Advertisement
Advertisement

যুদ্ধের হাত ধরে শান্তি অসম্ভব

ভারত-পাক পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ প্রতিদিন-এ কলম ধরলেন রাজদীপ সরদেশাই।

War no solution, says Rajdeep Sardesai
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:March 1, 2019 11:15 am
  • Updated:March 1, 2019 11:15 am  

রাজদীপ সরদেশাই: যুদ্ধ আর যাই হোক ‘ক্রিকেট ম্যাচ’ নয়। আর নিয়ন্ত্রণরেখা টপকে চুপিসারে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে এই অতর্কিত বিমানহানাকেও রাজনীতির চশমা গলিয়ে হালকা করে দেখা উচিত নয়। কিন্তু এ মরশুম নির্বাচনের কচি পাতা গজানোর। পাকিস্তানের সন্ত্রাসী ঘাঁটির উপর এমন পরিকল্পিত, নন-মিলিটারি আক্রমণের পর জুতসই তারকাসুলভ বক্তৃতার ফুলঝুরি আরও ভালভাবে যার আভাস দিচ্ছে। পুলওয়ামায় ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ানের নৃশংস হত্যার পর সমাজের সম্মিলিত বিবেক এখন সম্মুখসমরে। তবে দেশাত্মবোধের এহেন আবহে আরও একটি প্রশ্ন উসকে উঠছে: পুলওয়ামা আর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধং দেহি’ মনোভাবই কি আসন্ন ভোটের ঘাড়ে ভর করবে?

[সন্ত্রাস চালাতে কোন পথে টাকার জোগান জইশ-ই-মহম্মদের, মিলল উৎস]

Advertisement

বিজেপি নেতৃত্ব এতদিন ‘মজবুত সরকার’ বনাম ‘মহা-মিলাওয়াট’ (মহাজোট) নিয়ে প্রভূত বাক্য-ফুরফুরানিতে ব্যস্ত ছিল। আর, বিরোধী পক্ষ ব্যস্ত ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের দীর্ঘ পাঁচ বছরের ব্যর্থ প্রতিশ্রুতি খুঁটে খুঁটে তোলায়– বেকার সমস্যা থেকে শুরু করে কৃষি সমস্যা, কত না ইসু্য! কিন্তু পুলওয়ামা, আর সীমান্ত পেরিয়ে বিমানহানার পর খেলা ঘুরে গিয়েছে। বিজেপি নেতৃত্বের বাকভঙ্গি সচেতনভাবে আবেগমথিত জাতীয়তাবাদের দিকে মোড় নিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘বাহুবলি’ ভাবমূর্তি বন্দিত হচ্ছে। তিনি ‘শত্রু’-কে উচিত শিক্ষা দিতে উদ্যত, দুঃসাহসী। ফলস্বরূপ বার্তাটি স্পষ্ট: এমন যুদ্ধময় জলবায়ুতে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া মানে শুধুমাত্র ‘স্ট্রংম্যান’ নরেন্দ্র মোদির বিরোধিতা করা নয়, সে ভোট আদতে ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ ভোট।

টিভি-মিডিয়ার উগ্র দেশাত্মবোধক ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’-সুলভ গা-গরম ভাষণ, সেইসঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় যুদ্ধকামী চিয়ার লিডারদের যৌথতায় অদ্ভুত এক বাতাবরণ তৈরি হয়েছে দেশে- সরকারের বিরুদ্ধে কেউ একটা বিরূপ মন্তব্য করলেই তাকে ‘দেশদ্রোহী’ তকমা দিতে মুহূর্ত সময় লাগছে না! পুলওয়ামায় যথার্থ নিরাপত্তার অভাব হোক বা দিক্‌ভ্রান্ত কাশ্মীর-সমস্যা-সরকার এসব ব্যাপারের গাফিলতি শাক দিয়ে ঢাকার চেষ্টায় মুখর। তার তীব্রতা এমন উগ্র পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে যে, আজ সুনীল গাভাসকর এবং শচীন তেণ্ডুলকরের দেশপ্রেম নিয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। কারণ, এই দুই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তারকা বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে বয়কট করায় সায় দেননি।

‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’-কে অস্ত্র করে দল এবং দেশে উগ্র সাম্য আনার বিজেপীয় তরজা এই প্রথম নয়। ১৯৯০-এ বিজেপি যখন বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রেক্ষাপটে প্রথম রাজনৈতিক বলবত্তা নিয়ে প্রতিভাত হল, তার মধ্যে ছিল হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার ধারাপাতের সঙ্গে ‘জাতীয়তাবাদ’-এর ফুলকি। যা বহু অবসরপ্রাপ্ত আর্মিকে সমর্থনে টেনে এনেছিল, যার মধ্যে ছিলেন ১৯৭১-এর বাংলাদেশ যুদ্ধের অন্যতম কৃতী জেনারেল জ্যাক ফর্জ রাফায়েল জ্যাকব। ১৯৮০-র দশকে দাঙ্গা থেকে শুরু করে গুপ্তহত্যা– দেশ কংগ্রেসের নৈতিক আপস ঘিরে বিভিন্ন হিংস্রতার প্রত্যক্ষদর্শী হল। আর, সে অবকাশে উত্থান ঘটল বিজেপির। তারা হয়ে উঠল সেই দল, যে ভারতকে দেবে মজবুত জায়গা এবং এমন এক শক্তসমর্থ নেতৃত্ব– আপাত ধর্মনিরপেক্ষতার চাতুরিতে যাকে টলানো যায় না।

একই স্ট্র‌্যাটেজি দেখা গিয়েছিল ২০০২ সালে গুজরাত দাঙ্গায় বিজেপির বিতর্কিত ভূমিকায়। গোধরায় কর-সেবকদের পুড়িয়ে মারার ঘটনার বদলায় মারা যান শ’য়ে শ’য়ে মুসলিম। ট্রেনের অন্তর্ঘাতকদের শুধুমাত্র মুসলিম রূপেই নয়, ‘পাকিস্তানি মুসলিম’-এর তকমা দেওয়া হয়েছিল। ‘গুজরাতি অস্মিতা’-র পারদ এতে চড়েছিল হুড়মুড়িয়ে। এবং সংঘ পরিবার সেই ঘটনাপ্রবাহকে এমন করে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক অসূয়ায় মুড়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল যে, নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসন বিজেপির দখলে আসে।

২০০২-এর এই ‘গুজরাত মডেল’-ই কি তাহলে ২০১৯-এর নির্বাচনে জেতার তরুপের তাস? সবরমতী এক্সপ্রেসে যারা আগুন ধরিয়েছিল বলে অভিযোগ, তাদেরই কি আজ অন্যভাবে ‘কাশ্মীরি মুসলিম’ বলে প্রতিস্থাপিত করার চোরা-চেষ্টা চলছে? এক্ষেত্রে তারা পুলওয়ামার সুইসাইড বোম্বার এবং সেনাবাহিনীর দিকে পাথর ছোড়া মানুষজন! এবার জইশ-ই-মহম্মদের মতো পাকিস্তানি জেহাদি গ্রুপ ও তাদের অনুগামীদের দিকে তাকান, যারা পাকিস্তানের আর্মির সাহায্যে বহুকাল ধরে উপত্যকায় বরফ লাল করায় মেতেছে। তাহলে? সমীকরণ স্পষ্ট– ‘দেশ কো খতরা হ্যায়’ ভিতরে-বাইরে দু’দিক দিয়েই। এই হল সেই ভয়াবহ কল্পনালতা, যা বিজেপি সভাপতি সচেতনভাবে অসমের সাম্প্রদায়িকভাবে সংবেদনশীল জেলা লখিমপুরে দলীয় র‌্যালিতে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন– বিজেপি কিছুতেই এই রাজ্যকে আর একটা ‘কাশ্মীর’ হতে দেবে না। কিংবা যখন মেঘালয়ের রাজ্যপাল কাশ্মীরিদের বয়কটে সম্মতি জানিয়েছিলেন– সেও কি কম লজ্জার? সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিতাড়িত করতে এর চেয়ে ভয়ংকর আওয়াজ কি আর কিছু হতে পারে?

প্রশ্ন হল, এমন সব বিষাক্ত বার্তা কীভাবে ভোট-কে প্রভাবিত করবে? এখনও পর্যন্ত কাশ্মীর বা পাকিস্তান কখনওই ‘কেন্দ্রীয়’ সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি দেশের সাধারণ নির্বাচনে। এমনকী, ১৯৯৯-এর নির্বাচনে বাজপেয়ীর শাসনাধীন বিজেপির জয়ের সময়েও হয়নি। যে সময় সবে সবে কারগিলের যুদ্ধজয় হয়েছে। যুদ্ধ পরিস্থিতি বরাবর একটা দেশের সংহতিকে আরও দৃঢ় করে দেয় মানছি, একচ্ছত্র জাতীয় উদ্দেশ্য-বিধেয় মাথায় উড়ে এসে জুড়ে বসে যা এমনি সময়ে থাকেই না। কিন্তু এমন বৈচিত্রময় এবং বিরাট দেশে ভোটারদের কাছে তা ভোট বেছে নেওয়ার একমাত্র কারণ হয়ে দাঁড়ায় কি না, নিশ্চিত করে বলা যায় না। উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে দেশভাগের ঘা এখনও শুকোয়নি, সেখানে সাম্প্রদায়িক সমস্যা অনেক অনেক গূঢ়- সেখানে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সম্মুখসমর হওয়া বা প্রধানমন্ত্রীর কেতাবান নেতৃত্বের কড়কানিতে চিঁড়ে ভিজবে তো?

যদিও দুই নিউক্লিয়ার অস্ত্রধারী প্রতিবেশীর মধ্যে দ্বন্দ্বের দামামা যেভাবে চড়াম চড়াম করে বাজছে, তা অস্বীকার করা যায় না এবং ‘উরি’-র মতো ফিল্ম সিনেমা হলে যতই ‘জোশ’ তৈরি করুক না কেন, বাস্তবের মাটি আসলে চাইছে অনেক বেশি সাবধানি পা ফেলার শপথ। কোনও রাজনৈতিক দল বা নেতা, যতই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হোন না কেন, ঘরে মৃতদেহর ব্যাগ যখন ফেরে, কারও মাথাই ঠিকঠাক কাজ করে না। সেই কারণেই আগামী সপ্তাহগুলিতে নির্বাচনের উত্তাপ যত বাড়বে এবং ইসলামাবাদে প্রতিহিংসার আগুন যত ছড়াবে, সরকারকে আরও তৎপর হতে হবে সিদ্ধান্তগ্রহণে। ১৯৭১-এর এতদিন পর আবার ‘এলওসি’ ক্রস করায়, এই সরকার মনে হয় না, খুব সহজে ‘শত্রুপক্ষ’-র সঙ্গে শান্তি সমঝোতায় আসবে। পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী এলাকায় বেশ দৃশ্যত এবং অনির্দিষ্টকালীন ক্ষয়ক্ষতি না দেখা অবধি একটিমাত্র সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে আবেগতাড়িত গৃহস্থ মানুষও যে খুব শান্ত হবে না, সেটাও স্পষ্ট। তারা যুদ্ধের হাত ধরে শান্তি চায়। কিন্তু একই সঙ্গে ইন্দো-পাক দ্বন্দ্বে কাশ্মীরিদের কাছে না পৌঁছে শুধু সীমান্ত পেরিয়ে যুদ্ধ সম্ভব নয়। টিভি স্টুডিওতে হালকাভাবে, সংবেদনশীলতার বিন্দুমাত্র পরিচয় না দিয়ে, এই ‘যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা’-র ব্যাপারে যা খুশি বলা যায়। কিন্তু বাস্তবে স্বল্পমেয়াদি লাভের জন্য দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যকে পরিহার করা কখনওই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। নিউজ চ্যানেল টিআরপি-র জন্য না হয় যুদ্ধের দামামা বাজাচ্ছে, কিন্তু সরকার যদি ‘ভোটের জন্য যুদ্ধ’– এহেন পন্থা অবলম্বন করে, তবে তা ভয়ানকভাবে জাতীয় সুরক্ষা নড়বড়ে করে দেবে।

পুনশ্চ, গত সপ্তাহে, চেন্নাইয়ের একটি নামী কলেজে, এক নির্বাচনী শোতে যেসব ছাত্রছাত্রীর রেকর্ড আমি নিয়েছিলাম, তাদের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল– পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কোনও উপায় বাতলাবে না। কিন্তু তাই বলে খেলায় তাদের নিতেও আমরা পক্ষপাতী নই। পাকিস্তানের সন্ত্রাস থেকে বিরত না হতে চাওয়ার এই গোঁ দেখে দেখে, আমরা, ‘দেশপ্রেমী’ ভারতীয়রা, সত্যিই ক্ষুব্ধ! আমাদের সুবিশাল সেনাবাহিনী নিয়েও আমাদের গর্বের অন্ত নেই। কিন্তু তাই বলে, উড়ো খবরের গ্রন্থিমন্থন করে যুদ্ধের শিঙা ফোঁকার জন্য সরকারকে প্রলুব্ধ করার কাজ যেন আমরা না করি! এই আমার প্রার্থনা।

[কূটনীতির চালে মাত পাকিস্তান, কালই অভিনন্দনকে নিঃশর্তে মুক্তি দিচ্ছে ইমরান সরকার]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement