রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: ‘স্যর’ ভি. এস. নইপল আমার থেকে বছর নয়ের বড়। এ আমার পরম সৌভাগ্য। তিনি হাঁটছেন আগে আগে। পিছনে অবলীলায় ফেলে যাচ্ছেন অপ্রত্যাশিত অবিকল্প রত্ন। আর আমি মুগ্ধ কৃতজ্ঞতায় কুড়িয়ে চলেছি অনর্গল। The Mystic Masseur, The Suffrage of Elvira, Miguel Street. তখনও ছাত্র আমি। ইংরেজি সাহিত্য ও বিশেষভাবে ইংরেজি গদ্যের নিমগ্ন পাঠক। বছর বিশের আমাকে চমকে দিল ‘এলভিরা’-র গদ্য। এক-একটি পাতা বারবার পড়ছি। শব্দের পর শব্দের প্রয়োগ, বাক্যের পর বাক্যের গঠন, কী সাবলীল অথচ দ্যোতনায় কী দূরপ্রসারী! কিছুক্ষণের জন্য থামিয়ে দিচ্ছি পাঠ! ইংরেজি গদ্যের এমন গহন চোরাস্রোত কতদিন পাইনি। এ যে শহুরে তির্যকতার এপার-ওপার, ডুবসাঁতার হাঁফিয়ে ওঠে সবটুকু বুঝতে। এক-একটি বাক্যের বিচিত্র অর্থ একে-অপরকে বিনুনি বন্ধনে জড়িয়ে। এমন গদ্য তো আগে পড়িনি। মাই গুডনেস, ইংরেজি ভাষায় এমন শানানো হাস্যরস, এমন বাঁকা হাসি, এমন নিমতেতো হিউমার, মিছরির ঘাতক-ছুরি, এই প্রথম! তাও আবার এক অ-ইংরেজ, বাদামি লেখকের কাছ থেকে! যার নাম বিদ্যাধর সুরযপ্রসাদ! ইংরেজের হল কী! ইংরেজকে তো ইংরেজি শিখতে হবে এই বাদামি লেখকের কাছে। ‘এলভিরা’ পড়ে আমার কত বছর আগে মনে হয়েছিল, বিদ্যাধর সুরযপ্রসাদ নইপল-ই আধুনিক ইংরেজি গদ্যের শ্রেষ্ঠ লেখক। আজও মনে হচ্ছে তিনি তাই। আধুনিক ইংরেজি গদ্যের মুখে তিনিই লাগিয়ে ছিলেন লাগাম। পিঠে মেরেছেন চাবুক। ইংরেজি গদ্যের তিনিই সেরা সহিস!
[সুইংয়ের জুজুতে ফের ধরাশায়ী ভারত, লর্ডসেও লজ্জার হার বিরাটদের]
নইপল ত্রিনিদাদের মানুষ। তাহলে এমন ইংরেজের ইংরেজ তাঁকে কে করল? আমার মনে হয়, তাঁকে ‘ইংরেজের ইংরেজ’ করেছে দু’টি জিনিস। এক, তাঁর গায়ের বাদামি রং। যে রঙের জন্য তিনি কম অপমানিত হননি। তাঁকে তো কিছুতেই পাত্তা দিতে চায়নি ইংরেজ। দুই, তাঁকে ইংরেজের ইংরেজ বানিয়েছে তাঁর শিক্ষা ও বুদ্ধিমত্তার ব্রিলিয়ান্স। প্রথমেই বলি তাঁর শিক্ষার কথা। তিনি ইংরেজি সাহিত্য ও ভাষা নিয়ে পড়লেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর বিবিসি-তে চাকরি। এইভাবেই শুরু হল তাঁর ইংরেজি ভাষা ও ব্রিটিশ সভ্যতার সঙ্গে প্রত্যহের সহবাস। তিনি ইংরেজের ইংরেজি থেকে কোনও মুহূর্তেই বিচ্ছিন্ন হননি। এইখানেই তাঁর পার্থক্য অনেক বিদেশি লেখকের সঙ্গেই, যাঁরা ইংরেজিতে লেখেন। তাঁদের ইংরেজি অনেক সময়েই বিদেশির ইংরেজি। কিছুতেই তাঁরা মুছে ফেলতে পারেন না ‘চেষ্টা’-র দাগ। নইপলের ইংরেজিতে কোনও সেলাইয়ের দাগ নেই। এবং তা সম্ভব হয়েছে ইংরেজি ভাষার সঙ্গে, ইংরেজ সমাজের সঙ্গে তাঁর সাবলীল ও নিরন্তর সম্পর্কের জন্য। আর একটি জরুরি কথা এখানে না বললেই নয়। কথাটা সংক্ষেপে হল, নইপল গদ্যশিল্পী, ‘স্টাইলিস্ট’। তিনি খুব সামান্য বার্তাও এমনভাবে দিতে পারেন, যে, মনে গেঁথে যায়। তাঁর গদ্য পড়তে পড়তে আমার অনেক সময়েই মনে হয়েছে, তাঁর গায়ের রং যে আমাদের মতো ‘ব্রাউন’, তিনি যে টম্যাটো রঙের সাহেব নন, এ কথাটা তিনি বিশেষভাবে মনে রেখেছেন। এবং সাহেবদের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিশোধস্পৃহা থেকেই লিখে গেলেন আধুনিক যুগের শ্রেষ্ঠ ইংরেজি গদ্য। এ গদ্য অধিকাংশ ইংরেজ লিখতে চেষ্টা করবেন। কিন্তু হুমড়ি খাবেন পদে পদে, বাক্যে বাক্যে। বিদ্যাধর সুরযপ্রসাদ নইপল ইংরেজের ঈর্ষা হয়ে বেঁচে থাকবেন চিরকাল।
‘A House for Mr. Biswas’ পড়েছিলুম বিএ পরীক্ষা দেওয়ার পরেই, ১৯৬২-তে। তারপর অনেকবার ফিরে ফিরে গিয়েছি বইটির কাছে। এটিকে ঠিক উপন্যাস বলব না। বলব, গদ্যে লেখা মহাকাব্য- যার বিষয়, লন্ডনে থাকা এক গরিব বিদেশির ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যিক হয়ে ওঠার গল্প। নইপল লেখক হওয়ার জন্য দিনের পর দিন যে কী অক্লান্ত পরিশ্রম, কী অপার অনিশ্চয়তা, কী অপরাজিত আত্মপ্রত্যয় ও কত সামাজিক দুর্ভোগ ও অপমানের মধ্যে দিয়ে গেলেন, তারই দলিল এই চিরকালের বই। ‘এলভিরা’-র গদ্যের সঙ্গে ‘মিস্টার বিশ্বাস’-এর গদ্যর কোনও মিল নেই। শুধু একটি মিল ছাড়া: বুঝতে এতটুকু অসুবিধে হয় না, দু’টি বই-ই একই যুগজয়ী প্রতিভার শস্য। আরও একটি প্রয়োজনীয় কথা হল, নইপল আজীবন ফিরে ফিরে এসেছেন বিষয়ের জন্য তাঁর নিজের জীবনের কাছে। বারবার তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা, দুঃখবোধ, নিজের তিক্ত কৌণিকতা প্রবিষ্ট হয়েছে তাঁর উপন্যাসের বিষয়ে। নিজেই হয়ে উঠেছেন উপন্যাসের চরিত্র। আত্মজৈবনিকতা তাঁর উপন্যাসের এক নির্ভুল চিহ্ন তো বটেই। ‘The Enigma of Arrival’ এবং ‘Half a Life’—এর বিষয় তো তাঁরই জীবন। জীবনে কি তিনি সত্যিই পৌঁছাতে পারলেন, যেখানে চেয়েছিলেন পৌঁছাতে? পৌঁছানো কি সত্যিই যায়? ‘অ্যারাইভাল’ শব্দটির মধ্যেই কি ধৃত নয় দুর্জ্ঞেয় প্রহেলিকার ব্যঞ্জনা? তাই জীবন তো ‘হাফ আ লাইফ’- ‘অর্ধেক জীবন’-ই হয়ে থাকে। সে-জীবন ভি. এস. নইপল বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যাঁর-ই হোক!
‘A Flag on the Island’ পড়ে বুঝলাম, এ তো আবার এক নয়া নইপল! ছোট ছোট গল্প। কোনওটি ঘটছে ওয়েস্ট ইন্ডিজে। কোনওটি লন্ডনে। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যকে মিশিয়ে দিয়েছেন নইপল। ইংরেজি গদ্যের শ্রেষ্ঠ নায়ক লিখছেন সংবাদপত্রের প্রতিবেদন: এই হল ‘আইল্যান্ড’। নতুন স্বাদ এল সাহিত্যে। আমি কৃতজ্ঞ বোধ করলাম ভাগ্যের কাছে- ভাগ্যিস ন’বছরের ছোট আমি। সবে লিখতে শুরু করেছি খবরের কাগজে। নইপলের ‘আইল্যান্ড’ হয়ে উঠল আমার রিপোর্ট-লেখার স্কুল। কিছুদিনের মধ্যেই নইপলের নতুন বই ‘In a Free State’ পেল বুকার প্রাইজ। আর আমি শিখলাম, সাহিত্যের এক নিটোল নিদর্শন কীভাবে সহবাসী হতে পারে রাজনীতি ও জাতীয় পরিচয়ের সন্ধানসংকল্পের। রাজনীতিই কি বানাবে-ভাঙবে মানুষের জাতীয় পরিচয়? এই মুহূর্তের এই বিপুল প্রশ্নটি নিয়ে কালজয়ী সাহিত্য রচনা করলেন নইপল। তারপর তাঁর ‘Guerrillas’ গ্রন্থে রাজনীতি ও যৌননির্যাতন হয়ে উঠল এক ভয়ংকর বিষয়। ততদিনে আরও কত বদলে গিয়েছে নইপলের গদ্য! কিন্তু ইংরেজি গদ্যের তখনও তিনি সেরা সহিস। এই সময় থেকেই আমরা বুঝতে পারছিলাম, নোবেল প্রাইজ থেকে তিনি আর বেশি দূরে নন। ২০০১ সালে পেলেন ‘নোবেল’।
চূড়ান্ত প্রশ্নটি হল, ভি. এস. নইপল কি ভারতবিরোধী? ভারত নিয়ে লিখেছেন দু’টি বই: ‘An Area of Darkness’ এবং ‘India: A Million Mutinies Now’। সমস্যাটা হল, তিনি ভারতবাসীকে খুশি করতে বই দু’টি লেখেননি। বলেছেন ঠোঁটকাটা সত্যিকথা। বলেছেন দাম্ভিক ও রূঢ়ভাবে। বেশ করেছেন। এটাই তাঁর স্টাইল। তাঁর একটি কথা মনে রাখতেই হবে: ‘যে লেখককে নিয়ে বিতর্ক হয় না, যে লেখক ঘৃণিত হয় না, তৈরি করে না ঈর্ষা ও বিরোধিতা, সে তো মরে গিয়েছে লেখক হিসেবে!’ এই লেখকের দু’বার ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম আমি কলকাতায়। একবার ইন্টারভিউয়ের শেষে বললেন, ‘আমাকে এক বোতল Cutty Sark হুইস্কি জোগাড় করে দিতে পারো? কোথাও পাচ্ছি না।’ আমি দিয়েছিলাম। এবং স্বয়ং নইপলের তিতিবিরক্ত মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়েছিলাম। এই ঘটনার ক’বছর পরে আমি বিলেতের একটি পাবে পাবসেবিকার কাছে ‘কাটি সার্ক হুইস্কি’ চাই। সে হুইস্কি এনে আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘আর ইউ আ রাইটার স্যর?’ আমি অবাক হয়ে তাকাই তার দিকে। সে বলে– কাটি সার্ক ইজ রাইটারস’ হুইস্কি। শুধু লেখকরাই নাকি এই হুইস্কি খায়!
‘স্যর’ বিদ্যাধর সুরযপ্রসাদ নইপল, আপনি যেখানেই থাকুন, আপনাকে আমাদের এই কলকাতা থেকে কাটি সার্ক চিয়ার্স! ফিরে আসুন, আবার লেখক হয়েই। এবার না হয় বাংলাতেই লিখলেন!
[রাজনীতির মঞ্চ ছেড়ে মহাশূন্যের ঠিকানায় সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.