বহির্দেশের সেনারা বুঝেছে, আফগানরা যুদ্ধে হারতে পারে, কিন্তু কখনও পরাজয় স্বীকার করে না। সমতলকে দখল করা যায়, কিন্তু পাহাড়কে কি প্রশমিত করা সম্ভব? মার্কিন এবং ব্রিটিশরা সবচেয়ে অকার্যকর রণকৌশলটি ব্যবহার করেছিল। তারা ভেবেছিল, ২০,০০০ ফুটের উপর থেকে তারা যুদ্ধজয় করবে। লিখছেন এম জে আকবর।
যেখানে যখনই সরকার বদলাক না কেন, আমার একটাই গল্প মনে পড়ে যায় বারবার। গল্পটা আমি শুনেছিলাম এমন একজনের কাছ থেকে, যাঁর রীতিমতো অভাব অনুভব করি আমি। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমা রাও। গল্পটা এরকম: ১৯৮২ সালে, সাংবাদিক মহলের উত্তর সম্পাদকীয় স্তম্ভ অনুযায়ী রাও এবং জ্ঞানী জৈল সিং ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতির দৌড়ে, একদম সামনের দিকে। পণ্ডিত রাজনীতিক হিসাবে রাওয়ের যোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল তাঁর প্রতিকূলে। অন্যদিকে, পাঞ্জাবের পরিস্থিতি তখন দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে। ধরেই নেওয়া হয়েছিল, সরকারের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার ফলে লাভবান হতে চলেছেন জ্ঞানী জৈল সিং। কোনও সিদ্ধান্ত তখনও গৃহীত হয়নি। কিন্তু জল্পনা ছিল তীব্র! জ্ঞানী একটি দীর্ঘ বিদেশ সফরে যাওয়ার আগে রাওয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। জানতে চাইলেন, শহর ছেড়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে সমীচীন হবে কি না। রাও ধীর, শান্ত এবং তীক্ষ্ণ স্পষ্টতায় তাঁর মার্কামারা উত্তরটি দিয়েছিলেন। জৈল সিংকে তিনি বলেছিলেন, ‘কিছু যায় আসে না। সে আপনি দিল্লিতেই থাকুন বা আন্টার্কটিকায়, যদি ইন্দিরা গান্ধী (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী) আপনাকে রাষ্ট্রপতি বানাতে চান, তাহলে পৃথিবীর যে কোনও প্রান্ত থেকে আপনাকে তলব করে নিয়ে আসবেন। আর যদি তিনি অন্য কাউকে রাষ্ট্রপতি করতে চান, তাহলে সারাদিন তাঁর বৈঠকখানায় বসে থাকলেও কোনও পার্থক্য হবে না।’ মনকে এভাবে শান্ত রাখার এই ফরমুলা এখনও কার্যকর।
১৮৩৯ সালে বেশ রাজসিক নামধারী একটি সেনাদল, ‘আর্মি অফ ইন্ডাস’ ব্রিটিশ ভারত থেকে রওনা দিয়েছিল কাবুলের উদ্দেশে, আফগানিস্তান (Afghanistan) দখল করতে। ব্রিটিশের লক্ষ্য ছিল, সিংহাসনে এক ক্রীড়নক সম্রাট বসানো। এভাবেই মধ্য এশিয়ার ক্ষমতার খেলায় জারশাসিত রাশিয়াকে পরাস্ত করতে চেয়েছিল ব্রিটিশরা। বৃহৎ শহর কাবুল, সেখানে ৫৮,০০০ মানুষের বসবাস ছিল, যাদের বেশিরভাগই পুরুষ, এবং ৩০,০০০ উট ছিল। কাবুলের মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, জয় তাদের হাতের মুঠোয়। আধুনিক গোলাবারুদে সমৃদ্ধ ছিল তারা। অনেক সেনাপতির কাছে বিষয়টা ছিল উপযুক্ত জলবায়ুতে বনভোজনের মতো। তারা তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। তাদের উটগুলো বহন করছিল পানীয় ও সিগার।
তিন বছর বাদে, ধরাশায়ী হওয়া ৩,৮০০ ভারতীয় সেপাইয়ের একটি দল, ৭০০ ব্রিটিশ সেনা ও আধিকারিক এবং ১৪,০০০ খিদমৎগার কাবুল থেকে পালাল, ভারতে ফেরার জন্য। সশস্ত্র গেরিলা জনজাতি, যাদের হাতে ছিল দশ টাকা দামের জিজেইল বন্দুক, তারা কচুকাটা করেছিল সেই পলাতক সেনাদের। বেঁচে গিয়েছিলেন কেবল ড. উইলিয়াম ব্রাইডন। কথিত আছে, তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল কেবল গল্পটুকু বলার জন্য। যেমন, এক আফগান সেনাপতি ব্রিটিশদের প্রশ্ন করেছিল সে বছর, আফগানিস্তানে আপনারা সেনা নিয়ে প্রবেশ করেছেন, কী করে বেরবেন ভেবে দেখেছেন?
লিখিত ইতিহাস মোতাবেক, আলেকজান্ডার থেকে শুরু করে ২০০১-এ মার্কিন অনুপ্রবেশ পর্যন্ত, বহির্দেশের সেনারা বুঝেছে, আফগানরা যুদ্ধে হারতে পারে, কিন্তু কখনও পরাজয় স্বীকার করে না। সমতলকে দখল করা যায়, কিন্তু পাহাড়কে কি প্রশমিত করা সম্ভব? মার্কিন এবং ব্রিটিশরা সবচেয়ে অকার্যকর রণকৌশলটি ব্যবহার করেছিল। তারা ভেবেছিল, ২০,০০০ ফুটের উপর থেকে তারা যুদ্ধজয় করবে।
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাদলের প্রত্যাবর্তন হতাশাজনক ও উদ্বেগজনক। তার কারণ, প্রায় সমগ্র আফগানিস্তানে দখল কায়েম করেছে তালিবানরা। তাদের মতাদর্শ কী, তা আমরা সকলে জানি। এই দু’দশকে যাবতীয় যা অর্জন হয়েছে, বিশেষত লিঙ্গসাম্যের লড়াইয়ে, তা আবার বিপন্ন হয়ে পড়ল। এটা ভাবা বোকার মতো কাজ হবে যে, তালিবানরা আবার তাদের দখলীকৃত আফগান ভূখণ্ডে মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেবে না। তারা তা করবেই, কারণ আদর্শগতভাবে এই কাজে তারা দায়বদ্ধ। হয়তো আমার মধ্যে কিছুটা অযৌক্তিক আশাবাদ কাজ করছে, কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ২০০১ থেকে আফগানিস্তানের প্রগতির জন্য যাঁরা লড়েছেন, রক্তাক্ত হয়েছেন, তাঁরা থেকে যাবেন, লড়ে নেবেন তাঁরা। তাঁদের জীবন ও আদর্শ- দুইই এখন ঝুঁকিপূর্ণ। ২০০১-এ মার্কিন সেনা যখন কাবুলে পৌঁছেছিল, তখন যদি যুদ্ধ শেষ না হয়ে থাকে, তাহলে ২০২১-এ তাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়ও যুদ্ধ শেষ হবে না।
সংক্ষেপিত, সৌজন্য: ‘ওপেন’
(মতামত নিজস্ব)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.