কিংশুক প্রামাণিক: মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় আদতে একজন পণ্ডিত মানুষ। ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী এই দুঁদে সরকারি অফিসার আইএএস হওয়ার আগে ছিলেন পুরোদস্তুর সাংবাদিক। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-য় চাকরি করতেন। দারুণ সব স্টোরি লিখেছেন। চাকরিজীবনের অন্তিম পর্বে এসে গিয়েছেন তিনি। এই মাসেই তাঁর অবসর।
ইংরেজির মতোই বাংলা সাহিত্যেও আলাপনবাবুর অনাবিল দখল। শুধু লেখা নয়, বলাও। তাঁর উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি স্বতন্ত্র। ভাষার প্রয়োগে সাহস ও মাত্রাজ্ঞান প্রবল। সিভিল সার্ভিসের বেঙ্গল ক্যাডারের ভিনরাজ্যের অফিসারদের বিকৃত বাংলা শুনতে শুনতে যখন সবাই নিরুপায়, তখন তাঁর মতো বাঙালি অফিসার খানিকটা মলয় বাতাস। তাঁর সুললিত বাংলা শুনতে শুনতে মনে হয়, সাধুভাষা প্রয়োগ না করেও শব্দের ব্যবহারে একটি কথাকে কীভাবে অন্য মাত্রা দেওয়া যায়। ব্যাপারটা তাঁর স্বভাবজাত তো বটেই, তিনি অসম্ভব যত্নবানও। যে কোনও কিছুই উপস্থাপনে নেই সামান্য জড়তা, নেই ন্যূনতম ভুলও। গড়গড় করে মাতৃভাষাটা কেমন গুরুছন্দে বলে যান।এহেন মানুষ যখন কথা বলেন, তখন শ্রোতা হয়ে থাকাটাই বাঞ্ছনীয়। কিশোরকুমার গান গাইলে যেমন তন্ময় হতে হয়, সাংবাদিক হিসাবে প্রাক্তন অগ্রজের কোনও ব্রিফিংয়ের সামনে পড়লে মন দিয়ে শুনি।
নিজের ভাষাকে আজ আমরা কতটা সমাদর করি, তা তো সবার জানা। বহু শিক্ষিত বাঙালি ভাল করে বাংলাটা লিখতেও পারেন না। পড়তে গেলেও দাঁত ভাঙে। মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ হলেও অনেকের কাছে নিজের ভাষা ব্যাকডেটেড। গোড়াতেই গলদ। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ানোর হিড়িকে ‘সহজ পাঠ’, ‘বর্ণপরিচয়’ কী অমৃত- তা আজ অনেক পড়ুয়া জানে না। ফলে বঙ্গসমাজে যত দিন যাচ্ছে বাংলা কথার মধ্যে হিন্দি-ইংরেজি শব্দের চল এসে যাচ্ছে। বদলে গিয়েছে ডাকহাঁক। কাকা হয়ে গিয়েছে ‘আঙ্কল’, কাকিমা ‘আন্টি’। মা হয়েছে ‘মম’, বাবা ‘ড্যাডি’। কিচেন, টয়লেট, ব্যালকনি, পার্লার, হ্যান্ডওয়াশ ইত্যাদি শয়ে শয়ে ইংরেজি শব্দ বাঙালির মুখে মুখে। এর বাংলাগুলো সবাই ভুলে গিয়েছি। আগে ‘পঞ্চানন’ অপভ্রংশ হয়ে ‘পাঁচু’ ও শেষ পর্যন্ত ‘পেঁচো’ হত। এখন পঞ্চাননস।
যাই হোক! আজ বাংলা ভাষা নিয়ে আলোচনা নয়। বিষয় অন্য। করোনা-কাল এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। আমাদের দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে। এই কঠিন ব্যাধি যেভাবে সমাজে বাসা বেঁধেছে, তাতে বেঁচে থাকাটাই চ্যালেঞ্জ। সমাজকে বাঁচাতে থুড়ি নিজেকে বাঁচাতে মানুষ আবার ঘরবন্দি। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, ট্রেন-বাস, সিনেমা হল, শপিং কমপ্লেক্স- সব বন্ধ। সংক্রমণ রুখতে প্রায় লকডাউনের মতো বিধিনিষেধ জারি হয়েছে রাজ্যে। শনিবার সাংবাদিক সম্মেলনে সেই বিধি ঘোষণার সময় আলাপনবাবুর মুখ থেকে একটি শব্দ পেয়ে চমৎকৃত হলাম। এই পক্ষকালের ঘরবন্দি থাকার বিধান, যাকে অনেকেই লকডাউন বলে ব্যাখ্যা করছেন, তাকে তিনি বলেছেন, সাময়িক ‘আত্মশাসন’।
এই সময়ের নিরিখে দারুণ একটি শব্দ। অন্যের দিকে তাকালে হবে না। ঠিক, আত্মশাসন-ই এখন একমাত্র পথ। নিজেকে নিজে যদি সুরক্ষিত না করি, শাসন না করি, মারণ ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না। সরকার বিধি-নিষেধ করছে ঠিকই। কিন্তু করোনার মতো অতিমারীর সময় একজন নাগরিক তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সচেতন না হলে কাজের কাজ কিছু হয় না। যদি মাস্ক না পরি, স্যানিটাইজার ব্যবহার না করি, শারীরিক দূরত্ববিধি না মানি- তা হলে করোনার সঙ্গে যুদ্ধ হবে কী করে? সরকার সব বন্ধ করে দিলেই হবে না, মানুষ যদি সচেতন না হয়। সেই প্রেক্ষিতে পক্ষকাল নানা বিধিনিষেধ রাজ্য সরকার ঘোষণা করলেও মুখ্যসচিব যথার্থভাবেই জোর দিয়েছেন আত্মশাসনে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ প্রথমবারের চেয়েও ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। গতবার তাকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে বেঁধে রাখা গেলেও মানুষের ভুলে সে বিধ্বংসী। সমাজ এখন করোনাময়। সব পরিবারে পজিটিভ রোগী। হাসপাতালে জায়গা নেই। ওষুধ সব পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের নানা শহরে অক্সিজেনের অভাবে রোগী মারা যাচ্ছে। উত্তরপ্রদেশে মৃতদেহের স্তূপ। সৎকার করার লোক নেই। গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে দেহ। করোনাকে অবহেলা করার জন্য দেশ থেকে বিদেশে ভারত সরকার প্রবল সমালোচনার মুখে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ যখন টিকাকরণ সম্পূর্ণ করে ফেলেছে, তখন এ দেশের ১২-১৪ শতাংশ মানুষ টিকা পেয়েছেন। দেশজুড়ে টিকার জন্য হাহাকার। টিকা পেলে ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রাচীর তুলে ধরা যেত। সেটা কবে হবে, কেউ জানে না। আমাদের সামনের দিনগুলি তাই ভয়ংকর। গত বছর দেশে মৃত্যু দিনে হাজার ছোঁয়নি। এবার চার হাজার পেরিয়ে গিয়েছে। এখন একটু নিয়ন্ত্রণে এলেও দৈনিক সংক্রমণ চার লক্ষ পার হয়েছিল। বাংলায় গতবার যখন দৈনিক সংক্রমণ চার হাজার উঠে থেমে গিয়েছে, এবার সেটা একুশ হাজার ছুঁইছুঁই হয়েছিল। মৃত্যু ছিল সর্বোচ্চ ৬৪। এবার ১৪৭-এ আপাতত পৌঁছেছে। এই তথ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, করোনার আগ্রাসন এবার কতটা ভয়াবহ। প্রতিদিন চেনা মানুষ, বিখ্যাত মানুষ ও প্রিয় ডাক্তারদের মৃত্যুসংবাদে হৃদয় বিদীর্ণ। জানি না আরও কী দেখতে হবে।
তবে বাংলায় করোনা এতটা বাড়ত না, যদি দু’ মাস ধরে আট দফায় বিধানসভা ভোট না হত। হাজার হাজার মিটিং-মিছিলের জেরে সংক্রমণ প্রবল আকার নিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বারবার টিকা চেয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন। শেষ তিন দফার ভোট একদিনে করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। যতদিনে মিটিং-মিছিলে নির্বাচন কমিশন রাশ টেনেছে, ততদিনে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গিয়েছে। স্বভাবতই নিরুপায় নতুন রাজ্য সরকার শপথ নিয়ে ৩০ মে পর্যন্ত কড়া বিধিনিষেধ চালু করেছে। একপক্ষকালের এই পর্ব আচমকা দেশের সব কিছু স্তব্ধ করে দেওয়া লকডাউন নয়। সরকারি-বেসরকারি অফিস, পাবলিক যানবাহন, লোকাল, মেট্রো, বাস, দোকান, কলকারখানা বন্ধ হলেও সাধারণ মানুষ জীবনধারণে যাতে এই সময় সমস্যায় না পড়েন, তার জন্য দেওয়া হয়েছে দেদার ছাড়। স্কুল-কলেজে তালা বহুদিন ধরেই ঝুলছে।
করোনা নিয়ে যখনই লিখতে যাই, একটু থমকে দাঁড়াই। সমস্ত ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করেছে এই কালান্তক ভাইরাস। বিশেষজ্ঞদের অনেক কথাই মেলেনি। আগেও রোগের প্রভাবের বিষয়ে চিকিৎসা হচ্ছিল, এখনও হচ্ছে। এখন হয়তো কিছু ওষুধ এসেছে, ভ্যাকসিন এসেছে, তবু রোখা যাচ্ছে না সংক্রমণ। নতুন দিক হল, কমবয়সিদের উপর এবার থাবা বসাচ্ছে অতিমারী। তাহলে কী করে বাঁচবে মানুষ? মুখ্যসচিবের বার্তাটিই মহৌষধ হতে পারে। ‘আত্মশাসন’। বলা হয়েছে, ১৫ দিন আত্মশাসন। মনে হয়, এত দ্রুত সংক্রমণ কমবে না। মেয়াদ বাড়বেই। বেশ কিছু দিন নিজেকে নিজেই শাসন করতে হবে। মানতে হবে সমস্ত করোনা-বিধি।
লকডাউন সংক্রমণ ঠেকাতে একটি বিজ্ঞানসম্মত পন্থা। কিন্তু তাতে গরিব মানুষের খুব ক্ষতি। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের আরও। ফলে সরকারকে ছাড় দিয়েই বিধি তৈরি করতে হয়েছে। মানে কিছু মানুষকে রাস্তায় নামতেই হবে। সেক্ষেত্র আত্মশাসন আরও মজবুত হওয়া দরকার। মুখ্যসচিবের নিদান মন দিয়ে শুনতে হবে। ভবিষ্যতে আত্মনির্ভর, আত্ম-অহংকার, আত্মহারা কোনওটাই হতে পারব না, যদি আত্মশাসন না করি। না-মানাটা হবে আত্মহত্যা।মৃত্যুমিছিলে হাঁটব না, আসুন সবাই শপথ নিই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.