সুতীর্থ চক্রবর্তী: আইআইটি কানপুরের গবেষকের হিসেব অনুযায়ী আজ, ২০ এপ্রিল দেশে করোনার দ্বিতীয় পর্বের শিখর ছোঁয়ার কথা। অর্থাৎ, আজই দ্বিতীয় পর্বের সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ আমরা দেখতে পাব। আগামিকাল থেকে দৈনিক সংক্রমণের হার কমতে থাকবে। কমতে কমতে মে মাসের শেষে আক্রান্তের সংখ্যা ফের তলানিতে পৌঁছে যাবে।
একটি গাণিতিক মডেলের সাহায্যে আইআইটি কানপুরের গবেষক তাঁর সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। প্রথম পর্বের ক্ষেত্রে এই গাণিতিক মডেল থেকেই জানা গিয়েছিল, ফেব্রুয়ারিতে দেশে দৈনিক সংক্রমণ সবচেয়ে কম হবে। যেহেতু, এই গবেষকের গাণিতিক মডেলটি প্রথম পর্বের ক্ষেত্রে হুবহু মিলেছিল, তাই দ্বিতীয় পর্বে এসেও অনেকেই মডেলটিতে ভরসা রাখছে। এখন দেখার দ্বিতীয় পর্বে গবেষকের ভবিষ্যদ্বাণী মেলে কি না। সংবাদমাধ্যমেও কয়েকদিন আগে গবেষকের এই গাণিতিক মডেলটি নিয়ে যথেষ্ট হইচই হয়েছে। যদি প্রথম পর্বের মতো দ্বিতীয় পর্বেও গবেষকের গাণিতিক মডেল সঠিক হয়, তাহলে কাল, বুধবার থেকেই করোনার উদ্বেগ কিছুটা কমার কথা।
রাজ্যবাসীর করোনা নিয়ে অতিরিক্ত উদ্বেগের কিছুটা কারণ অবশ্যই এটা যে, এখনও বিধানসভা ভোটের তিনটি দফা বাকি। নির্বাচন কমিশন প্রচারের সময় কাটছাঁট করেছে। রাজনৈতিক দলগুলি নিজেরা আরও বেশি কাটছাঁট করতে শুরু করেছে। করোনার দ্বিতীয় পর্ব যদি সতি্য করেই আজ, মঙ্গলবার শিখর ছুঁয়ে ফেলেও, তাহলেও সতর্কতা বাড়ানোর যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। প্রথম পর্বের ক্ষেত্রে সেপ্টেম্বর মাসে সংক্রমণের শিখর যখন আমরা ছুঁয়েছিলাম, তখনও দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা এর অর্ধেকও ছিল না। আচমকা দৈনিক সংক্রমণ এতটা বাড়ায় সংকট দেখা দিয়েছে হাসপাতালের শয্যা, ওষুধ, টেস্টের কিট ও অক্সিজেনের। এটা যে কোনও সরকারের পক্ষেই উদ্বেগের।
কিন্তু দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা যত বাড়তে থাকে, তত সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা যেমন থাকে, আবার তেমন দ্রুত সংক্রমণ নেমে আসার আশ্বাসও থাকে। দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার অর্থ হল, বড় অংশের করোনা সংক্রমিত চিহ্নিত হয়ে যাওয়া। সংক্রমিতরা চিহ্নিত হয়ে নিভৃতাবাসে চলে গেলে অাবার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা কমে যায়। অর্থাৎ মোট সংক্রমণ কমতে থাকে। সংক্রমণ যত দ্রুত কমতে থাকবে, তত দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। এই যুক্তিতে বলা হচ্ছে, দ্বিতীয় পর্বে যেমন খুব দ্রুত সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ল, তেমন খুব দ্রুতই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। অর্থাৎ, দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা যখন কমতে থাকবে, তখন তা খুব দ্রুত কমে যাবে। এই যুক্তিতে আইআইটি কানপুরের গবেষক ভবিষ্যদ্বাণী করছেন যে, মে মাসের শেষের দিকে করোনা আবার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসবে।
সাধারণভাবে ভাইরাস বিশেষজ্ঞদের অভিমত হল, একটি ভাইরাস যখন দ্রুত সংক্রমণ ছড়ায়, তখন তা নিয়ন্ত্রণে আসতে আসতে ১২ সপ্তাহ লাগে। দ্বিতীয় পর্বে করোনার সংক্রমণ যদি মার্চ মাস থেকে ছড়াচ্ছে বলে ধরে নেওয়া যায়, তাহলে মে মাসের শেষে ১২ সপ্তাহ পূর্ণ হয়ে যাবে। তবে করোনার ক্ষেত্রে কোনও কথাই হলফ করে বলা যাচ্ছে না। কারণ, গত একবছরের উপর ভাইরাসটি যে খেলা দেখাচ্ছে, তাতে ভাইরাস বিশেষজ্ঞ এবং বিজ্ঞানীরা কার্যত দিশাহারা। ভাইরাসটি এমনভাবে তার রূপ পরিবর্তন করছে যে, কেউ কিছু বুঝেই উঠতে পারছে না। যেমন, দেশে ভাইরাসটির যে নতুন প্রকার সংক্রমণ ছড়াচ্ছে- বলা হচ্ছে, সেটি নাকি দু’বার রূপ পরিবর্তন করেছে। দু’বার রূপ পরিবর্তনের পর ভাইরাসটির সংক্রমণ ও মারণক্ষমতা বেড়েছে না কমেছে, সে ব্যাপারে এখনও কোনও স্পষ্ট সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না দেশের বিজ্ঞানীরা। ফলে আইআইটির গবেষক দ্বিতীয় পর্বের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসা নিয়ে যেকথা বলছেন, তা যে মিলে যাবে, এমনটা কোনওভাবেই বলা ঠিক নয়। দু’দফার রূপ পরিবর্তনের পর ভাইরাসটি আরও কতটা ভয়াবহ ও সংক্রামক হয়ে উঠেছে, সেটা সঠিকভাবে জানা যাচ্ছে না।
সম্প্রতি বিখ্যাত বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা ‘ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে জানা গিয়েছে, করোনাভাইরাস বাতাসে ছড়ায়। এটা ভাইরাসের কোন প্রকার, সে বিষয়ে আমরা এখনও সবিস্তার জানতে পারছি না। যদি সত্যি ভাইরাস বাতাসে ছড়ায়, তাহলে যে তার সংক্রমণ ক্ষমতা অনেক গুণ বেড়ে যাবে, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। ভাইরাস বাতাসে ছড়াতে থাকলে কোয়ারেন্টাইন বা নিভৃতাবাসের কোনও মূল্য থাকবে না। কেউ জনসমক্ষে না এসেও বাতাসের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টা মাস্ক পরে থাকাই হবে একমাত্র রক্ষাকবচ। ২৪ ঘণ্টা দেশের সমস্ত মানুষ মাস্ক পরে কাটাবে, এমনটা ভাবা অবাস্তব ও অস্বাভাবিক মনে হয়।
করোনার এই দ্বিতীয় পর্বের সংক্রমণের জন্য সরকারকে দায়ী করেও লাভ নেই। কারণ, ভাইরাসটির চরিত্র যখন বিজ্ঞানীদের বোঝার গণ্ডির বাইরে, তখন সরকারের পক্ষ থেকে আগাম ব্যবস্থা নেওয়ার কথা চিন্তা করাও সম্ভব নয়। প্রথম পর্বের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির ভূমিকা ছিল খুবই ইতিবাচক। কেন্দ্র ও রাজ্য পরস্পরের সঙ্গে সমন্বয় করে দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সফল হয়েছিল। ভারতের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর ভঙ্গুর অবস্থা নিয়ে গোটা বিশ্বজুড়েই যথেষ্ট উদ্বেগ ছিল। কিন্তু, কেন্দ্র ও রাজ্যের তৎপরতা সব উদ্বেগকেই ভ্রান্ত প্রমাণ করেছিল। আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রেই দেখেছি, যেভাবে রাতারাতি অসংখ্য কোভিড হাসপাতাল ও তার পরিকাঠামো নির্মাণ করে সরকার হাজার হাজার রোগীর উন্নত চিকিৎসার বন্দোবস্ত করেছিল, তা অকল্পনীয়। বহু সরকারি হাসপাতালে এমন পরিষেবা মিলেছিল, যা বেসরকারি ক্ষেত্রেও চিন্তা করা যায় না। এটা থেকে স্পষ্ট হয়েছিল যে, সরকার চাইলে সঠিক পরিষেবা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারে। ফলে দ্বিতীয় পর্বের ক্ষেত্রেও যে সরকার পরিস্থিতির পর্যালোচনা করে দ্রুত উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে, সে বিষয়ে ভরসা রাখা যায়। সেই প্রক্রিয়া চলছেও। শয্যা, অক্সিজেন, ওষুধ, টেস্টের কিট ইত্যাদির এই সংকট সাময়িক।
প্রাথমিকভাবে গোটা বিশ্বজুড়েই ধারণা ছিল, করোনার টিকা আসাতে পরিস্থিতির খুব দ্রুত পরিবর্তন হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যেসব দেশে টিকাকরণের কাজ অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে, সেখানে করোনার দ্বিতীয় বা তৃতীয় ঢেউ আসছে। যেমন, ইউরোপ ও আমেরিকায় জনসংখ্যার বড় অংশ করোনার টিকা পেয়ে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও ইউরোপের অধিকাংশ দেশে এবং আমেরিকাতে করোনার দ্বিতীয় বা তৃতীয় ঢেউ এসেছে। ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে এখন নতুন করে লকডাউন শুরু করতে হয়েছে। অথচ, এইসব দেশে ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ টিকাগ্রহণ করে ফেলেছে। টিকা নেওয়ার পরও অনেকে সংক্রমিত হচ্ছে। ভারতেও একই জিনিস ঘটছে। চিকিৎসক থেকে শুরু করে বহু সাধারণ মানুষ দু’ডোজ টিকা নেওয়ার পরও সংক্রমিত হচ্ছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং দু’ডোজ টিকার পরই সংক্রমিত। আমেরিকাতেও টিকাপ্রদানের কাজ শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেলেও দেখা যাচ্ছে যে, সেখানে করোনার তৃতীয় পর্বের ঢেউ এসে হাজির।
টিকা প্রদানের কাজ ভারতেও অনেকটা এগিয়েছে। ভারতের জনসংখ্যা ইউরোপ বা আমেরিকার তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। সরকারের যা পরিকল্পনা ছিল, তার চেয়ে সম্ভবত টিকাদানের গতি বেশি। সেই কারণে একটা পর্যায়ের পর টিকার ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। রাজ্যগুলি কেন্দ্রের কাছে চেয়েও টিকা পাচ্ছে না। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত ছিল টিকাদানের নীতি আরও ভাবনাচিন্তা করে রচনা করা। আপাতত প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে কেন্দ্র টিকাদানের নীতি নতুনভাবে সাজাচ্ছে। ১ মে থেকে ১৮ ঊর্ধ্বরাও টিকা পাওয়ার যোগ্য। টিকা করোনার নতুন প্রজাতিকে রোখার ক্ষেত্রে কতটা সক্ষম হবে, সে ব্যাপারে যতই সংশয় থাকুক না কেন, টিকাদান চালিয়ে যেতে হবে। দ্বিতীয় পর্ব আমরা নিশ্চিত করেই কাটিয়ে উঠব। যদি আইআইটির গবেষকের ভবিষ্যদ্বাণী সফল করে দু’-একদিনের মধে্য সংক্রমণের হার ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে, তাহলে সেটা হবে সবচেয়ে আশার খবর। ছ’সাত মাসের মধে্য সব মানুষ টিকা পেলে দেশকে নিশ্চিত করেই করোনামুক্ত হওয়ার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.