প্রতীকী ছবি।
সামনেই ’২৪-এর সাধারণ নির্বাচন। এমন সময় গতবারের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল ভূত হয়ে যেন হাজির হল। ফলে, গতবারের ‘বিজেতা’ অর্থাৎ বর্তমান শাসক দল এবং পরাজয়ী, তথা বিরোধী পক্ষ- উভয়ের মধ্যে শুধু হয়েছে চাপানউতোর। ’১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি কার্যত ‘সায়েন্টিফিক রিগিং’ করেছে এই মর্মে সংখ্যাতত্ত্ব ও দৃষ্টান্ত-সহ গবেষণাপত্র লিখেছেন অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সব্যসাচী দাস। কলমে সুতীর্থ চক্রবর্তী
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন ‘ইন্ডিয়া’ জোটের পরবর্তী বৈঠকে বিজেপির সম্ভাব্য ভোট কারচুপি নিয়ে আলোচনা হবে। আগামী ৩১ আগস্ট ও ১ সেপ্টেম্বর মুম্বইয়ে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের পরবর্তী বৈঠক হওয়ার কথা। বিরোধী জোটের বৈঠকে যে বিজেপির সম্ভাব্য ভোট কারচুপি নিয়ে আলোচনার যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ ব্যাপারে ‘ঘরপোড়া গরু’। তাঁকে বাংলায় বামেদের ভোট কারচুপির বিরুদ্ধে দশকের পর দশক লড়তে হয়েছে। বাংলায় যেভাবে বামেরা ভোট কারচুপি করত, সেটা বিজেপি সর্বভারতীয় স্তরে সফলভাবে করতে শুরু করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলায় বামেদের এই ভোট কারচুপিকে বলা হত ‘সায়েন্টিফিক রিগিং’। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে বেশ কয়েকটি বিজেপি-শাসিত রাজ্যে বেশ কিছু লোকসভা কেন্দ্রে অত্যন্ত সফলভাবে গেরুয়া শিবির যে ‘সায়েন্টিফিক রিগিং’-এর সফল পরীক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে, তা উঠে এসেছে সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্রে।
এই গবেষণাপত্রটি প্রকাশের পর দেশজুড়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। নড়েচড়ে বসেছে ‘ইন্ডিয়া’ জোট। সেই প্রেক্ষিতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০২৪ সালেও বিজেপির সম্ভাব্য ভোট কারচুপি নিয়ে মুখ খুলেছেন। তিনি অবশ্য ভোটযন্ত্র তথা ইভিএম ‘হ্যাক’ হওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন। ইভিএম ‘হ্যাক’ হওয়ার প্রযুক্তিগত প্রমাণ এখনও মেলেনি। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ বিশ্বের সর্বত্রই ইভিএমের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়। ইভিএম ‘হ্যাক’ না হলেও কারচুপির অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর।
২০১৯-এর লোকসভা ভোটে বিজেপির কারচুপি যে গবেষণাপত্রটিতে ফাঁস হয়েছে, সেটির রচয়িতা সব্যসাচী দাস। তিনি হরিয়ানার অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক। তাঁর গবেষণাপত্রটির নাম, “ডেমোক্রেটিক ব্যাকস্লাইডিং ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’স লার্জেস্ট ডেমোক্রেসি”। বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ’। অধ্যাপক দাস তাঁর গবেষণাপত্রটি কয়েক দিন আগে কেমব্রিজে ‘ন্যাশনাল ব্যুরো অফ ইকোনমিক রিসার্চস সামার ইনস্টিটিউট, ২০২৩’-এ পেশ করেছেন। তারপরই গবেষণাপত্রটি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্ক শুরু হয়েছে। সংবাদমাধ্যমেও ধারাবাহিক লেখালিখি চলছে। গবেষণাপত্রটি বিশেষজ্ঞদের দ্বারা নিরীক্ষিত হয়ে কোনও গবেষণামূলক জার্নালে এখনও প্রকাশিত না হলেও ‘সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ নেটওয়ার্ক’-এর ই-লাইব্রেরিতে স্থান পেয়েছে। সেখান থেকে গবেষণাপত্রটি ব্যাপকহারে ডাউনলোড হয়ে চলেছে। তবে পরিসংখ্যানবিদ্যায় গভীর জ্ঞান নেই, এমন কারও পক্ষেই ২৯ পাতার ওই গবেষণাপত্রটি পড়ে তার ‘অর্থ’ বোঝা সম্ভব নয়। সাধারণের পক্ষে বোধগম্য নয় এমন একটি লেখাকে ঘিরে হালে সংবাদমাধ্যম, সমাজমাধ্যম ও রাজনৈতিকমহলে এত বিতর্ক হতে দেখা যায়নি।
নির্বাচনের তথ্য বিজ্ঞানসম্মতভাবে পরিসংখ্যান বিদ্যার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অধ্যাপক দাস তাঁর সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। আমরা সবসময় বলে থাকি- স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচন হল গণতন্ত্রর মূল ভিত্তি। এই নির্বাচন যদি কোনওভাবে তার স্বচ্ছতা হারায়, তাহলে পশ্চাদপসরণ ঘটে গণতন্ত্রেরই। গণতন্ত্র যত পিছু হটতে থাকবে, তত তার জায়গা দখল করবে স্বৈরতন্ত্র। বিশ্বের অধিকাংশ গণতন্ত্রেই নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। আমেরিকার এক-তৃতীয়াংশ ভোটার এখন বিশ্বাস করে না যে, জো বাইডেন স্বচ্ছ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জিতে এসেছেন। সাম্প্রতিক অতীতে বহু দেশে নির্বাচনী কারচুপির অভিযোগে সরকার খারিজ হয়েছে। অনেক জায়গায় মাথা তুলেছে স্বৈরতন্ত্র। মার্কিন সংস্থা ‘ফ্রিডম হাউস’-এর ২০২১-এর একটি রিপোর্ট বলছে, বিশ্বজু়ড়ে গত ১৫ বছর ধরে স্বাধীনতার অবক্ষয় ঘটছে। গণতন্ত্রের বাসিন্দাদের ৭৫ শতাংশ যেসব দেশে বাস করেন, সেগুলিতে ব্যাপক হারে গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ ঘটছে। গত ১০ বছরে হাঙ্গেরি, তুরস্ক, পোল্যান্ড, সার্বিয়া, ব্রাজিল এবং ভারতে স্বৈরাচারীকরণ ঘটেছে। ‘ফ্রিডম হাউস’-এর এই রিপোর্ট ছাড়াও ‘ডেমোক্রেসি রিপোর্ট’, ‘ভি-ডেম ইনস্টিটিউট’-এর পরিসংখ্যানে বারবার বলা হচ্ছে, ভারত গণতন্ত্র ছেড়ে ক্রমশ নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। যদিও ভারতের নির্বাচন কমিশন বিশ্বের একাধিক নির্বাচনী সংস্থার তুলনায় এখনও অনেক স্বাধীন ও শক্তিশালী হিসাবে পরিগণিত হয়। কিন্তু, ভারতেও গত কয়েক বছর ধরে নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। নির্বাচন কমিশন যেভাবে ভোটের নির্ঘণ্ট তৈরি করছে, যেভাবে অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে ভোটার তালিকা থেকে সংখ্যালঘুদের নাম বাদ দিচ্ছে- তা নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। ‘গ্যালপ পোল’-এর সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, এক-তৃতীয়াংশ ভারতবাসী নির্বাচন কমিশনের উপর আস্থা হারিয়েছে। ২০০৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে আস্থা বাড়ছিল। কিন্তু ২০১৯-এর পর থেকে এক অন্য ছবি উঠে আসছে। অধ্যাপক দাসের গবেষণাপত্রে এই বিষয়গুলি উঠে এসেছে।
২০১৯-এর ভোটে বিজেপির কারচুপির তত্ত্বে কীভাবে উপনীত হলেন অধ্যাপক দাস? তিনি তাঁর গবেষণার জন্য দেশের বিভিন্ন রাজ্যের এমন কিছু লোকসভা কেন্দ্র বেছে নিয়েছিলেন, যেখানে অন্য দলের সঙ্গে বিজেপির হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে। এই কেন্দ্রগুলির ভোটের ফল বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি দেখেন যে, বিজেপি-শাসিত এই হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের কেন্দ্রগুলিতে ২০১৯-এ অধিকাংশই বিজেপি জিতেছে। ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত এই সমস্ত লোকসভা কেন্দ্রের ফলাফল সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করে তিনি দেখেন যে, একমাত্র ২০১৯-এ এই ব্যতিক্রমী ফল দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ অতীতে কখনও হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের কেন্দ্রগুলিতে শাসক দলের এই পরিমাণ জয় হয়নি। এই জয় যে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ফলেই হয়েছে, এমনটা না-ও হতে পারে বলে সংখ্যাতত্ত্বর মাধ্যমেই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন অধ্যাপক দাস। সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণের ফলে যদি নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা এই জয় হাসিল করতেন, তাহলে এই কেন্দ্রগুলিতে ভোটের সময় অনেক বেশি রাজনৈতিক তৎপরতা ও প্রচার পরিলক্ষিত হত। কিন্তু প্রচারের তথ্য বিশ্লেষণ করে অধ্যাপক দাস দেখেছেন, সর্বক্ষেত্রে তা হয়নি।
২০১৯-এ ভোটের ফলের পরই নির্বাচন কমিশনের প্রদত্ত ভোটের তথে্য গরমিল ধরা পড়েছিল। ভোট শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশন লোকসভা কেন্দ্রওয়াড়ি ভোট পড়ার একটি হিসাব প্রকাশ করে। ২০১৯-এ সাত পর্বে ভোট হয়েছিল। কমিশন চার পর্ব অবধি এই তথ্য দিয়েছিল। গণনার পর ফের কমিশনের ওয়েবসাইটে বিস্তারিত ফলে প্রদত্ত ভোটের হিসাব পাওয়া যায়। কিন্তু দেশের অধিকাংশ কেন্দ্রের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ভোটের পর নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত ভোটের যে হিসাব দিয়েছিল, গণনার পরের হিসাবের সঙ্গে তার গরমিল রয়েছে। বহু ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত ফলে প্রদত্ত ভোটের পরিমাণ অনেক বেশি। যেমন, উত্তরপ্রদেশে গৌতম বুদ্ধনগর লোকসভা কেন্দ্রে গণনার হিসাবে দেখা যাচ্ছে, প্রদত্ত ভোট ৫৭,৭৪৭টি বেশি। এই নিয়ে বিতর্ক শুরু হতেই নির্বাচন কমিশন তাদের সাইট থেকে ভোটগ্রহণের পর দেওয়া হিসাবগুলি মুছে দিয়েছিল। কিন্তু সেই তথ্য পিডিএফ হয়ে বিভিন্ন বেসরকারি ওয়েবসাইটে রয়ে গিয়েছে। অধ্যাপক দাস ৩৭৯টি কেন্দ্রে ভোটের পরে দেওয়া কমিশনের হিসাব ও গণনার পরের হিসাবের তারতম্য বিশ্লেষণ করে দেখেন, যেসব কেন্দ্রে ভোটের হিসাবের গরমিল বেশি, সেখানে বিজেপির জয়ের পরিমাণও বেশি। অধ্যাপক দাস দেশের ২২টি রাজে্যর ৯ হাজার ভোটকেন্দ্রের ফলাফলও সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। সেখানেও দেখা যাচ্ছে, বিজেপি-শাসিত রাজ্যের বড় ভোটগ্রহণ কেন্দ্রগুলিতে বিজেপির জয়ের সংখ্যা বেশি। যা অন্যান্য ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের ভোট শতাংশের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। অর্থাৎ বিজেপি-শাসিত রাজে্য হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আসনগুলির বাছাই করা ভোটকেন্দ্রে অস্বাভাবিক ভোটপ্রবণতা সংখ্যাতত্ত্বর বিশ্লেষণে ধরা পড়েছে।
এই সংখ্যাতত্ত্ব থেকেই অধ্যাপক দাস তাঁর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ২০১৯-এ নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে বিজেপি-শাসিত রাজ্যের পর্যবেক্ষক ও নির্বাচনী আধিকারিকদের ব্যবহার করে কারচুপি হয়ে থাকতে পারে। কারচুপি হয়েছে ভোটার তালিকা তৈরিতেও। এইসব কেন্দ্রে নাম বাদ গিয়েছে বহু মুসলিম ভোটারের। তবে এই কারচুপির জন্যই যে বিজেপি ২০১৯-এ ভোটে জিতেছে- এমন মন্তব্য করতে চাননি অধ্যাপক দাস। তাঁর মতে, এই প্রবণতাটি বিপজ্জনক।
বস্তুত, অধ্যাপক দাস বর্ণিত ত্রিস্তরীয় ভোট কারচুপি বাম আমলে বাংলায় দেখা যেত। যারই নাম ছিল ‘সায়েন্টিফিক রিগিং’। এই কারচুপি শুরু হয় ভোটার তালিকা সংশোধনের সময়। দ্বিতীয় স্তরে কারচুপি হত ভোটের দিন। নানা অছিলায় শাসক দল বিরোধীদের ভোটদানে বাধা সৃষ্টি করত। শেষ স্তরে গণনায় নির্বাচনী আধিকারিক ও পর্যবেক্ষকদের সহায়তায় কারচুপি ঘটত। বিজেপি-শাসিত রাজে্য ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের কেন্দ্রগুলিতে এই ত্রিস্তরীয় কারচুপির ছবি সংখ্যাতত্ত্বর বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছে অধ্যাপক দাসের পেপারে। অথচ আপাতভাবে এই ভোট কারচুপি নিয়ে কোনও হইচই হয়নি। সবটাই নীরবে অবাধ ও মুক্ত নির্বাচনের মোড়কে ঘটেছে। বামেদের এই কাজকেই ‘সায়েন্টিফিক রিগিং’ বলা হত। বিজেপি সেটাই সুচারুভাবে করতে শুরু করেছে বলে এখন আশঙ্কা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.