বিরোধী কণ্ঠস্বর না থাকলে যা হয়, তা-ই যেন হল বাংলাদেশে। ইস্তফা দিয়ে, দেশ ছেড়ে, পালাতে বাধ্য হলেন শেখ হাসিনা। কেন এত জনরোষ? শুধু সরকারি চাকরিতে কোটা-বিরোধিতায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে? তা নয়। লিখছেন সৈয়দ তানভীর নাসরিন।
৫ আগস্টের ঢাকা কী শেখাল?
ক) দুর্নীতির দায়ে বিরোধীদের জেলে ভরে দিয়ে একা-ই নির্বাচন করলে সমস্যার সমাধান হয় না। গণতন্ত্রে বিরোধীদেরও পরিসর দিতে হয়। জেনে রাখা ভাল, ভারতে যেমন ইডি রাজনৈতিক বিরোধীদের শায়েস্তা করার হাতিয়ার বলে অভিযোগ, বাংলাদেশে ‘দু.দ.ক’ বা ‘দুর্নীতি দমন কমিশন’-এর নামেও সবাই একইরকম তটস্থ থাকত।
খ) সাংসদ থেকে শহরের মেয়র– সবই আমার চাই, বিরোধীদের জন্য কিছুই থাকবে না– এটা গণতন্ত্রের জন্য কাঙ্ক্ষিত মডেল হতে পারে না।
গ) কলম্বোয়ে গোটাবায়া রাজাপক্ষ-র পরিণতি, বা ঢাকায় শেখ হাসিনার বাসভবন বিক্ষোভকারীদের ‘দখলে চলে যাওয়া’ বলে আমজনতাকে ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ নেওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার আওয়ামি লিগ সরকারের পতনের পরে বিক্ষোভকারীদের হাতে ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি ভাঙচুরের ভিজুয়াল অবশ্যই পীড়াদায়ক। ইতিহাস এবং সমাজবিজ্ঞানের সামান্য ছাত্রী হিসাবে আমি মনে করি, গত শতকের আটের দশকে পূর্ব ইউরোপে লেনিনের মূর্তি উপড়ে ফেলার দৃশ্য যেমন আসলে কিছু দেয়নি, হয়তো সাময়িক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ মাত্র ছিল, তেমনই ৫ আগস্ট, সোমবার, ‘বঙ্গবন্ধু’-র মূর্তি ভাঙাও বিক্ষিপ্ত ঘটনামাত্র। যে-ব্যক্তি পাকিস্তানের (Pakistan) সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তঁাকে এইভাবে হয়তো ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না। ঠিক যেমন– ‘বঙ্গবন্ধু’ যেভাবে বাংলাদেশকে মুসলিমদের পাশাপাশি অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের দেশ হিসাবেও ঘোষণা করেছিলেন– সেই সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়টি যেন কেউ ভুলে না যায়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে ‘বঙ্গবন্ধু’-র কন্যা শেখ হাসিনাকে (Sheikh Hasina), যিনি একসময় সামরিক শাসনের প্রতিবাদ করে বাংলাদেশে (Bangladesh) গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন, কেন আবার সেনার হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েই দেশ ছেড়ে চলে যেতে হল? কেন তিনি এতটা জনরোষের মুখোমুখি পড়ে গেলেন? সেটা কি শুধুই চাকরিতে কোটার বিরোধিতায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে? মনে করি, তা নয়। আসলে, পশ্চিমের দেশগুলি আমাদের যে-গণতন্ত্র শিখিয়েছে, সেই অনুযায়ী যে কোনও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সবকিছু একটি দলের কাছে চলে যেতে পারে না। বিরোধী রাজনৈতিক দল হোক বা বিরোধী ‘কণ্ঠস্বর’, সবকিছুর জায়গা থাকা উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক, যিনি ভারতেও যথেষ্ট পরিচিত, তিনি যখন পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অধিকারের কথা বলতে গিয়ে বিদায়ী সরকারের রোষানলে পড়েছিলেন, এবং ঢাকা বিমানবন্দর থেকে তঁাকে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তখনই প্রমাদ গুনেছিলাম, কারণ গণতন্ত্রে সমালোচনা থাকবেই। সেই সমালোচনা থেকে সংশোধনের সুযোগ নিতে হবে। কিন্তু তা না-করে যদি সর্বদা ‘আমরা-ওরা’র তত্ত্বে কেউ বিভোর থাকে এবং ‘আদার’-কে শত্রু ঠাওরায়, তাহলে মুশকিল। ব্যক্তিগতভাবে নেহরু-গান্ধীর গণতন্ত্রের মডেলে আমি এত বিশ্বাসী এবং বহুস্বরের মধ্যে ‘সংখ্যালঘু স্বর’-কে জায়গা দেওয়ার দাবিতে অনড় যে, গণতন্ত্রের এই ধরনের বিচ্যুতি অস্বস্তি দেয়।
দক্ষিণ এশিয়ায় কাজ করার নিজ-অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, বিরোধীদের জেলে পুরে নির্বাচন করে রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ‘মডেল’ খুব কার্যকর নয়। সমাজবিজ্ঞানের সামান্য ছাত্রী হিসাবে আমি রাজাপক্ষদের কলম্বো থেকে মালদ্বীপ হয়ে পশ্চিম এশিয়ার দিকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনার সাক্ষী ছিলাম। আবার, সোমবারও ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে শেখ হাসিনার উড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখলাম। যত দেখি, তত প্রশ্ন জাগে একবার ক্ষমতায় গেলে কেন শেখার আগ্রহ এত কমে যায়? মালয়েশিয়ায় দোর্দণ্ডপ্রতাপ নাজিব রাজাক-কে অশীতিপর মহাথির মহম্মদের কাছে হেরে যেতে দেখেছি। শেখ হাসিনা অবশ্য নির্বাচনে হারলেন না, কারণ তঁার দল গত দু’টি নির্বাচনে আর মানুষের রায় জানার জন্য অপেক্ষাই করেনি। এই যে একটা মাত্র ভোট, আমজনতা যেটা দিয়ে সন্তুষ্ট থাকে, সেটাও ছিনিয়ে নিলে– কতটা ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে পারে, তা হয়তো ঢাকার রাজপথ দেখিয়ে দিল।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিকরা শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ দেখে কী পাঠ নেবেন তা জানি না, কিন্তু নেওয়া উচিত এটুকু বলতে পারি। বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর তৈরি করে দেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার থাকবে, না নতুন কোনও রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ঘটবে, সেদিকে নজর থাকবে। চিন্তায় থাকব– এই পালাবদলের সময় মুজিবের মূর্তির মতো সংখ্যালঘুদের গায়েও যেন কোনও আঘাত না নেমে আসে। কারণ, সেটা প্রতিবেশী হিসাবে ভারতের জন্য, আমাদের জন্য উদ্বেগজনক হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.