দেশের আমজনতার মধ্যে দেশাত্মবোধ যেমন রয়েছে, তেমনই গণতন্ত্রে বাস করে দেশের হালহদিশ জানার অধিকারও রয়েছে তাঁদের৷ জনগণ ও সরকারের মধ্যে যোগসূত্রই হল সংবাদমাধ্যম৷ গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ৷ কিন্তু সরকারই যদি সংবাধমাধ্যমের কন্ঠরোধ করার চেষ্টা করে তবে গণতন্ত্রের ধ্বজা উড়িয়ে কী লাভ৷ একদিন যদি সংবাদমাধ্যম বয়কট করে প্রশাসনকে, তখন কী হবে? গণতন্ত্রে এও তো সম্ভব৷ ব্যান-বয়কটের খেলায় আখেরে লাভ কার? সরকার বনাম সংবাদমাধ্যমের ছায়াযুদ্ধের ধারাবিবরণী করলেন শুভময় মণ্ডল
ননীগোপাল দাস। পাড়ায় আমরা চিনি ননীদা বলেই। রাজ্য সরকারি কর্মচারী ননীদার বরাবরের অভ্যেস সকালে ঘুম থেকে উঠেই খবরের কাগজে চোখ বোলানো। তারপর দেশ-বিদেশের হাঁড়ির খবর নিয়ে বাজারের থলে হাতে নিয়ে বেরনো। শুক্রবার, ১১ নভেম্বর অভ্যেসমতোই ঘুম থেকে উঠেই খুললেন খবরের কাগজ। কিন্তু খুন, জখম, ধর্ষণ, রাহাজানির একঘেয়ে খবর চোখে পড়লেও দেখা মিলল না কোনও কেন্দ্রীয় সরকারের খবর। আরে, আজ তো জিএসটি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন সিদ্ধান্তের কথা বেরনোর কথা ছিল। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনও পাতাতেই কেন্দ্রের খবর চোখে পড়ল না তাঁর। তাজ্জব! মোদির ছবিও কোথাও চোখে পড়ল না। কাল কি প্রধানমন্ত্রীর ছুটি ছিল না কি? এক পদ এক পেনশন নিয়ে খবর, মানবসম্পদ উন্নয়ন, রেলের যোজনা, কোনও কিছুই নেই। বাকি রোজকার যা থাকে সবই রয়েছে।
যাক গে, কাগজগুলো এইরকমই। দেরিতে সব ছাপে। এই বলে গজগজ করতে করতে টেলিভিশনটা চালু করলেন ননীদা। দেখা যাক খবরের চ্যানেলগুলো কী বলছে। পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়ল কি না, মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে সরকার কী করছে তা জানা দরকার। সবজিতে তো হাত দেওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু এখানেও এক কাণ্ড। পুরনো শত্রুতার জেরে বারাসতে খুন, রাজনৈতিক দলের লুডো কম্পিটিশন আয়োজন, ভারতীয় ফুটবলের বেহাল দশা, আবার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন পাকিস্তানের, এই ছেলেটা ভেলভেলটার নায়ক তিন নম্বর বিয়ে করছে, নাগিনের সাপ মানুষ হয়ে যাচ্ছে। ধূর ছাই, এসব জেনে কী হবে? এ তো রোজকার কড়চা। ননীদা যা চাইছেন তা জানতে না পেরে রিমোটটা প্রায় মাটিতে আছাড় মেরে বেরিয়ে পড়লেন বাজারের থলে নিয়ে। বাজারে দেখা হল পাড়ার সবজান্তা বিনোদের সঙ্গে। সঙ্গে লেটেস্ট টেকনোলজির স্মার্টফোন নিয়ে হেভি কেত মারে বিনোদ। এখন আবার আনলিমিটেড ফোর-জি ইন্টারনেটও রয়েছে। এই কি জিও না ফিও, ওই ফ্রি-এর মাল নিয়ে রংবাজি। কিন্তু ব্যাটা সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের খবর রাখে। তাঁকেই শুধোলেন ননীদা। বল না ভাই, ‘মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সরকার কোনও সিদ্ধান্ত নিল?’ বেশ কিছুক্ষণ ফেসবুকে বিভিন্ন নিউজ পোর্টাল ঘেঁটে বিনোদ বলল, ‘না ননীদা। তেমন কোনও খবর করেনি দেখছি কেউ। তবে দেবের একটা নতুন সিনেমা আসছে, সেখানে আবার ওঁর চাইনিজ হিরোইন।’ ধুত্তোর এই চাইনিজ-চিলি চিকেন জেনে কী লাভ। নিরাশ মনে বাজার থেকে ফিরে ভাবতে বসলেন ননীদা। কী ব্যাপার, কেন্দ্র কী ধর্মঘট ডেকেছে না কি? গতকাল কি কোনও খবরই হয়নি। তাহলে কি মোদি ৫৬ ইঞ্চি ছাতি নিয়ে বৃহস্পতিবার দিনভর কোথাও বের হননি। কেন্দ্রের কি তবে ছুটি ছিল। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ফের টিভি চালিয়ে থ’ হয়ে গেলেন ননীদা। জনৈক হিন্দি সর্বভারতীয় নিউজ চ্যানেলে একটি লেখা জ্বলজ্বল করছে। কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তে, ২৪ ঘণ্টার জন্য বন্ধ করা হয়েছিল ওই চ্যানেলের সম্প্রচার। সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরব হয়ে জনমত গঠন করার কথা বলছে চ্যানেল কর্তৃপক্ষ। হিসাব করে ননীদা দেখলেন, বুধবার মধ্যরাত থেকে বৃহস্পতিবার মধ্যরাত পর্যন্ত বন্ধ ছিল সম্প্রচার। তার মানে কী…
বুঝতে আর অসুবিধা হয়নি ননীদার। কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সব মিডিয়া এককাট্টা হয়েছে। মানে, ইটের বদলে পাটকেল দিয়েছে তারা। একদিনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের সবরকম খবর সম্প্রচার, প্রকাশ বন্ধ রেখেছে সব মিডিয়া। তাই তো খবরের কাগজ, নিউজ চ্যানেল, ডিজিটাল নিউজ ওয়েবসাইটগুলিও সেই পথে হেঁটে বয়কট করেছে কেন্দ্রকে। গোটা বিষয়ে মনে মনে একটু হাসিই পেল ননীদার। সেইসঙ্গে খানিক রাগও হল তাঁর। পাল্টা জবাব দেওয়ার অধিকার সবারই রয়েছে গণতন্ত্রে। তাই বলে, ইটটি মারলে পাটকেল খাওয়ার জন্যও তৈরি থাকতে হবে সরকারকে। সংবাদমাধ্যম তো জনগণকে অবগত করার জন্যই। সেই সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ কেন করতে গেল সরকার? কী লাভ হল তাতে? মিডিয়ার জবাব দেওয়ার স্টাইলকে প্রশংসা করে আর কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তকে শাপ-শাপান্তর করে ব্যাজার মুখে অফিসের পথে হাঁটা দিলেন ননীদা।
উপরোক্ত গোটা ঘটনাই কাল্পনিক। তবে দেশের মিডিয়া যদি কেন্দ্রকে এইভাবেই পাল্টা জবাব দেওয়ার পথে নামে। পাঠানকোট হামলার খবর করার সময় এনডিটিভি ইন্ডিয়া না কি কেবল টিভি নেটওয়ার্ক রেগুলেশন আইন ভেঙে সন্ত্রাসদমনের সরাসরি সম্প্রচার করেছে। তাই আইনের বিধান, একদিনের জন্য সম্প্রচার বন্ধ থাকবে ওই চ্যানেলের। আর সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই গর্জে উঠেছে দেশের অন্যান্য সংবাদমাধ্যম। সেই জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা গান্ধীর সরকার এইভাবে সংবাদমাধ্যমের কন্ঠরোধ করেছিল, এমনই অভিযোগে সরব সবাই। সেই কালা দিন ফিরে আসছে বলে কেন্দ্রর নিন্দায় মুখর সব মহল। কিন্তু রাজকার্যে বাধা দিতে নাই। তাই সংবাদমাধ্যমও যদি একদিনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে বয়কট করে তবে? যাদের ভর করে মোদি ক্ষমতায় এলেন তারাই যদি এবার বয়কট করে তাঁকে। ঠেলা সামলাতে পারবেন তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহাশয়? ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। সেখানে সংবাদমাধ্যমের সম্প্রচারের বিধিনিষেধ থাকতেই পারে। তবে তা আলোচনা সাপেক্ষ। কিন্তু তড়িঘড়ি একদিনের জন্য সম্প্রচার বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা আরও একবার ভেবে দেখা যেত। স্ফুলিঙ্গ দাবানলের রূপ নিতে বেশি সময় নেয় না। সরকার বনাম সংবাদমাধ্যম কখনওই কাম্য নয়। তবে সেই পরিস্থিতি তৈরি হলে আখেরে কোনও পক্ষেরই ক্ষতি বই লাভ হবে না।
মতামত লেখকের নিজস্ব
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.