুলোয় তাদের প্রবেশ ‘নিষিদ্ধ’। অন্ত্যজরা ঢোকে মন্দিরে, নোংরা গালিগালাজ করে জোরে জোরে, অপবিত্র বাতাবরণ তৈরি করে মন্দির চত্বরে। পুরো রীতিটাই অতীতের হিন্দু আক্রমণের স্মৃতি।

 

[আরও পড়ুন: জাতীয় দলের কোচ হতে বিশেষ ‘শর্ত’! বিসিসিআইকে কী জানালেন গম্ভীর?

পরিশেষে, এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অ্যালবামে, আরেকটা ছবি। যে-ছবি স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের। এবং যে-ছবিতে বোঝা যায়, ভারতে যাবতীয় দাঙ্গা মুসলমান বাধিয়েছে আর সেই দাঙ্গায় হিন্দুরা মরেছে, এমনটা ঘটেনি। হিন্দুদের হাতে হিন্দুরাও মরেছে, খানিকটা ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ হিসাবেই। ১৯৬৯-এ আমেদাবাদের দাঙ্গা। ঘটনাস্থল মৈমোবাই কি চাওল। আরএসএসের লোকজন মুসলমান মহল্লা আক্রমণ করেছিল। ওই মহল্লাতেই থাকতেন কল্যাণ সিং। রাজস্থানের শিকর জেলা থেকে কল্যাণ যখন আমেদাবাদে
পা রাখেন, তখন তঁার বয়স মোটে ১৫। ওই অঞ্চলের মুসলমান পরিবারগুলো কল্যাণকে সাহায্য করেছিল ব্যবসা গড়ে তুলতে। কল্যাণ ওখানে প্রতিষ্ঠা পেলে রাজস্থানের শিকর থেকে আরও ৬০-৭০টি পরিবার চলে আসে ওই মৈমোবাই কি চাওল-এ, জীবন-জীবিকার সন্ধানে। আরএসএস-এর লোকরা যখন দাঙ্গার সময় কল্যাণের কাছে জানতে চায়, কোনগুলো মুসলমানদের বাড়ি, বলল সেগুলো দেখিয়ে দিতে, কল্যাণ তাদের সাহায্য করেননি। ফলে, ওরা তাড়াহুড়ো করে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবার বাড়ি আর দোকানে আগুন লাগিয়ে দিয়ে চলে যায়। পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায় কল্যাণ সিংয়ের দোতলাবাড়ি, যে-বাড়ির একতলায় ছিল টায়ার-টিউবের দোকান। সেখানে প্রায় দেড় লক্ষ টাকার মালপত্র রাখা ছিল। হিন্দুত্ববাদীদের হানায় কল্যাণ সিংয়ের সারা জীবনের সঞ্চয় ভস্মস্তূপে পরিণত হয়।

আক্রমণকারীদের হুমকির মুখে দঁাড়িয়ে কল্যাণ সিং ভেবেছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘কেবল মুসলমান বলে ওদের বাড়ি দোকান আলাদা করে দাঙ্গাবাদদের চিনিয়ে দেব, যখন জানি তারা সর্বনাশ করতে এসেছে? উপরওয়ালার কাছে কী জবাব দেব?… আপনজন দেশের মুসলমানদের বাড়ি দোকান চিনিয়ে দেবার বদলে তাই বললাম, যা ইচ্ছা তোমাদের করো। আমি তোমাদের কথা মানব না।’ এরপর যা হওয়ার ছিল, তা-ই হয়েছিল।

কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত লিখেছিলেন, গোঁড়া ধর্মভীরু মানুষ যখন নিজের ধর্মের মধ্যে নিজের বিশ্বাসের মধ্যে পরধর্ম বিশ্বাসকে জায়গা দেয়, তখন তা সমন্বয়ের সুবৃহৎ নিদর্শন হয়ে ওঠে। এরপরেও কিন্তু সব মিলেমিশে নতুন কোনও ধর্ম তৈরি হয় না। হিন্দু হিন্দুই থাকে, মুসলমান মুসলমানই থাকে। কিন্তু মানুষ তার ধর্মমত নিয়ে উদগ্র উৎকেন্দ্রিক হয়ে উঠতে পারে না।

রাজনীতির কারবারিরা যাই-ই বলুন কিংবা করুন না কেন, লোকায়ত স্তরে এইভাবে থিতু হওয়ার সময় সমুপস্থিত।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement