ছবি: প্রতীকী
শুভময় মিত্র: নাম রাখতেই পারেন ‘ইন্দিরা’ বা ‘সুভাষ’। কিন্তু সন্তান রাজনীতিতে যাক, এমনটা কোনও বাবা-মা আগেও চাননি। আজ তো প্রশ্নই ওঠে না। রাস্তায় সারাদিন ব্যাটবল পেটালে গজগজ করতে করতে ‘উনি শচীন হবেন’ বললেও মারাত্মক রাগ হয় না বোধহয়। বাচ্চা খেলছে খেলুক, সবাই কি আর সৌরভ হয়? কিন্তু নেতা? কখনওই নয়। স্বাধীনতা-উত্তর ভারত যতই আন্তর্জাতিক হয়ে উঠুক, খুব কম রাজনীতির মানুষ দেশবাসীর কাছে ভালবাসা, সম্মান পেয়ে এসেছেন। বা পাচ্ছেন। সিনেমার পর্দার বাইরে রাজনীতি করা হিরো খুঁজে পাওয়া শক্ত।
ডেভলপমেন্টের নামে পার্লামেন্টে কী চলছে- সেটা একসময় বোঝা যেত না বিশেষ। এখন যায়। কোটি কোটি মানুষের প্রতিনিধি হতে গেলে যে স্বার্থহীন মানবিকতার জোশ থাকা বাঞ্ছনীয়, তার অভাবটা প্রকট হয়ে উঠেছে উত্তরোত্তর। বুদ্ধি বিবেচনাজনিত পদক্ষেপগুলো মুহূর্তে বদলে গিয়েছে স্বার্থপর বাঁদরামোতে। খবরের কাগজ, রেডিও, টিভি, হালে ইন্টারনেট আরও বেশি সুযোগ করে দিয়েছে পরিস্থিতি, সিদ্ধান্ত, ধান্দাগুলো ঝটপট বুঝে ফেলার। কারা মিথ্যেবাদী, ধান্দাবাজ, ক্ষতিকর- এটি জেনেই শাইনিং বা ড্রাউনিং ইন্ডিয়া কোথাও একটা দাঁড়িয়ে আছে। নির্বাচনের সময় কে কম খারাপ- সেই অঙ্ক শেখার চেষ্টা করেছি আমরা সবাই। নিজেরাও বদলেছি। এই পরিবর্তনের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন নেতারা। ভাল বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় যা কিছু, তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ও প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাবের ওপর নির্ভর করেই ভোটের খেলা হয়ে এসেছে। তবে এবারের নির্বাচনে বাংলায় সমর্থন জোগাড়ের সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তি দেখলাম আমরা। ফলাফলও দেখেছি।
একটু পিছোই। তিরিশ বছরের বামপন্থী শাসনের অনুপযোগিতা, পাশাপাশি ঝলমলে লড়াকু অন্য এক মননের আহ্বানে বিপুল সাড়া পড়েছিল। একটা প্রাথমিক খুশির হাওয়া নেমে যেতেই সদ্যপ্রাপ্ত ক্ষমতার অপব্যবহারের গল্প ছড়িয়ে যাচ্ছিল হাওয়ায় হাওয়ায়। দিল্লির পালাবদলেও ভারতীয় নবজীবনের আকাঙ্ক্ষা কার্যকর হয়েছিল। কেন্দ্রে, রাজ্যে দুই সরকার ঝলসে ওঠার অন্যতম কারণ, আগের দলকে ম্যাদামারা মনে হওয়া। দু’দলেরই অজস্র দুর্নীতির খবর চাউর হতে বেশি সময় লাগেনি। হইচই হলেও, ‘ছুড়ে ফেলে দাও ওদের’- এমন চিৎকারও ওঠেনি। কারণ, এক, পলিটিক্সে এটাই হয়, রাজনীতির ক্রোনোলজি দেখতে দেখতে সমঝে গিয়েছিলেন সবাই। ঝড়ে কিছু বাড়ির চাল তো উড়বেই, এইরকম ব্যাপার। দুই, প্রায় ভ্যানিশ হয়ে যাওয়া, দুর্বল টুইট করা, মেরুদণ্ডহীন বিরোধীরা রাতারাতি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। এদিকে, একধরনের ‘সেটিং’-এর উপর চলছিল পশ্চিমবঙ্গ। কেন্দ্রীয় সরকার সর্বভারতীয় স্তরে নিজেদের ক্ষমতা কায়েম করতে অভূতপূর্ব পদক্ষেপ করতে শুরু করল। রাজনীতির যুদ্ধে এসে গেল ধর্মকে হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করার প্রক্রিয়া। দেশের ইতিহাসে প্রথমবার। দেখলেন বাংলার মানুষ, বিশেষ মাথা দিলেন না। মাথাটা না দিয়ে পারা গেল না এবারের বিধানসভা নির্বাচনে। এতটুকু রাখঢাক না করে রীতিমতো আগ্রাসী চেহারা চোখে পড়ল গেরুয়া পতাকাধারীদের। এমনকী, বহু লোক বিশ্বাস করতে শুরু করলেন, নির্ঘাত পরিবর্তন হতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গে।
যে প্রত্যয় ও দাপট নিয়ে ‘আমরাই আসছি’ চিৎকার শোনা যাচ্ছিল, তাতে একটু হলেও অনুদ্যোগী, কিঞ্চিৎ ভীতু বাংলার লোক অনেকটাই ভয় পেলেন। বাংলার লোক মানেই কিন্তু শুধুই বাঙালি নয়। বহু জাতি, ভাষাভাষী, ধর্মের মানুষের সহাবস্থানে ‘পিছিয়ে থাকা বাংলা’ বহুকাল ধরেই অনেকের চেয়ে এগিয়ে- এটি তুমুল বঙ্গ-বিদ্বেষীও মানবেন।
এরই মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল করোনা। ভাইরাসের চেয়েও ভয়াবহ ঘটনা ঘটল। প্রাণের চেয়ে পেটের দায়ে বিপর্যস্ত বঙ্গবাসী মুহ্যমান অবস্থায় ইষ্টনাম জপতে লাগলেন। ভাইরাসটি রাজনৈতিক মদতপুষ্ট নয়। একে সামলানোর যুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা ন্যক্কারজনক বলেই মনে হল। এরপর কৃষক আন্দোলন। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতার গভীরতা নিয়ে মতদান করছি না। এই মহাসংকটে গেরুয়া শিবিরের ধর্মীয় আগ্রাসন, মেরুকরণের চেষ্টা খারাপ চোখেই দেখলেন অধিকাংশ লোক। এই অবধিও সংশয় ছিল। কারণ, অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইছিলেন যে ‘সবার ওপরে ধর্ম সত্য’। ‘খেলা হবে’ কথাটা উঠে এল আগেই শুরু হওয়া যে-খেলার পরিপ্রেক্ষিতে, তা হল আক্রমণের চেহারাটা আগ্রাসনে রূপান্তরিত হয়ে ওঠায়। উন্নততর রাজনৈতিক জীবনের বিলাসিতার লোভে, অথবা একনায়িকাতন্ত্রের অমোঘ অস্বস্তিতে দলে থেকে ‘কাজ থেকে কাজ করতে না পারার’ অবসাদে অনেকেই পাড়ি দিলেন বহিরাগত শিবিরে। ইন্টেলেকচুয়াল বাঙালি নিশ্চিতভাবে ভাবলেন, ‘হরিদাস, তুমিও?’
কার্যত বিরোধীহীন পশ্চিমবঙ্গে একটা স্ববিরোধের সুনামি উঠল। টু ছিঃ অর নট টু ছিঃ। এতদিন পর্যন্ত একজন দেশনায়কের কুর্সিকে সম্মান জানাতে পিছপা হয়নি কেউ। কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে গেল তাঁর কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় শাগরেদহীন লাগামহীন অসভ্যতা। পাড়ার পটলাদা হঠাৎ একটা প্লাস্টিকের গদা নিয়ে মহম্মদ আলির মতো ‘আই অ্যাম দ্য গ্রেটেস্ট’ বলে ঘোরাতে শুরু করায় কেসটা খারাপই হল। একের পর এক হুমকি দিয়ে বড় সাংঘাতিক ভুল করে বসলেন ক্ষমতার নয়া দাবিদারেরা। আঁতে লাগল অনেকেরই। মুখে কিছু বললেন না। পাশের মানুষকে এখন বিশ্বাস করা মূর্খামি। ইতিহাস বইয়ে দিল্লির আগ্রাসনের চ্যাপ্টারটা মনে পড়ে গেল সবার। সেবারে ঠেকানো যায়নি। সে যুদ্ধটা ছিল অস্ত্রধারী শরীরের সঙ্গে আলুথালু জড়ভরত জনগোষ্ঠীর। এবারে মারপিটটা ঘুরে গেল দৃশ্যমান, কুশিক্ষার প্রচারকদের বিরুদ্ধে অদৃশ্য, বুদ্ধির বর্ম পরা বুদ্ধিমত্তার। রব উঠল অরাজনৈতিক মহল থেকেও। সেদিকে তাক করে ইনভিন্সিবল কামানগুলো ব্যর্থ হল ইনভিজিবল ইন্টেলিজেন্সের সামনে। বিদ্বেষের বিষরসে সিক্ত গোলাগুলো ফাটলই না। এমনকী বোকা বনে গেল এগজিট পোলও। টিভি, মিডিয়া যেহেতু আজ শুধুমাত্র খবর-যন্ত্র নয়, উলঙ্গ প্রচার মাধ্যম, সবাই বোঝেন সেটা। দেখেন হয়তো, গেলেন না। এই সুযোগে মহা চালাক ভেতো পাবলিক ভোটের ইচ্ছের পূর্বাভাসের বিবৃতিতে ডাহা গুল মিশিয়ে দিল। ঘোর গরমে কোট-প্যান্ট পরা যাবতীয় সঞ্চালকের চালাক চালাক ভবিষ্যদ্বাণী মুখ থুবড়ে পড়ল সবার চোখের সামনে। চটিজুতো ফেলে সবেগে দৌড়ে পালাল আধুনিক বর্গীরা। আবেগের জায়গায় মারাত্মক আঘাতকে প্রতিহত করে বাংলার লোক বের করে ফেললেন বত্রিশ পাটি। জয়-পরাজয়টা দলীয় রাজনীতির হল না। জয় হল ভীষণভাবে মনে নাড়া খাওয়া, অপমানিত হওয়া, দুর্বল হিসাবে পরিচিত, আজও, এখনও সচেতন, সুস্থ সংস্কৃতিকে জড়িয়ে থাকা আবেগপ্রবণ মানুষের সাহসী ঘুরে দাঁড়ানোর।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.