ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টুইট করে জানান, মায়ানমার-ভারত সীমান্তে চালু ‘ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম’ বন্ধ করা হবে। গ্রহণ করা হবে না মায়ানমারের শরণার্থীদের। এদিকে মায়ানমারের সঙ্গে ভারতের পূর্ব প্রান্তের দুই রাজ্য মিজোরাম-মণিপুর, বিশেষত মিজোরামের আত্মিক সম্পর্ক বহু দিনের। মিজো সরকারও চায় মোলায়েম থাক দু’-দিকের যোগাযোগ। লিখছেন স্যমন্তক ঘোষ।
”আপনি তো ইন্ডিয়ান সিগারেট খান। একটা আমাদের সিগারেট খেয়ে দেখুন।” ভরসন্ধ্যায় আইজলের হোটেলের নিচে এমন প্রস্তাব শুনে খানিক চমকেই যেতে হয়েছিল। বছর তিরিশের হোটেল কর্মচারী বলে কি! মিজোরাম (Mizoram) কি ‘ইন্ডিয়া’-র বাইরে না কি? সাংবাদিকের সন্দেহ বুঝতে সময় লাগেনি ছেলেটির। একগাল হাসি নিয়ে জবরদস্ত ইংরেজিতে পরের বাক্য, ‘‘আমরা এখানে মায়ানমারের (Mayanmar) সিগারেট খাই। সব দোকানে পাওয়া যায়। সস্তায় পুষ্টিকর। এবার যে কী হবে কে জানে!’’
মাস দুয়েক আগের কথা। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ (Amit Shah) টুইট করে জানিয়েছেন, মায়ানমার-ভারত সীমান্তে যে ‘ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম’ (এফএমআর) চালু আছে, তা বন্ধ করা হচ্ছে। এফএমআর এখনকার বিষয় নয়, দীর্ঘদিন ধরে ভারত-মায়ানমার সীমান্তে এই নিয়ম চালু। এর ফলে ভারতের দিক থেকে স্থানীয় মানুষ মায়ানমারের একটি নির্দিষ্ট এলাকা পর্যন্ত ঢুকতে পারে; তবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। একইভাবে মায়ানমারের সীমান্তবর্তী মানুষ ঢুকতে পারে ভারতে।
কেন কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্ত? ঐতিহাসিকভাবে ভারতের মিজোরাম-মণিপুর ও মায়ানমারের চিন-রাখাইন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে এক ধরনের জনজাতিগত সম্পর্ক আছে। এই অঞ্চলের মানুষের দাবি, তারা বৃহত্তর চিন-কুকি-জো জনজাতির অন্তর্গত। ফলে, তারা একে-অপরের জনজাতিগত ভাইবোন। এই নিয়ে ব্রিটিশ আমলেও কম আলোচনা হয়নি। গাদা-গাদা বই লেখা হয়েছে, গবেষণা হয়েছে, প্রশাসনিক বৈঠক হয়েছে। বিশ শতকের গোড়ায় খাস কলকাতা শহরে চিন-লুসাই কনভেনশন হয়েছে। যদিও সেই কনভেনশনে না ছিল চিনের প্রতিনিধি, না লুসাইয়ের। তৎকালীন রেঙ্গুনের (এখন মায়ানমার) এই দুই এলাকার ব্রিটিশ প্রশাসনিক আধিকারিকরা যোগ দিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট কনভেনশনে। এবং সেখানেও বর্তমান ভারত-মায়ানমার সীমান্তের চিন-কুকি-জো জনজাতির মানুষদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধার কথা বলা হয়েছিল। তাদের পারস্পরিক যোগাযোগ যাতে অটুট থাকে, তা নিয়ে একাধিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
ইতিহাসের এই জটিল কচকচানি থেকে ফেরা যাক বর্তমানে। মোদ্দাকথা, চিন-কুকি-জো জনজাতির জো-রা এখন বসবাস করেন মিজোরামে, কুকিরা মণিপুরের পাহাড়ে আর চিন মায়ানমারের চিন প্রদেশ বা রাজ্যে। মায়ানমারের এই প্রদেশের অবস্থান মণিপুর এবং মিজোরাম সীমান্তে। ব্রিটিশদের পথ ধরেই স্বাধীন ভারতে উত্তর-পূর্ব সীমান্তের জনজাতি-অধ্যুষিত অঞ্চলের জন্য কিছু বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়েছিল। এফএমআর তেমনই এক ছাড়। সীমান্তের দু’-দিকে যাতায়াতের ছাড়।
দু’-দিকের একই জনজাতির মানুষের মধ্যে স্বাধীনভাবে মেলামেশার ছাড়। মিজোরাম-মণিপুরে এখনও এমন অনেক পরিবার আছে, যারা মায়ানমারে প্রতিবেশী গ্রামে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। মায়ানমারের মেয়ে মিজোরামে বউ হয়ে এসেছে, এমন ঘটনাও ব্যতিক্রম নয়। আর, এই দ্বিপাক্ষিক আদানপ্রদানের হাত ধরেই মায়ানমারের সিগারেট ঢুকছে মিজোরামে। মিজোরামের ওয়াশিং পাউডার ঢুকে যাচ্ছে মায়ানমারে। মিজোরাম চিবোচ্ছে মায়ানমারের সুপারি, আর মায়ানমার খাচ্ছে মিজোরামের চা।
এসবই সামাজিক স্বাভাবিকতা। রাষ্ট্রের স্বভাব স্বাভাবিকভাবেই আলাদা। সেখানে রাজনীতি আছে, কূটনীতি আছে,আছে ক্ষমতাতন্ত্রের খবরদারি। আর, সেই নীতি মেনেই ২০২১ সালে একরাতের মধ্যে আন সাং সু কি-র গণতান্ত্রিক সরকারকে বিতাড়িত করে মায়ানমারের সিংহাসন দখল করে সেনা। শুরু হয় সেনা জুন্টার শাসন। যার বিরুদ্ধে পথে নামে মায়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী মানুষ। হাজার-হাজার আন্দোলনকারী গ্রেপ্তার হয়। নিহত হন অগুনতি। চিন প্রদেশ আর লুসাই পাহাড়ের গা বেয়ে মিজোরাম-মণিপুর-নাগাল্যান্ডে ঢুকতে থাকে মায়ানমারের হাজার-হাজার শরণার্থী। সবচেয়ে বেশি মিজোরামে। খেয়াল রাখতে হবে, সে-সময় মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা। এই জোরামথাঙ্গা একসময় বৃহত্তর মিজোরাম আন্দোলনে প্রথম সারির আন্ডারগ্রাউন্ড নেতা ছিলেন। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিপ্লবের ডাক দিয়েছিল তঁার সংগঠন। সেই প্রথম দেশের ভিতর কোনও আন্দোলন স্তব্ধ করতে বিমানবাহিনীর সাহায্য নিতে হয়েছিল ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার। বোম মেরে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা মিজোরাম।
কালক্রমে আন্দোলন বন্ধ হয়েছে, মূলস্রোতের রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন জোরামথাঙ্গা। সেই জোরামথাঙ্গাই ২০২১ সালে মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন, দ্বিতীয়বারের জন্য। ভারত সরকার নোটিস দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, তারা মায়ানমারের শরণার্থীদের গ্রহণ করবে না। পাল্টা বিবৃতিতে জোরাম জানান, ‘‘মায়ানমার থেকে যারা মিজোরামে এসে আশ্রয় নিচ্ছে, তারা আমাদের ভাইবোন। আমি প্রথমত মিজোরামি, তারপর ভারতীয়। সুতরাং, মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শরণার্থীদের জায়গা দেবই। ভারত সরকার যা-ই বলুক না কেন।’’
২০২১-’২৪ সালের পরিসংখ্যান বলছে, শুধুমাত্র মিজোরামেই মায়ানমারের শরণার্থীর সংখ্যা ৩০ হাজারেরও বেশি! ‘ইন্ডিয়ার সিগারেটে’ লম্বা টান মেরে হোটেলের ওই কর্মচারী যুবক সামান্য কাশল। ‘ইন্ডিয়ার সিগারেট একটু কড়া। আমাদের সিগারেট অনেক বেশি স্মুদ।’ মোলায়েম ছিল দু’-দিকের যোগাযোগও। যুবকের মামাবাড়ি মায়ানমারের চিন প্রদেশে। মামা মারা গিয়েছেন। ভাই গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনকারীদের বিদ্রোহী সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। সপ্তাহে একবার মামির সঙ্গে দেখা করে আসে হোটেলের সেই কর্মচারীটি। প্রয়োজনীয় বাজার পৌঁছে দেয়। সীমান্ত বন্ধ হয়ে গেলে কী হবে? ছেলেটি বলছে; আর সাংবাদিকের মনে পড়ছে তিন বছর আগে দেখা এক মুখ। সাংবাদিকের স্টোরিতে যার নাম হয়েছিল ‘লৌহমানবী’। মায়ানমারে জুন্টা শাসন চালু হওয়ার পর মিজোরামের থিংসাই সীমান্তে উন-লাই-চোইয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল এই সাংবাদিকের। এক ত্রাণশিবিরে। চোই মিজোরামে স্কুলশিক্ষিকা।
প্রেম মায়ানমারের চিন প্রদেশের এক শিক্ষকের সঙ্গে। কিন্তু সেনাশাসন শুরু হওয়ার পর সেই প্রেমিক শিক্ষকতা ছেড়ে বিদ্রোহী সেনায় যোগ দিয়েছে। সে কমান্ডার পদে। মেলায় কেনা বাইনোকুলারে চোখ লাগিয়ে আদিগন্ত অপেক্ষায় সেই নারী। সাংবাদিকের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তার প্রথম বাক্য ছিল, ‘আমাকে নিয়ে যাবে প্রেমিকের কাছে? আমি গর্ভবতী। যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে তাকে এই সংবাদটি দিতে চাই। আমার সন্তানের নাম রাখব বিদ্রোহ।’ চোইয়ের সঙ্গে সীমান্ত পার করে বেশ অনেকটা পথ গিয়েছিল সাংবাদিক। তাকে তুলে দিয়েছিল প্রেমিকের পাঠানো বুলেটাহত এক উইন্ডশিল্ডহীন পিক-আপ ট্রাকে। চোইয়ের ফোন নম্বরও নিয়েছিল সাংবাদিক। কিন্তু কোনও দিন আর তাকে ফোনে পায়নি।
চোই অথবা হোটেলের ওই যুবকের মতো হাজার-হাজার ক্রসবর্ডার কাহিনি ছড়িয়ে আছে গোটা চিন-লুসাই পাহাড়ে। সীমান্তে কঁাটাতার বসলে, এফএমআর বন্ধ হয়ে গেলে, কী হবে তাদের? এই মানুষগুলি না বোঝে রাষ্ট্র, না বোঝে কূটনীতি। কেউ পৌঁছতে চায় প্রেমিকের কাছে, কেউ মামির দেখভালের উপায় নিয়ে উদ্বিগ্ন। এই এফএমআর উদ্বেগ নিয়েই ২০২৪ সালে ভোটের বুথে যাবে মিজোরাম। অসুস্থতার কারণে গত ফেব্রুয়ারিতে সাংবাদিকের সঙ্গে দেখা করেননি জোরাম। দেখা করেছেন তঁার বরাবরের ডানহাত এবং মিজোরামের প্রাক্তন উপ-মুখ্যমন্ত্রী তনলুইয়া। বৃহত্তর মিজো বিপ্লবের সময় তিনি ছিলেন আন্ডারগ্রাউন্ড সরকারের সেনাপ্রধান। অশীতিপর বৃদ্ধের এখন ক্যানসারের চিকিৎসা চলছে। সাংবাদিকের চোখে চোখ রেখে একটাই কথা বললেন, ”নিজের জাতির জন্য একসময় রক্ত দিয়েছি। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। এই বুড়ো বয়সেও রক্ত দিতে ভয় পাই না। ইন্ডিয়ার সরকার যতই এফএমআর বন্ধ করুক। আমরা মানছি না। এই শর্তেই এবারের ভোট হবে।”
‘ইন্ডিয়া’ উচ্চারণটা একটু বেশিই কড়া শোনাল বৃদ্ধের মুখে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.