অতনু বিশ্বাস: ভোট তো দেশে দেশে হয়, হয় রাজ্যে রাজ্যে। এ-রাজ্যেও ভোট হয়েছে অনেক। এবারের মতো কিন্তু দেখিনি কখনও! বিশেষজ্ঞরা যেমনটি বলেন, এ-রাজ্যের সমাজটা বাস্তবিকই ‘রাজনৈতিক সমাজ’, অন্তত গ্রামীণ বাংলায় তো বটেই। শহুরে বাংলাতেও রাজনীতির আসঙ্গ-ই যে বহু মানুষের বেঁচে থাকার অক্সিজেন- সে বিষয়ে সন্দেহ কম। রাজনীতি বা রাজনৈতিক দল একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে এ-রাজ্যের বহু মানুষের প্রাত্যহিক দিনযাপনের প্রতিটা স্পন্দনকে। তেমনটা অবশ্য ছিল আগেও। তবে এবারের ভোট যেভাবে মিডিয়াকে একেবারে ভাসিয়ে দিতে পেরেছে অন্তত আধখানা বছর ধরে, তা বোধ করি একেবারে নজিরবিহীন। মিডিয়ার তালে, তার নির্দেশিত ছন্দে আবর্তিত হয়েছে আমজনতাও। পৃথিবীতে যে পশ্চিমবঙ্গের মহার্ঘ ভোট ছাড়া মাথা ঘামানোর মতো আর কোনও বিষয় আছে, তাই আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি।
কুম্ভকর্ণের ভোট-ঘুম অবশ্য শেষ পর্যন্ত ভাঙতেই হত। বড়জোর নতুন সরকার গড়া, ভোট-পরবর্তী কিছু দলবদল, সম্ভাব্য রিসর্ট-রাজনীতি, রংবেরঙের জোট- ইত্যাদি ঘটে যাওয়া পর্যন্ত মিডিয়া নিজেদের এবং আমাদের আবিষ্ট করে রাখতে পারত। তারপর তাদের, এবং আমাদের ফিরতেই হত, স্বাভাবিক স্পন্দনে। ভোটের শেষ লগ্নে অবশ্য সেই পরিবৃত্তিটা সহজ হয়ে গেল। মিডিয়ার সর্বগ্রাসী এবং সর্বব্যাপী ভোট সম্প্রচারের অভিমুখ বদলে দিল কোভিডের ‘দ্বিতীয় তরঙ্গ’।
হ্যাঁ, ভোট গণতন্ত্রের উৎসব নিশ্চয়ই। শুধু তাই-বা কেন, এ যেন মানুষের জীবনের সর্ববৃহৎ উৎসবেই পর্যবসিত হয়েছে। অন্তত এই বাংলায় তো বটেই। স্বাভাবিক নিয়মে এমন উৎসব পাঁচ বছরে খানতিনেক। নড়বড়ে নয়ের দশকে ভোট উৎসব একটু ঘন ঘন হয়েছে। গত দু’-দশকে সে সুযোগও পাওয়া যায়নি। তাই একে চেটেপুটে উপভোগ করতে, তার থেকে রসদ জোগাড় করতে প্রত্যেকেই যেন কম-বেশি মরিয়া।
এই অবধি ঠিকই আছে। বিধানসভার ভোট পাঁচ বছর বাদে আসে, আসবে- এটাই দস্তুর। সরকার গড়া হবে, সে নতুন হোক বা পুরনো, জনগণ যেমন ভোট দেবেন। রাজনৈতিক দলগুলির কাছে অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে এটা অস্তিত্বের লড়াই হয়ে দাঁড়ায়। যদিও স্বাভাবিক স্পন্দনে বয়ে চলা গণতন্ত্রে তেমনটা হওয়া অভিপ্রেত নয়। গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, এমনটাই তো শিখে এসেছি আজীবন। এবং হার স্বীকার করে নেওয়ার শিক্ষাটাই যে বড় শিক্ষা- তা-ও। যাই হোক, রাজনীতি যাঁদের জীবিকা অথবা যাঁরা রাজনীতির আঙিনায় হা-ডু-ডু খেলেন, তাঁদের জন্য ভোট এবং তাতে জয়-পরাজয়টা অবশ্যই আর একটু বেশি গুরুত্বপূর্ণ। হ্যাঁ, দেশসেবা, সমাজসেবা, ‘মানুষের জন্য কাজ’- এসবকেও হিসাবে রাখা যাক।
সেই সঙ্গে বাংলার প্রিন্ট মিডিয়া হোক বা টিভি চ্যানেল বা ডিজিটাল, গত ছ’-মাস ধরে নির্বাচন ছাড়া অধিকাংশ জায়গায় আর যেন প্রায় কোনও খবরই ছিল না! (মাঝে দাঁত-নখ হারিয়ে ‘কোভিড ১৯’ খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল বলে মিডিয়ার ভোট-সফর খানিকটা সহজসাধ্যও হয়েছিল। যদিও আবার সে আসিছে ফিরিয়া, স্বমূর্তিতে।) ভোটের খবর, তার নানাবিধ কাটাছেঁড়া, সঙ্গে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের বিচিত্র মতামত, কোনও কিছুরই কমতি নেই। ছোট কিংবা বড় মাপের কোনও নেতা ‘কাজ করতে না পেরে’ অন্য দলে যোগ দিলেন- তা নিয়ে বাংলা চ্যানেলগুলির ক্লান্তিহীন বিশ্লেষণ চলল মাসের পর মাস। কোন নেতা প্রচারে গিয়ে কী বললেন, কোথায় পাত পাড়লেন, কী খেলেন, কার মিটিংয়ে মাঠ ফাঁকা, কার রোড শো-তে লোক উপচে পড়েছে- তার চুলচেরা ধারাবিবরণী আর বিশ্লেষণে ডুবে রইল বিমুগ্ধ মিডিয়া। আবার, অভিনয় বা খেলার জগতের নানা তারকা যেভাবে ভিড় জমিয়ে ভোটের রাজনীতিতে এসেছেন এবারে, সেটাও একেবারে নজিরবিহীন। সে নিয়েও মিডিয়ার উৎসাহ, সম্প্রচার এবং পূর্বাভাস ছিল একেবারে নজরকাড়া।
মিডিয়া এসব থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র রাখবে, সেটা অবশ্যই অভিপ্রেত নয়। কিন্তু পরিবর্তে মিডিয়া যেন একমাত্র এসব কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতে থাকল। বাংলা খবরের চ্যানেলে অবিরত ভোটের ভাষণ, এমনকী তিন-চারভাগে স্ক্রিন ভাগ করে এক-এক ভাগে এক-এক নেতার প্রচারের ছবি যেন একেবারে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। সেটা যে কখনও ক্লান্তিকর হয়ে উঠতে পারে দর্শকের কাছে, সেসবের তোয়াক্কা না করেই।
এর মাঝে কিন্তু দেশে-বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে বিস্তর। কিউবায় রাউল কাস্ত্রো-র ক্ষমতা ছেড়ে সরে দাঁড়ানো, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ‘বাইডেনীয়’ সিদ্ধান্ত, মার্কিন আদালতে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকারীর দোষী সাব্যস্ত হওয়া, অস্ট্রেলিয়া দেশটার সঙ্গেই ফেসবুকের গন্ডগোল বেঁধে যাওয়া, সুয়েজ ক্যানালে জাহাজ আটকে পৃথিবীর বাণিজ্য-ব্যবস্থার নাভিশ্বাস ওঠা, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে বাইডেন প্রশাসনের টক্কর শুরু হওয়া- ইত্যাদি ইত্যাদি। এসবের কিছু কিছু আমাদের ভবিষ্যতের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্যি বলতে, এই ভোটপর্বে অন্য কিছুতে মিডিয়া গুরুত্ব কম দেওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষ এসব নিয়ে ভাবার অবকাশ বড় একটা পাননি।
মোটের উপর, কোভিড অতিমারী থেকে আপাত-মুক্তির ভ্রম সঙ্গী করে মহাশ্মশানে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের প্রাত্যহিক ভাবনা-চিন্তাকেও যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল এক ভোটপর্ব, যতদিন না কোভিডের ‘দ্বিতীয় তরঙ্গ’ আমাদের এক গভীরতর বিপর্যয়ের সামনে দাঁড় করিয়েছে। একটা বিধানসভার ভোট নিয়ে সমাজের এই সাংঘাতিক রকমের সম্পৃক্ত হয়ে যাওয়ার কী কারণ, সেটা ভাবার চেষ্টা করেছি বারবার। কোনও একটি বিশেষ কারণ নির্দিষ্ট করা কঠিন বইকি। বিজেপি-র মতো একটা প্রবল সংগঠিত দল রাজ্যের শক্তিশালী শাসক দলের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠে তাকে এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে, সেটাই কি শুধুমাত্র এই নির্বাচনের গুরুত্ব?
বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ একযোগে ভোটে লড়ে কি বাড়িয়ে দিয়েছে এই ভোটের থ্রিল? যতদূর মনে পড়ছে, ২০১১-তে পরিবর্তনের ভোটেও তো এমন করে ভোটের জোয়ারে ভেসে যেতে দেখিনি বাংলার সমাজ আর মিডিয়াকে। না কি ইলেকট্রনিক ও ডিজিটাল মিডিয়ার প্রবল উত্থান এবং পারস্পরিক তীব্র প্রতিযোগিতাই গণমাধ্যম এবং জনতার এবারের উচ্ছ্বাসের জন্য অনেকাংশে দায়ী? অথবা, প্রবল প্রভাবান্বিত সোশ্যাল মিডিয়ার বিমূর্ত দুনিয়ায় সত্য-মিথ্যার ধোঁয়াশা, তার পোস্ট ট্রুথের জগতের আবেশ সর্বগ্রাসী হয়ে উঠে অলক্ষ্যে নিয়ন্ত্রণ করেছে প্রথাগত মিডিয়ার স্পন্দনকেও, হয়তো খানিকটা তাদের অজান্তেই?
এবারের ভোটে শতাব্দীর ভয়ংকরতম অতিমারীতে বিপর্যস্ত জনজীবনে নতুন আশা সঞ্চারিত করার একটা সুযোগ যেমন রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে ছিল, তেমন করেই করোনা-বিধ্বস্ত দেশ এবং দুনিয়ার হতাশার ছবি আর খবর সম্প্রচার করতে করতে ক্লান্ত মিডিয়া যেন ‘রিলিফ’-এর মতোই এক টুকরো আকাশ খুঁজে পেয়েছিল ভোটের বাজারের অন্য স্বাদের খবর পরিবেশনের সুযোগ পেয়ে। দীর্ঘ ভোটপর্ব তাদের সেই সুযোগ দিয়েছে আরও বেশি করে। আর, তা করতে গিয়েই যেন ছ’মাস ধরে এক ক্লান্তিকর ভোট-সম্প্রচারের আবর্তে ঘুরপাক খেতে খেতে আরও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে মিডিয়া। রাজ্যের রাজনৈতিক সমাজব্যবস্থার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে মিডিয়াই হয়তো মহামারী নিয়ে ঘর করতে থাকা সাধারণ জনতাকে বড্ড বেশি আবিষ্ট করেছে রাজনীতির ঘটনাবলির আবর্তে, সেই সঙ্গে নিজেদেরও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.