উর্মি খাসনবিশ: ছাত্রজীবনে লোকের ভাল করার জন্য রাজনীতি করা উচিত, এই পন্থায় তীব্র বিশ্বাসী একজন জুনিয়রকে তাঁর সিনিয়র বলেছিলেন, “রাজনীতি সমাজসেবা নয়। ক্ষমতার জন্যও তো লড়াই করতে হবে। ক্ষমতার আসনে বসতে হবে।” “ক্ষমতা পেয়ে কী হবে দাদা?” প্রশ্নের উত্তরে ধমক ভেসে আসে। “এই জন্য তোদের মতো বাচ্চাদের সিটিং দিই না। ক্ষমতা পেলে মানুষের ভাল করা যাবে।” “সে তো সমাজসেবার মাধ্যমেও করা যায়”, প্রত্যুত্তর জুনিয়রের। “কিন্তু সমাজসেবা আর দয়া একই বস্তু হয়ে গেল নাকি ? বেসিক উন্নতি কী হবে? সমাজসেবা করে তুই মহান হতে পারবি। যাঁদের উপকার করবি, তাঁদের আখেরে কী লাভ?” আবার প্রশ্ন সিনিয়রের। এবার ভাবনা জুনিয়রের। রাজনীতি এবং সমাজসেবা যে এক নয়, তার স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু ক্ষমতা আর ইডিওলজির সমীকরণ নিয়ে ফের ধোঁয়াশা। ক্ষমতার জন্য তো মানুষে মানুষে লড়াই হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। সোজাসাপটা যুদ্ধ চলার ঘটনা ইতিহাসের পাতায় অমলিন। তবে আবার নতুন করে বিশেষ রাজনৈতিক ভাবধারা আপন করে নেওয়া কেন? “উফ এত প্রশ্ন কেন শুনি? শোন তোকে যদি বলে মানুষ মারার রাজনীতির মাধ্যমে দেশে পরিবর্তন আসবে, সেই রাজনীতি করবি? “বিরক্তিসূচক প্রশ্ন ভেসে আসে সিনিয়রের থেকে “কী আশ্চর্য! তা করব কেন?” থতমত খেয়ে জুনিয়র বলে দিল। “একটি নির্দিষ্ট ডিসিপ্লিন মেনে আমরা জীবনযাপন করি। ডিসিপ্লিনটাই আমাদের বেঁধে রাখে। এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। সেই বিশেষ ডিসিপ্লিন যাঁরা মেনে চলেন তারাই কমরেড। তাঁদের সঙ্গে আমাদের মতের মিল থাকবে। আমরা নির্দিষ্ট কারণকে সঙ্গী করে একসঙ্গে লড়ব। অনেক সময়, অন্যান্য পন্থা এবং ভাবধারায় বিশ্বাসী মানুষও কোনও বিশেষ ইস্যুকে কেন্দ্র করে লড়াইয়ে আমাদের সঙ্গী হবে। ‘কমন মিনিমাম’ বিষয়টিকে জাস্টিফাই করবে” বিনা ভণিতায় উত্তর আসে সিনিয়রের তরফ থেকে।
ক্ষমতার গল্প রাজনীতিতে আসবেই। ক্ষমতার জন্যই নাকি রাজনীতি। সমাজসেবা নয় মোটেই। যদিও সেই ক্ষমতার সাহায্যে মানুষের উপকার এবং রাষ্ট্রের তথাকথিত শোচনীয় অবস্থার পরিবর্তনই মূল লক্ষ্য। কিন্তু সিনিয়র যখন জুনিয়রটিকে রাজনীতির বেসিক বোঝাচ্ছে, চিনে নিতে শেখাচ্ছে কমরেডদের, বোঝাচ্ছে ‘কমন মিনিমাম’ কী, তখন জুনিয়রের মাথায় রাজ্য-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ঘটে চলা বেশকিছু সাম্প্রতিক ঘটনার কোলাজ কটাক্ষের হাসি হেসে ঘোরাফেরা করছে। ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে থেকে যে রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি, যে আদর্শে বিশ্বাস করে দেশের একদল মানুষ জনসেবা করার দাবি করছেন এবং স্বপ্ন দেখছেন, সেই দলই নাকি তাসের ঘরের মতো ভাঙতে বসেছে ক্ষমতার লড়াইকে কেন্দ্র করে। জুনিয়রের প্রশ্ন জাগে, “সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস দলের রাজনৈতিক ভাবনা-চিন্তা ঠিক কী তা নিয়ে নিজেকে এবং অপর রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিদেরও প্রশ্ন করে বিশেষ সুরাহা মিলছে না কেন?” প্রশ্ন জাগে, কেন গত কয়েকদিন ধরে কংগ্রেসের রাজনৈতিক যাপন নিয়ে একটু নাড়াঘাটা করলে, চায়ের কাপের তলানিতে যেই শব্দটা ঠেকছে তার নাম “ক্ষমতা”। ব্যক্তিবিশেষের ক্ষমতা। পলিটিকাল কেরিয়ারকে জাস্টিফাই করার প্রবল চেষ্টা।
সবংয়ের ভূমিপূত্র দীর্ঘদিনের কংগ্রেসি রাজনীতি ছেড়ে যখন ঘাসফুলের গান গাইছেন, তখন জুনিয়রের প্রশ্ন জাগে, “ওঁর লজ্জা করল না এই কাণ্ড ঘটাতে?” আর এক সিনিয়র উত্তরটি দিলেন। বললেন, “কত বয়স হয়েছে ওঁর। এখনও যদি একটা মন্ত্রিত্ব না পায়, তবে পলিটিকাল কেরিয়ারটা দফারফা হয়ে যাবে যে”। আবারও প্রশ্ন জেগেছে, পলিটিকাল ইডিওলজি, মানুষের সেবা, কমরেডদের সাথ দেওয়ার ব্যাপারটি কি গুরুত্বহীন? আবারও তীক্ষ্ণ উত্তর, “আপনি বাঁচলে বাপের নাম”!
রাজনৈতিক ভাবধারার হাত ধরে রাজনীতি করতে আসা, কমরেডদের সঙ্গে দেওয়াল, পোস্টার লেখা, একসঙ্গে মুড়ি-সিঙাড়া খাওয়া- সবটাই শুধু ক্ষমতার মুখ চেয়ে দূরে ঠেলে দেওয়া যায়? যেখানে নিজস্ব চিন্তাও সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত, মানুষের ভাল করা বা সমাজসেবামূলক কাজকর্ম কি আদৌ সম্ভব? প্রশ্নগুলো জুনিয়রের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
সিনিয়র হালকা চালে যতই রাজনীতির গঠনমূলক বৃত্তান্ত নিয়ে আলোচনা করুক, জুনিয়র বুঝতে পারছে, আসলে রাজনৈতিক ইডিওলজির ডিজাইন করা কার্পেটের ভিতর সেই প্রাগৈতিহাসিক ক্ষমতার গল্পই লুকিয়ে রয়েছে। সময় আর পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে শুধু তথাকথিত সমাজসেবা আর কমরেড-কমরেড খেলার অবসান ঘটে। তখন পলিটিকাল কেরিয়ারকে উন্নত করতে এই বিষয়গুলোর সঙ্গে সহজেই আপস করে নেওয়া যায়। রাজনীতির খেলাঘরে তখন ক্ষমতাটাই এক এবং একমাত্র ‘কমন মিনিমাম’।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.