তালিবানদের কাবুল দখলের পর যে-ছবি আফগানিস্তান থেকে উঠে আসছে, তাতে এই প্রশ্ন সবচেয়ে জোরাল যে, দু’-দশক ধরে আমেরিকা ও তার সঙ্গী ন্যাটো বাহিনী কী করল আফগানিস্তানে? তালিবানের হাতেই যখন আফগানিস্তান চলে গেল, তখন এই যুদ্ধপ্রচেষ্টার কী কারণ আমেরিকার ছিল? মার্কিন পাপেট সরকার কেন এভাবে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল? লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী
‘কোনও লক্ষ্যই পূরণ হয়নি।’- একমাস আগে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে দু’-দশক আফগানিস্তানে যুদ্ধ করার বিষয়ে এই ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের (Joe Biden) উত্তর। একমাস পর অবশ্য তিনি তাঁর অবস্থান বদলেছেন। আফগানিস্তান পুরোপুরি তালিবানদের কবজায় যাওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁর লম্বা বিবৃতিতে জানিয়েছেন, ৯/১১-এ আমেরিকার উপর হানার পর আল কায়দাকে ধ্বংস করা-ই ছিল মার্কিন লক্ষ্য। সেই উদ্দেশ্যেই ই আফগানিস্তানে দু’-দশক আগে পৌঁছেছিল মার্কিন সেনা। আল কায়দাকে ধ্বংস করার সেই লক্ষ্য সাধিত হয়েছে। ওসামা বিন লাদেনকেও খতম করা গিয়েছে। পরে আমেরিকা আফগানিস্তানে পুনর্গঠন ও আফগান সেনাদের তৈরি করার কাজ করেছে। কিন্তু আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াইয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনওই থাকতে চায়নি। এক লক্ষ কোটি ডলার খরচ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগান সেনা ও পুলিশকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। অস্ত্রশস্ত্র দিয়েছে। পরিকাঠামো গড়ে দিয়েছে। এবার দেশের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মেটানো তাদের কাজ। বাইডেন আরও জানিয়েছেন, আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত তাঁর আমলে নয়। তাঁর তিন পূর্বসূরি এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি উত্তরসূরির হাতে যুদ্ধের দায়টা আর ঠেলে দিতে চাননি।
একমাস আগে কেন বাইডেন আফগানিস্তানে ‘কোনও লক্ষ্যই পূরণ হয়নি’ বলে মন্তব্য কর ছিলেন, তার উত্তর অবশ্য বিশ্ব ইতিমধ্যেই পেয়ে গিয়েছে। কাবুল তালিবান জঙ্গিরা দখলের পর যে-ছবি আফগানিস্তান থেকে উঠে আসছে, তাতে এই প্রশ্ন সবচেয়ে জোরালো যে, দু’-দশক ধরে আমেরিকা ও তার সঙ্গী ন্যাটো বাহিনী কী করল আফগানিস্তানে? তালিবান আতঙ্কে একদল আফগানের দেশ ছাড়ার যে হিড়িক, তা ইতিহাসে কখনও প্রত্যক্ষ করা যায়নি। প্লেনের চাকার উপর মানুষ উঠে বসে আছে, এবং উড়ন্ত বিমান থেকে পড়ে মানুষের মৃত্যু ঘটছে- এই ছবি পৃথিবীতে কখনও দেখা যায়নি। আমেরিকা দীর্ঘদিন যুদ্ধ চালিয়ে, পরাস্ত হয়ে, নিজেদের সুবিধামতো সময়ে পাপেট সরকারের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করে বিদেশি রাষ্ট্র ছেড়ে চলে গিয়েছে- এই দৃশ্য পরিচিত। পৃথিবীজুড়ে আজ প্রশ্ন: দু’-দশক আগে যে তালিবানের দখলে আফগানিস্তান ছিল, আজ দু’-দশক পরে ঠিক সেই তালিবানের হাতেই যখন আফগানিস্তান চলে গেল, তখন এই যুদ্ধপ্রচেষ্টার কী কারণ আমেরিকার ছিল? মার্কিন পাপেট সরকার কেন এভাবে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল? ৩১ আগস্ট পুরোপুরি আফগানিস্তান থেকে চলে যাওয়ার কথা মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর। কিন্তু তার এত আগেই যে প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনিকে এভাবে টাকাপয়সা ও বাক্সপেটরা নিয়ে রাতের অন্ধকারে দেশ ছাড়তে হবে, তা কারও কল্পনায় ছিল না!
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতার কথা উঠে আসছে। তালিবানরা কাবুলের ক্ষমতা দখলের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই স্পষ্ট করে দিয়েছে, মহিলাদের ফের হিজাবের অন্তরালে চলে যেতে হবে। দেশে চলবে ইসলামি আইন। দু’-দশক আগে তালিবান পতনের পর আফগান মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা হয়েছিল। নারীশিক্ষা সেদেশে ফের নিষিদ্ধ হবে কি না, তা এখনও ঘোষণা হয়নি। একইভাবে এখনও জানা যায়নি, তালিবানি বর্বর বিচারব্যবস্থা ফের ফিরবে কি না। তবে দু’-দশক আগের সঙ্গে তফাতটা হল, বিনা সংঘর্ষ ও রক্তপাতেই এবার তালিবানরা ক্ষমতা কায়েম করল। এর আগে ক্ষমতা দখলের সময় অপসারিত আফগান প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাকে হত্যা করে ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে দিয়েছিল জঙ্গিরা। কিন্তু, ঘানি দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সুযোগটুকু পেয়েছেন। শোনা যাচ্ছে, মার্কিন সেনাকর্তাদের উপস্থিতিতে কার্যত তালিবান শাসকদের হাতে ব্যাটন তুলে দিয়ে ঘানি দেশ ছেড়েছেন। দু’-দশকে হয়তো এটাই গুণগত পরিবর্তন। সংবাদসংস্থা এপি-কে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে এক আফগান তরুণী বলছেন, “গত দু’-দশক আমেরিকা আমাদের জন্য যা যা করেছে, তাতে তাদের অশেষ ধন্যবাদ। এটুকুই তাদের প্রতি অনুরোধ জানাব যে, তারা আমাদের সঙ্গে আরও কিছুদিন থেকে গেলে ভাল হত।” দু’-দশক আগে আমেরিকা আফগানিস্তানে ঢোকার আগে এই তরুণীর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল তার এক তুতো দাদার সঙ্গে। দু’-দশক পরে সে উচ্চশিক্ষিত ও কাবুলে চাকুরিরত। তালিবান জমানায় সে জানে না, তার কপালে কী অপেক্ষা করছে। তবুও বাস্তবকে স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত সে।
প্রায় তিন হাজার মার্কিনি সেনার প্রাণ ও লক্ষ লক্ষ কোটি ডলার ব্যয় করে আমেরিকা আফগান নাগরিকদের এইটুকু লাভ-লোকসানের জন্য আর কতকাল সেখানে থাকবে? এই প্রশ্ন হয়তো সাধারণ মার্কিনিদের। সাধারণ আফগানদের কাছে এখন তালিবান শাসনের ঝুঁকির বিকল্প হিসাবে সমান ওজন নিয়ে দাঁড়িয়ে সুযোগের বিষয়টিও। ইসলাম পুনর্জাগরণের মধ্য দিয়ে সব সমস্যার সমাধান হবে, তালিবানি এই তত্ত্বের গ্রাহকও তো নিশ্চয়ই কম নয় সেদেশে। ইসলাম পুনর্জাগরণের মধ্য দিয়ে যারা সুযোগ খুঁজছে, তারা কখনওই পাশ্চাত্যের শাসনকে স্থায়ীভাবে মেনে নেবে না। দু’-দশক আগে মার্কিন বোমারু বিমানের হাত ধরে যে আফগানরা তালিবানি শাসনের পতন ঘটিয়েছিল, তাদেরই একটা অংশ ফের আমেরিকার কাছ থেকেও মুক্তি চেয়েছে। বস্তুত, এই তালিবান শাসনের ঝুঁকি ও ইসলামি পুনর্জাগরণের সুযোগ গ্রহণের টানাপোড়েনে দুলছে বহু আফগান। তালিবান অত্যাচারের ঝুঁকিকে তারা মেনে নিচ্ছে শিক্ষা, সংস্কৃতি পাশ্চাত্যকরণ বন্ধ করার বিনিময়ে। ইসলাম মৌলবাদের মূল শিক্ষা-ই হল, পাশ্চাতে্যর মতবাদ দিয়ে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলছেন, ‘ইংরেজি শিক্ষার দাসত্ব থেকে মুক্তি।’ সত্যিই কি তাই!
দু’-দশক পর আফগানিস্তানে চিন ও রাশিয়ার ভূমিকা কী হয়, সেদিকেও তাকিয়ে থাকবে বিশ্ব। তালিবানের পিছনে পাকিস্তানি মদত প্রকাশ্যে। ইমরানের বক্তব্যেও তা স্পষ্ট। কিন্তু চিন ও রাশিয়ার গোপন মদত ছাড়া তালিবানের হাতে এত অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ আসবে কোথা থেকে? ভূকৌশলগত দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আফগানিস্তান ফের গৃহযুদ্ধের মুখ দেখবে কি না, তা সময়ই বলবে, কিন্তু আপাতত এই অস্থির অঞ্চলে ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারা চলবে। ভারত আপাতত ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ পলিসি নিয়ে চলবে। আফগানিস্তান থেকে ভারতীয়দের সরানোর কাজও চলবে বলে জানিয়েছে বিদেশমন্ত্রক। তবে আফগানিস্তানে অস্থিরতা যত বাড়বে, তত উদ্বেগ বাড়বে এই উপমহাদেশেই। নিশ্চিত করে এর আঁচ গিয়ে পড়বে না সুদূর আমেরিকায়। দু’-দশকে আমেরিকার কী লাভ-লোকসান হল, সেগুলি হয়তো স্পষ্ট হবে যত দিন যাবে তত।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.