Advertisement
Advertisement
Afghanistan

ইতিহাসের উত্তরাধিকার: আফগানিস্তানে কেন বারবারই মুখ পুড়েছে ব্রিটেন, আমেরিকা বা সোভিয়েত ইউনিয়নের?

এই মুখ পোড়ার কাহিনি গত ১৮০ বছর ধরেই চলে আসছে।

US army retreat from Afghanistan resembles same age old story | Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:July 11, 2021 1:41 pm
  • Updated:July 11, 2021 1:41 pm  

কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়: ১৮৪২। ১৩ জানুয়ারি। শ্বেতশুভ্র হিন্দুকুশ পর্বতমালার চূড়াগুলোয় বিকেলের অস্তরাগ। দ্রুত দুর্গম পার্বত্য আফগান শহরে সন্ধে নেমে আসছে। তখনই জালালাবাদ দুর্গের প্রাচীর থেকে এক প্রহরারত অফিসারের নজরে পড়ল বিন্দুটা। বিন্দুটা চলমান। গিরিপথ থেকে বেরিয়ে সেটা দুর্গের দিকেই আসছে। আর একটু কাছে আসতেই বোঝা গেল, এক মৃতপ্রায় টাট্টুঘোড়ায় চেপে এক ততোধিক মৃতপ্রায় সৈনিক এগিয়ে আসছেন। সারা শরীর রক্তমাখা।

জালালাবাদ দুর্গের সেনারা জানত, ১৮৩৯ সালে হিন্দুকুশের গিরিপথ পেরিয়ে ৯০ মাইল দূরের আফগান (Afghanistan) রাজধানী কাবুলে (Kabul) ২১ হাজারের এক সেনাদল গিয়েছে। তারা ভাবল, এই আহত সৈনিক হয়তো সেই বাহিনীরই অগ্রভাগের অংশ। ধরাধরি করে তাঁকে ঘোড়া থেকে নামাতে নামাতে জিজ্ঞেস করল, ‘সেনাবাহিনী কই?’
সৈনিক কোনওমতে জবাব দিলেন, ‘আমিই সেনাবাহিনী।’ স্তম্ভিত সেনাদের জানালেন, তাঁর নাম উইলিয়াম ব্রাইডন। বেঙ্গল আর্মির অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জেন্ট তিনি। তারপরই জ্ঞান হারালেন। কে এই ব্রাইডন? কাবুল থেকে জালালবাদ আসতে তাঁর এমন হালই বা হল কেন? আদতে ব্রাইডনের এই ‘গ্রেট এসকেপ’ আধুনিক আফগানিস্তানে এক নয়া ইতিহাসের সূচনা করেছিল।

Advertisement

[আরও পড়ুন: Afghanistan: তালিবানের দখলে কান্দাহারও, দ্রুত ৫০ কূটনীতিবিদকে দেশে ফেরাল ভারত]

সে প্রসঙ্গে আসছি আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির ঝটিকা পরিক্রমা সেরে। মস্কোয় রুশ (Russia ) সরকারের সঙ্গে বৈঠকে তালিবান (Taliban)সম্প্রতি জানিয়ে দিয়েছে– দেশের ৮৫% এখন তাদের অধীনস্থ। এদিকে নির্দিষ্ট সময়ের বেশ কয়েক দিন আগে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করা হবে বলে নিশ্চিত করেছেন মার্কিন (US) প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন (Joe Biden)। ইতিমধ্যেই বাগরাম বিমানঘাঁটি ছেড়ে যেতে শুরু করেছে মার্কিন সৈন্যরা। ২০০১-এর ১১ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ারে তালিবান হামলার পর গত ২০ বছর ধরে আফগান মাটিতে ঘাঁটি গেড়ে ছিল মার্কিন সৈন্যরা। বাগরাম সেই অন্যতম ঘাঁটি, যেখান থেকে তারা তালিবান এবং আল কায়েদার ওপর আক্রমণ চালিয়েছে নিরন্তর। তাই মার্কিন সেনার বাগরাম ছেড়ে যাওয়া অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু দেশের সেনাবাহিনীর আর কোনও নারী-পুরুষের প্রাণ এই মাটিতে হারাতে চান না বাইডেন। তাঁর মতে, আফগানিস্তানের দায়িত্ব নিতে হবে সে দেশের নেতাদেরই। প্রশাসনকে কড়া হাতে তালিবান মোকাবিলা করতে হবে। মার্কিন সাহায্যে তৈরি কাবুল প্রশাসনের সেই ক্ষমতা রয়েছে বলে দৃঢ় বিশ্বাস বাইডেনের। কিন্তু কেন সমস্ত পরাশক্তিই আফগান মাটি ছেড়ে ‘পালাতে’ বাধ্য হয় বারবার? কী বলছে ইতিহাস?

উনিশ শতকে মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার জার সাম্রাজ্য থাবা বাড়িয়েছে। অধুনা কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিরঘিজস্তান, তাজিকিস্তান– একের পর এক তাদের করতলগত। তৎকালীন ব্রিটিশ বিদেশমন্ত্রী লর্ড পামারস্টোন আর ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণকারী বোর্ড অফ কন্ট্রোলের প্রেসিডেন্ট স্যর জন হবহাউসের দৃঢ় সন্দেহ ছিল। মধ্য এশিয়ায় যেভাবে রাশিয়া সাম্রাজ্য বিস্তার করছে, তাতে স্বাভাবিকভাবেই মস্কোর চোখ পড়বে পাথুরে মরুভূমির দেশ আফগানিস্তানের উপর। পাশেই ব্রিটিশ ভারত। ফলে রুশ-অধিকৃত আফগানিস্তান থেকে ব্রিটিশ ভারতে হামলা হতেই পারে। এই সাত-পাঁচ ভেবে লন্ডন তার সাম্রাজ্য খোয়ানোর আশঙ্কায় সদা-সর্বদা সিঁটিয়ে থাকত। ইতিহাসে তৎকালীন বিশ্বের দুই পরাশক্তির এই ছায়াযুদ্ধকে ‘দ্য গ্রেট গেম’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে (যদিও একমাত্র রুশ জার প্রথম পল-ই ১৮০০ সালে কসাক সেনাদল পাঠিয়ে ভারত আক্রমণের পরিকল্পনা করেন যা ‘পলের ভারত অভিযান’ বলে পরিচিত, কিন্তু সেটাও বানচাল হয়ে যায় ১৮০১ সালের ২৩ মার্চ রাতে সেন্ট পিটার্সবার্গে নবনির্মিত সেন্ট মাইকেল কাসলে তাঁর হত্যা হওয়ায়)।

[আরও পড়ুন: রাশিয়ার হ্যাকার হানায় অতিষ্ঠ আমেরিকা, কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি বাইডেনের]

এই টালমাটাল অবস্থায়, ১৮৩৭ সালের ডিসেম্বরে, তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড অকল্যান্ড (যাঁর প্রকৃত নাম জর্জ ইডেন। ১৮৪১ সালে এঁর নামে তৎকালীন নিউজিল্যান্ডের রাজধানীর নাম ‘অকল্যান্ড’ রাখা হয়। তাঁরই লেখিকা বোন এমিলি ইডেনের নামে ‘ইডেন গার্ডেন্স’ নামকরণ করা হয়) খবর পেলেন– বছর তিরিশেকের বহু-ভাষাবিদ রুশ দূত কাউন্ট জন প্রস্পার উইটকিউইজ কাবুলে আফগান আমির দোস্ত্‌ মহম্মদ বরাকজাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে হাজির হয়েছেন। ক্রুদ্ধ লর্ড অকল্যান্ড ১৮৩৮ সালের ২০ জানুয়ারি রুশ দূতকে কাবুল থেকে বিদায় করতে বলে দোস্ত্‌ মহম্মদকে চিঠি লিখলেন। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হল। এপ্রিল মাসে ব্রিটিশ দূতকেই কাবুল থেকে বার করে দেওয়া হল!

অপমানের শোধ নিতে লর্ড অকল্যান্ড অন্য চাল চাললেন। ১৮০৯ সালে কাবুলের তখ্‌ত থেকে বিতাড়িত শাহ সুজা ১৮১৮ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আশ্রয়ে ভারতে ছিলেন। ইংরেজের আজ্ঞাবহ হবে ভেবে সুজাকেই কাবুলের বৈধ আমির ঘোষণা করে বসলেন অকল্যান্ড। নিষ্ঠুরতা আর শয়তানির জন্য আফগানরা দু’চক্ষে দেখতে পারত না সুজাকে। কিন্তু
পাকে-চক্রে সুজা-ই হয়ে উঠলেন আফগানিস্তানে ইংরেজদের ‘পোস্টার বয়’।

১৮৩৯ সালে শুরু হল প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধ। ওই বছরের ৭ আগস্ট ইংরেজ সেনা গিয়ে দোস্ত্‌ মহম্মদকে ক্ষমতাচ্যুত করে শাহ সুজাকে তিন দশক বাদে ফের তখ্‌তে বসায়। এদিকে ইংরেজ সেনা অফিসাররা তঁাদের পরিবার নিয়ে গেলেন কাবুলে। স্বাধীনচেতা আফগানরা বুঝল, ইংরেজরা দীর্ঘদিন থাকার মতলবে এসেছে। একে সুজার লাগামছাড়া অত্যাচার, অন্যদিকে ইংরেজদের এই হুকুমত আফগানদের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিল। ১৮৪১ সালের ২৩ ডিসেম্বর কাবুলে মুখ্য ব্রিটিশ রাজনৈতিক প্রতিনিধি স্যর উইলিয়াম হে ম্যাকনাগটেন দোস্ত্‌ মহম্মদের ছেলে আকবর খানের হাতে খুন হলেন। এর মাস দেড়েক আগে ২ নভেম্বর রাতে ম্যাকনাগটেনের সহকারী স্যর আলেকজান্ডার বার্নেস কাবুলে নিজের বাড়িতে ভাই চার্লস আর মেজর উইলিয়াম ব্রাডফুট-সহ উত্তেজিত জনতার হাতে খুন হন। পরদিন কাবুল বাজারে তিনজনের কাটা মুণ্ড দেখানো হয়।
এই দুই রাজনৈতিক প্রতিনিধির হত্যার পর ব্রিটিশ সেনাবাহিনী আর কাবুলে থাকতে ভরসা পায়নি।

১৮৪২-এর ৫ জানুয়ারি ৯০ মাইল দূরের জালালাবাদ ঘাঁটির দিকে রওনা দেয় সাড়ে চার হাজার ইংরেজ সেনা আর তাদের হাজার বারো সহযোগী। কিন্তু বরফ ঢাকা গিরিপথে আফগান বাহিনীর মুহুর্মুহু হামলায় গোটা সেনাদল নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। নারী আর শিশুদের বন্দি করে কাবুলে নিয়ে যাওয়া হয়। কেবলমাত্র মারাত্মক আহত অবস্থায় সেনাবাহিনীর ডাক্তার উইলিয়াম ব্রাইডন কোনওমতে জালালাবাদ পৌঁছন। ব্রিটিশ সাহায্য ছাড়া শাহ সুজা-ও টিকতে পারলেন না। মাস তিনেক বাদেই ৫ এপ্রিল কাবুলের দক্ষিণে বালা হিসার কেল্লার বাইরে তাঁকে খুন করা হল। যে দোস্ত্‌ মহম্মদ খানকে তখ্‌ত থেকে সরাতে এত কাণ্ড ব্রিটিশ করল, সেই তাঁকেই ১৮৪৩ সালে আমির হিসাবে মেনে নিতে হল। ফলে প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে সবদিক থেকেই ইংরেজদের মুখ পুড়ল।

ইতিহাস বলছে, এই মুখ পোড়ার কাহিনি গত ১৮০ বছর ধরেই চলে আসছে। ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র– সব পরাশক্তিরই একই হাল হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আশ্চর্যজনকভাবে প্রতিবারই এক কাহিনি। শুধু কুশীলবরা বদলে যাচ্ছে। প্রথমে বিদেশি শক্তি তাদের উন্নত প্রযুক্তি ও আধুনিক যুদ্ধবিদ্যার সাহায্যে জিতে কাবুল, কান্দাহার, হিরাট, মাজার-ই-শরিফের মতো বড় শহরগুলো দখল করছে, বিদ্রোহীরা পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু ধীরে ধীরে পাল্লাভারী হচ্ছে বিদ্রোহীদের। চোরাগোপ্তা হানা ক্রমশ বদলে যাচ্ছে বড় হামলায়। বহিরাগত শক্তির দীর্ঘ রক্তক্ষরণে বাধ্য হয়ে ধীরে রণাঙ্গন থেকে সরে যাচ্ছে। ব্রিটিশদের থেকে শিক্ষা নিয়ে ১৯৮৮-’৮৯ সালে পর্যায়ক্রমে ন’মাস ধরে সোভিয়েত বাহিনী সরতে থাকে।

বাগরাম বিমানঘাঁটির নয়া কমান্ডার জেনারেল মির আসাদুল্লা কোহিস্তানি নিজেই জানতেন না, বাগরাম ছেড়ে এত তাড়াতাড়ি মার্কিনিরা চলে যাবে! তঁার কথায়, আগের রাত পর্যন্ত মার্কিনিরা আমাদের সঙ্গে পরিকল্পনা করল। বৃহস্পতিবার সন্ধে সাড়ে ৭টা নাগাদ শেষকথা হয়। তারপর আর কোনও সংযোগ হয়নি। কিন্তু শুক্রবার সকালে দেখলাম তারা কেউ-ই নেই!
মার্কিন সেনা যে রাত ৩টে নাগাদ বাগরাম ছাড়বে, তা বস্তুত কাকপক্ষীও জানত না। ভোরবেলা হিন্দুকুশের পাদদেশে বিশাল কংক্রিটের প্রাচীরঘেরা চত্বর খাঁ খাঁ করছে দেখে পিলপিল করে স্থানীয় বাসিন্দারা ঢুকে পড়ে আর অফিসের কম্পিউটার থেকে রান্নাঘরের বাসন পর্যন্ত লুঠ করে নিয়ে যেতে শুরু করে। খবর পেয়ে আফগান সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়।

ব্রিটেন যেমন শাহ সুজাকে বসিয়েছিল, আটের দশকে তেমনই মস্কো বসিয়েছিল পর্যায়ক্রমে বাবরাক কার্মাল আর নাজিমুল্লা আহমেদজাইকে। কিন্তু পার্বত্য উপজাতির যোদ্ধা বা জিহাদি কারও সঙ্গেই এসব বাইরের শক্তির মদতপুষ্ট প্রশাসন টিকতে পারছে না। যেই বহিঃশক্তির ক্রাচটা সরে যাচ্ছে, অমনি হুড়মুড়িয়ে তাসের ঘরের মতো এরা ভেঙে পড়ছে। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত বাহিনী প্রত্যাহারের পর নাজিব সরকার টিকেছিল ১৯৯২ অবধি। বর্তমানে পশ্চিমি মদতপুষ্ট আশরাফ গনি সরকার নিয়েও বিশেষ কেউ আশা রাখছে না। দেশের ৪২১টি জেলার শ’-দুই জেলা ইতিমধ্যেই তালিবানদের দখলে!

১৯১৯ সালে তৃতীয় আফগান যুদ্ধেই ব্রিটেনের ৭০ লক্ষ পাউন্ড খরচ হয়। আজকের দিনের হিসাবে সেটা কম নয়। একটা হিসাব বলছে, ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৬ অবধি আফগান অভিযানে মস্কোর ১৮০০ কোটি রুবল খরচ হয়। সোভিয়েত অর্থনীতি ভেঙে পড়ার পিছনে এই ব্যর্থ আফগান অ্যাডভঞ্চারের ভূমিকাও কম নয় বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। আর ওয়াশিংটন তো গত বিশ বছরে এক লক্ষ কোটি ডলারের উপর খরচ করে বসে আছে। করোনাদীর্ণ সময়ে যেখানে বিশ্ব-অর্থনীতি চাঙ্গা করার ভ্যাকসিন খোঁজা হচ্ছে, সেখানে এই অর্থব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement