একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যাপ্তি ছিল বিশ্বের ছ’ভাগের একভাগ। ইউরোপের পূর্বদিকের অর্ধেক, আর এশিয়ার উত্তরের এক-তৃতীয়াংশ। ক্ষেত্রফলে ভারতের সাত গুণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আড়াই গুণ। এর পরেও ‘সাবেক’ সোভিয়েত বলতে আমরা রাশিয়া-ই বুঝে এসেছি! কোনও ছাত্রপাঠ্য ইতিহাস আমাদের পড়ায়নি যে, ইউক্রেন স্বাধীন হতে চেয়েছিল বহুদিন ধরে। লিখছেন শুভময় মিত্র
বছর পাঁচেক পরে কোনও একটি নির্বাচনে বঙ্গ বামফ্রন্টের ভোট বেড়েছে। একই সঙ্গে চিলিতে নতুন বামমনস্ক রাষ্ট্রনায়ক হতে চলেছেন গাব্রিয়েল বরিস, যাঁর বয়স পঁয়ত্রিশ। সুতরাং, কলকাতার আবহাওয়া খানিকটা মেঘলা হলেও বাম রোমান্টিসিজমে মিঠে রোদ্দুর। আগামী শতাধিক পুরনির্বাচনে বামেদের ভোট কতটা বাড়বে, আসন দুই বা তিন অঙ্কে পৌঁছবে কি না, এই নিয়ে আলোচনা অনেক বেশি উজ্জীবিত। শুরুতে ‘না’ বলেও শেষমেশ শিলিগুড়িতে প্রার্থী হতে রাজি হয়েছেন অশোক ভট্টাচার্য। নবীন-প্রবীণের মেলবন্ধনে এই বঙ্গে ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী’ হওয়ার প্রাথমিক শর্তপূরণ সম্পন্ন। অর্থাৎ বাম প্রেক্ষিত প্রস্তুত। অন্যদিকে, এটাও সত্য যে, নির্বাচনী গণতন্ত্রের ঘেরাটোপে বামপন্থার বেশ খানিকটা দমবন্ধ হওয়ার দশা। লম্বা লড়াইয়ের শেষে সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের ইতিহাস এখন অতীত। বরং ধর্মান্ধ দক্ষিণপন্থীরা রাষ্ট্র দখলে মশগুল, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় ত্রাহি ত্রাহি রব। ইরাক, সিরিয়া পার করে এখন ফিরে দেখা আফগানিস্তান। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভ্লাদিমির পুতিন, কিংবা এরদোগান- কেউ আর জমি ছাড়তে রাজি নন। ফলে, গণতন্ত্র ‘ভ্যানিশ’ বলে শুধু চিন কিংবা উত্তর কোরিয়াকে দোষ দিলে চলবে না। আজ, এই প্রসঙ্গেই ফিরে দেখা, সমাজতান্ত্রিক দেশ রূপে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাদিবস।
‘ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক’, সংক্ষেপে ‘ইউএসএসআর’। শব্দটি প্রায় ভুলতে বসেছি আমরা। তবে ইতিহাস বিকৃত হলে কিংবা কথার প্যাঁচে তা বিক্রিত হলেও তো কয়েকটি দিনকে আর ক্যালেন্ডার থেকে মোছা যায় না। তেমনই ৩০ ডিসেম্বর, শতবর্ষে পা রাখার মাহেন্দ্রক্ষণ। সোজা হিসাবে, সামনের এক বছর যাবৎ সোভিয়েতের শতবর্ষ উদ্যাপিত হওয়ার সময়। অবশ্য এই প্রসঙ্গে ২৬ ডিসেম্বর ১৯৯১-এর কথাও আসবে। সেদিন সরকারিভাবে সোভিয়েতের পতন না হলে বর্তমান দুনিয়া হয়তো অন্যরকম হত। তবে, না-পাড়ি দেওয়া পথের কথা কল্পবিজ্ঞানের অংশ, ইতিহাসের নয়।
সোভিয়েত গঠন প্রসঙ্গে ইতিহাসের পাতায় ১৯১৭ সালের নভেম্বর বিপ্লব, রেড আর্মি, কমরেড লেনিনের আহ্বান এই বিষয়গুলি জরুরি নিঃসন্দেহে। তবে তাঁর আগে সামান্য ভূগোল ঝালিয়ে নেওয়া যাক। এর কারণ, সোভিয়েতের বিপুল ভৌগোলিক বিস্তৃতি। রাজনীতির ধারায় একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এলাকা দখল। এখনকার দিনে যেমন তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের সীমানা ছাড়িয়ে ত্রিপুরা কিংবা গোয়ায় পৌঁছনোর চেষ্টা করছে, যেমন করে বিজেপি মনে করে আগামী দিনে তাদের ভাবনা ভাবতে শিখবে নেপাল বা শ্রীলঙ্কার মানুষ, তেমনই কমিউনিস্টরাও চেয়েছিল বিশ্বজোড়া মানুষের মনে স্থান করে নিতে। মানবজমিন আর মন-জমি সম্পর্কিত। তাই গত শতকের চারের দশকে যখন সোভিয়েতের ব্যাপ্তি সব থেকে বেশি, তা ছিল, অবিশ্বাস্য শোনালেও বিশ্বের ছ’ভাগের একভাগ। ইউরোপের পূর্বদিকের অর্ধেক, আর এশিয়ার উত্তরের এক-তৃতীয়াংশ। ক্ষেত্রফলে ভারতের সাত গুণ আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আড়াই গুণ। এর সঙ্গে এশিয়ার আফগানিস্তান বা পূর্ব ইউরোপের বেশ কিছু দেশের উপর কূটনৈতিক আধিপত্যের কথা ভুলে গেলেও চলবে না। অর্থাৎ সময় (প্রায় সাত দশক), ক্ষেত্র (পৃথিবীর ছ’ভাগের একভাগ) এবং প্রভাব (‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ ও আমেরিকার চোখে চোখ রেখে অর্ধেক দুনিয়ার দখলদারি) মিলিয়ে সোভিয়েত যে বিশ্ব-বিবর্তনের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, তা মেনে নিতেই হবে।
অবশ্যই সমালোচনার ক্ষেত্র আছে প্রচুর, কিন্তু মোটের উপর এক সাম্যবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখানো সোভিয়েত মঙ্গলকামী বিশ্বব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। অবশ্যই এখনকার দিনে পশ্চিম ইউরোপের কল্যাণকামী নির্বাচনী গণতন্ত্র এর থেকেও উন্নত। কিন্তু সেটুকু বাদ দিলে বাকি বিশ্বকে মুনাফাভিত্তিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে উন্নয়নের পথ দেখিয়েছে সোভিয়েত। ইতিহাস তো নেট তোলপাড় করলেও মেলে!
এই প্রসঙ্গে ফিরে দেখা যাক পশ্চিমবঙ্গে বাম রাজত্বের শুরুর সময়টাও। তখন ভূমিসংস্কারের যে-আলোচনা, তাতে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের প্রভাব কতটা ছিল সে নিয়ে গভীর গবেষণা হতে পারে। ১৯১৭ সালে লেনিন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ‘শান্তি, জমি এবং রুটি’-র (পিস, ল্যান্ড অ্যান্ড ব্রেড)। সেই জমির কথা অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে প্রান্তিক ভাগচাষিদের প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছিল সাতের দশকের শেষে। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট রাজত্বে যে ‘সমবায় আন্দোলন’-এর কথা বলা হত বারবার, তার পূর্বসূত্রেও হয়তো সংযুক্ত সোভিয়েতের কথা আসবে।
তবে এটাও আজ বলতে হবে যে, মোটের উপর সোভিয়েত ইউনিয়নকে আমরা চিনেছি ‘রাশিয়া’ নামে। এর কারণও ভুলে গেলে চলবে না। যে-রাশিয়াকে আমরা দেখছি হালে, তার দখলদারি ছিল সোভিয়েতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। কতটুকু আমরা জানতাম বেলারুশ কিংবা আজারবাইজান নিয়ে? চেচনিয়া সীমান্তে এখনও রাশিয়ার যে-আগ্রাসন, তা তো জানা। ‘শস্যক্ষেত্র’ ইউক্রেনের কথা আমাদের ভূগোল বইয়ে অন্তত একপাতা জুড়ে থাকত। কিন্তু কোনও ইতিহাস বই কি কখনও আমাদের পড়িয়েছিল ইউক্রেন ‘স্বাধীন’ হতে চায়, চেয়েছিল বহুকাল ধরে? সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের ব্যর্থতা এইখানেই। মানুষের ‘ভাল’ করার জন্য সার্থক লড়াই ততটা গুরুত্বপূর্ণ থাকে না মানুষের জীবনযাপনের অধিকার সুরক্ষিত হলে। তখন সুতো ছাড়তে হয়। ব্রেজনেভ বা গর্বাচেভ বুঝেছিলেন। তাই অনেক কম যুদ্ধে ভেঙেছিল সোভিয়েত। সেদিন ভ্লাদিমির পুতিনের মতো কোনও সবল রাষ্ট্রনায়ক ক্ষমতায় থাকলে হয়তো অনেক বেশি কষ্ট সহ্য করতে হত সোভিয়েতের অংশীদারদের।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন পনেরোটি স্বাধীন দেশের সমাহার। দ্বন্দ্ব যেমন ছিল বা আছে, তেমনই খুব বেশি রক্তক্ষয়ী প্রক্রিয়ায় কিন্তু হয়নি ভাঙন। তুলনায় সাবেক যুগোস্লাভিয়া ভেঙে যে-ছ’টি দেশ, তাতে ত্রাস ও হিংসার ঘটনা ঘটেছে অনেক বেশি। আগামীর ইতিহাসে অবশ্যই কোনও একদিন হয়তো চিনের কথা আসবে। একদিকে, চিনের জীবনযাত্রার মান বিশ্বের অনেক দেশের থেকে উন্নত। দুনিয়াজোড়া তাদের দাপট। অন্যদিকে, বারবার প্রশ্ন ওঠে সেখানকার গণতান্ত্রিক মানবাধিকার নিয়ে। অন্য স্রোতে যখন লং মার্চ শুরু হবে, তখন কমিউনিস্ট চিন কীভাবে তা সামলায়, সোভিয়েতের শতবর্ষ অবশ্যই সেই প্রশ্ন তোলার দিন।
অর্থাৎ শতবর্ষের অধিক সময় পার করা সমাজবাদী ভাবনা এখনকার আন্তর্জালভিত্তিক বিশ্বভাবনায় কীভাবে বিবর্তিত হবে, তা সমাজবিজ্ঞানের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য প্রশ্ন। একসময় ‘সনাতন জীর্ণ কু-আচার/ চূর্ণ করি জাগো জনগণ/ ঘুচাও এ দৈন্য হাহাকার/ জীবন-মরণ করি পণ’ কিংবা ‘ভেদী অনশন মৃত্যু তুষার তুফান,/ প্রতি নগর হতে গ্রামাঞ্চল/ কমরেড লেনিনের আহ্বান,/ চলে মুক্তিসেনা দল’- এই গানগুলি জনগণকে যতটা উদ্বেল করে তুলত, সেই দিন বদলেছে। এখনকার স্মরণদিন নতুন বামভাবনা উদ্যাপনের।
আর, বাংলার পটপ্রেক্ষায় অবশ্যই নজর থাকবে দু’টি দিকে। এক, এই দিনটি আমাদের না হয় কোনওক্রমে শেষ মুহূর্তে মনে পড়ল, পশ্চিমবঙ্গের বাম নেতৃত্বেরও তা স্মরণে থাকলে মঙ্গল। ইতিহাস ভুলে ইট-বালি, চুন-সুরকির লোকাল কমিটি হয়ে গেলে বামদলের ভবিষ্যতে শূন্যই লেখা থাকে। দ্বিতীয়, বিবর্তিত বামপন্থা নিয়ে তাদের কোন নেতা আগামীর নেতৃত্ব দেবেন বিধাননগর থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত? কমিউনিস্ট আন্দোলন মানুষের, কিন্তু তার রাশ থাকে নেতৃত্বের হাতে। গত প্রায় এক দশক ধরে নেতা খুঁজে পেতে ব্যর্থ বঙ্গবামবাহিনী। কমরেড লেনিন তো ভিন্ন নামে, ভিন্ন রূপে অবতার হয়ে দেখা দেন শ্রমজীবী মানুষের হয়ে লড়াই করতে। সোভিয়েতের শতবর্ষের বছর কি বাংলায় সিপিআইএমের নতুন নেতা খুঁজে দেবে?
(মতামত ব্যক্তিগত)
লেখক কলকাতা আইএসআইয়ের অধ্যাপক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.