‘টার্গেট’ পূরণের ব্যাপারে কর্পোরেট কর্তৃপক্ষর যুক্তি, ‘সেল’ না বাড়লে ‘গ্রোথ’ হবে না, কর্মীর ‘ইনক্রিমেন্ট’ হবে না, উল্টে চাকরিও চলে যেতে পারে। যার প্রতিফলনে অর্থনীতিতে ঝিমুনি আসবে। সেই কারণেই ঊর্ধ্বতনরা চাপ দেন অধস্তনকে, তাঁদেরও তো উপরতলা রয়েছে। ভব্যতাহীন ব্যবহার চুঁইয়ে পড়তে থাকে উপর থেকে নিচে। লিখছেন সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়।
বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় বিরোধী নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসেছিলেন। সেই সময় তঁার মোবাইল বেজে ওঠে। গুরুত্বপূর্ণ কল মনে করে তিনি ফোনটি ধরেন। অপর প্রান্ত থেকে বলে ওঠে, ‘আপনার কোনওরকম ঋণের দরকার? দরকার হলে বলুন, আমি ব্যবস্থা করে দেব।’ যা শুনে স্বভাবতই কিছুটা বিরক্ত হয়ে প্রণববাবু বলেছিলেন, ‘না না! আমি মিটিংয়ে আছি।’ তখন অন্যরা কার ফোন জানতে চাইলে বিব্রত কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ‘লোন দেবে’ বলে ফোন করেছিল। শুধু তা-ই নয়, ‘লোন নিন’ কিংবা ‘ক্রেডিট কার্ড নিন’ বলে অযাযিত ফোন তঁার কাছেও প্রতিদিন চার-পঁাচটি আসছে বলে সেদিন উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন প্রণববাবু। তা শুনে তখন মজা করে সুষমা স্বরাজ নাকি বলেছিলেন, ‘ওঁকে পাত্তা দিলেন না প্রণবদা! ভাবুন লোকটা কত বড় ভিআইপি, যিনি অর্থমন্ত্রীকে লোনের ব্যবস্থা করে দেবে বলছে।’ এই কথা শুনে অবশ্য প্রণববাবু নিজেও হেসে ফেলেছিলেন। তারপর ওই মোবাইল কল নিয়ে বৈঠকে বসা নেতা-নেত্রীদের মধ্যে কিছুটা হাসি-মশকরা হয়েছিল বলেই সাংবাদিক মহলে খবর ছড়িয়ে ছিল।
অযাচিত ফোন কলের সেই ট্র্যাডিশন এখনও অব্যাহত। সম্প্রতি জানা গিয়েছে, ব্যাঙ্ক লোন আর ক্রেডিট কার্ড দেওয়ার জন্য লাগাতার ফোনে রীতিমতো নাজেহাল হয়েছেন স্বয়ং কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি রাজশেখর মান্থা। কয়েক দিন আগে তিতিবিরক্ত হয়ে সরকারি কৌঁসুলিকে তিনি বিষয়টি জানান। এমনকী, নম্বর ব্লক করলেও অন্য কোনও নম্বর থেকে সেই একইভাবে ফোন আসছে, বিষয়টি রীতিমতো ‘হেনস্থা’-র পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে বলে জানান বিচারপতি। অর্থবর্ষ শেষ হওয়ার মুখে ব্যাঙ্কের এমন ফোনে রীতিমতো বিরক্ত সাধারণ গ্রাহকরাও। বছর শেষের আগে, বিশেষত বেসরকারি ব্যাঙ্কের টার্গেট পূরণের জন্য এই ধরনের ফোন কল খুব বেড়ে গিয়েছে।
আসলে ওসব ব্যাঙ্কের অসহায় স্টাফদের এই কাজ করতে হচ্ছে, কারণ উপরতলা থেকে চাপ আসছে। কয়েক মাস আগে একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্থ আধিকারিককে তার অধস্তন সহকর্মীদের সঙ্গে মিটিং করার সময় চরম দুর্ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছিল। ওই মিটিংয়ের ভিডিও ‘ভাইরাল’ হয় সামাজিক মাধ্যমে। ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিওতে দেখা গিয়েছিল, অভিযুক্ত আধিকারিক ব্যাঙ্কিং ও ইনসিওরেন্স প্রোডাক্টস ইত্যাদি বিক্রি করতে না-পারার জন্য তাঁর অধস্তন সহকর্মীদের উপর চিৎকার করার পাশাপাশি অশালীন ভাষায় আক্রমণও করছেন সেই আধিকারিক। ঘটনাটি দেখে গেল-গেল রব ওঠে। কিন্তু ঘটনাটি আদৌ নতুন কিছু বা ব্যতিক্রমী নয়। শুধু বেসরকারি ব্যাঙ্ক বলে নয়, বিভিন্ন কর্পোরেট অফিসেই বসের সঙ্গে মিটিং মানেই তো তটস্থ হয়ে থাকেন অধস্তন সহকর্মীরা। কারণ ‘মিটিং’-এ জানতে চাওয়া হয়, ‘টার্গেট’ কতটা পূরণ করতে পারা গিয়েছে। সেজন্য কতজনকে কতবার ‘ফোন’ করা হয়েছে বা কতবার ‘দেখা’ করা হয়েছে– সেটাও তো মিটিংয়ে জানতে চাওয়া হয়। ‘টার্গেট’ পূরণ হলে ভাল, নাহলে বসের তিরস্কার শোনাটাই স্বাভাবিক ঘটনা নয় কি? এক্ষেত্রেও ব্যাঙ্কের ওই কর্মীদের টার্গেট পূরণের যে-চাপ থাকে, তাতে এভাবে বারবার একই লোককে ফোন করাটা তাদের পক্ষে অস্বাভাবিক কিছু নয় বলেই মনে হয়।
তবে এটাও বুঝতে হবে, ‘টার্গেট’ পূরণ না-হলে তো আর ঊর্ধ্বতনরা তঁাদের অধস্তন কর্মীদের রাজভোগ খাওয়াবেন না। আবার যদি বস নরম প্রকৃতির হন, তাহলে নিচুতলার কর্মীদের মধ্যে একটা গয়ংগচ্ছ ভাব থাকবে। কর্মীরা বুঝে যাবেন, ‘টার্গেট’ পূরণ না করলেও চলবে, ফলে তঁাদের মধ্যে লক্ষ্যপূরণের তাগিদটা হারিয়ে যাবে। তখন তো সেই সংস্থা এমনিই উঠে যেতে পারে। এটাই তো গোটা দুনিয়ার নিয়ম। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই বাস্তব, যিনি লক্ষ্য পূরণ করতে পারবেন, তিনিই শুধু টিকে থাকবেন এই ইঁদুর দৌড়ে। তাছাড়া, এই ‘টার্গেট’ পূরণের ব্যাপারে ম্যানেজমেন্টের যুক্তি, ‘সেল’ না বাড়লে ‘গ্রোথ’ হবে না, কর্মীর ‘ইনক্রিমেন্ট’ হবে না, উল্টে চাকরিও চলে যেতে পারে। যার প্রতিফলনে অর্থনীতিতে ঝিমুনি আসবে। অর্থাৎ, অর্থনীতিতে গতি আনতে এটাই ভবিতব্য। ভাইরাল হওয়া ওই ব্যক্তি যেভাবে তঁার অধস্তনদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিলেন, সেই একই ঢঙে তঁাকেও তো তঁার বসের কটুকথা হজম করতে হয় প্রতিনিয়ত। আসলে এই লক্ষ্যপূরণের চাপও তো উপর থেকে নিচে বাহিত হচ্ছে।
অবশ্যই ‘টার্গেট’ পূরণ করতে হবে নিজেকে বঁাচানোর তাগিদে এবং সংস্থাকে বঁাচানোর তাগিদে। কেউ তা করতে না পারলে তার কপালে অদক্ষ তকমা জুটবে। তবে ভাবা দরকার– উপরতলার বেঁধে দেওয়া এই ‘টার্গেট’ কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে তেমনভাবে আলোচনার সুযোগ থাকে কি? পাছে প্রশ্ন করলে ম্যানেজমেন্টের কুনজরে পড়তে হয়, এই আশঙ্কায় বসের সামনে নিচুতলার কর্মীরা কোনওরকম প্রশ্ন করার সাহস দেখান না, উল্টে কেবলই বসের কথায় তালে তাল ঠোকেন।
অনেক সময় কর্মীদের মাধ্যমে এমন কিছুতে লগ্নি করতে বলা হয়, যা ওই গ্রাহকের বয়স, আয় এবং অবস্থার জন্য আদৌ উপযুক্ত নয়। তবু তা চলতে দেওয়া হচ্ছে ব্যাঙ্কগুলির মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজিতে। শুধু বিরক্তিকর ফোন করা-ই নয়, বহু ক্ষেত্রে ভুল বুঝিয়ে ভুল জায়গায় গ্রাহকদের লগ্নি করানো হয়। যেমন ফিক্সড ডিপোজিট বলে বিমা করিয়ে নেওয়ায় অভিযোগ রীতিমতো
শোনা যায়। এভাবে ‘মিসসেলিং’-এর জেরে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গ্রাহকরা। ব্যাঙ্কের ‘গ্রোথ’-এর কথা ভেবে ‘মিসসেলিং’ যে করা হচ্ছে, তা কি উপরের স্তরের ম্যানেজমেন্টের একেবারে অজানা? না কি বেশ কিছুটা মদত রয়েছে এই ব্যাপারে?
বলা হয়ে থাকে– প্রেম আর যুদ্ধে অন্যায় বলে কিছু নেই। কিন্তু যা পরিস্থিতি, তাতে বোধহয় বলতেই হয়– ব্যবসা আর বৃদ্ধির জন্য অন্যায় বলে কিছু নেই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.