২০১৫ নাগাদ রাষ্ট্র সংঘের প্রতিটি সদস্য-রাষ্ট্র সংকল্প করেছিল– ২০৩০ নাগাদ ক্ষুধাহীন, দারিদ্রহীন দুনিয়ার। তা কি সম্ভব হবে? না। রিপোর্ট বলছে, ওই সময়ে আনুমানিক ৬৭ কোটি ক্ষুধার্ত মানুষ থাকবে এই গ্রহে, যা দুনিয়ার জনসংখ্যার প্রায় ৮ শতাংশ। লিখছেন অতনু বিশ্বাস।
দারিদ্র এবং ক্ষুধা-ই বোধকরি মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। দুনিয়া জুড়ে শান্তি-সমৃদ্ধি আসতে পারে এর প্রতিকার হলেই। দুনিয়ার সার্বিক শান্তি ও সমৃদ্ধি স্থাপনের লক্ষ্যে অসাম্য দূর করতে তাই ক্ষুধাহীন, দারিদ্রহীন দুনিয়া সৃষ্টির লক্ষ্যমাত্রা তৈরি করে চলে মানুষ। প্রায় এক দশক আগে ঢাকঢোল পিটিয়ে এমনই এক পথনির্দেশ করতে সচেষ্ট হয় রাষ্ট্র সংঘ। এ এমনই এক দুনিয়া সৃষ্টির অভীপ্সা, যার রূপবৈশিষ্ট্য শুধুমাত্র বর্তমানেই নয়, বজায় থাকবে ভবিষ্যতেও। অনেক ভেবে-চিন্তে তৈরি হল দীর্ঘকাল ধরে বজায় থাকার মতো টেকসই উন্নয়নের জন্য ২০৩০-এর এক লক্ষ্যমাত্রার রূপরেখা, যা রাষ্ট্র সংঘের প্রতিটি সদস্য-রাষ্ট্র গ্রহণ করল ২০১৫-য়। এতে ছিল ১৭টি টেকসই উন্নয়ন-লক্ষ্য, যা এই প্রকল্পের কেন্দ্রবিন্দু। উল্লেখযোগ্য যে, এই ১৭টি অ্যাজেন্ডার মধ্যে দ্বিতীয় লক্ষ্যটা ছিল ২০৩০-এর মধ্যে দুনিয়াকে ক্ষুধামুক্ত করা। তালিকার একেবারে প্রথম দিকে, দুনিয়াকে দারিদ্রমুক্ত করার পাশেই ছিল এই লক্ষ্যমাত্রার অবস্থান। তারপর কেটে গেল প্রায় দশ বছর।
প্রকল্প তো হল। তাহলে কি ২০৩০ নাগাদ, অর্থাৎ মোটামুটি বছর ছয়েক পরেই আমরা দেখব এক ক্ষুধাহীন, দারিদ্রহীন পৃথিবী? না, ব্যাপারটা বোধহয় অতটাও সহজ নয়। গদ্যময় দুনিয়ায় কবিতা লেখার দিন বুঝি পিছিয়ে যাচ্ছে আরও। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হল ৩২তম ত্রিবার্ষিক ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অফ এগ্রিকালচারাল ইকোনমিস্টস’। সেখানে জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি-অর্থনীতিবিদ মার্টিন কাইম বললেন যে, রাষ্ট্র সংঘর এই ২০৩০-এর মধ্যে ক্ষুধা দূর করার লক্ষ্য খুব সম্ভবত পূরণ হওয়ার নয়। খাদ্য-সংক্রান্ত নিরাপত্তা আর টেকসই উন্নয়ন নিয়ে গবেষণা করে এ বিষয়ে দুনিয়ার একজন অগ্রণী স্কলার এই অধ্যাপক কাইম। তঁার বক্তব্যের একটা ওজন আছে নিশ্চয়ই। তাই এই বক্তব্যে বেশ শোরগোল পড়েছে মিডিয়ায়।
কিন্তু, একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে যে, অধ্যাপক কাইম একদম নতুন কিচ্ছু বলেননি। তিনি যা বলেছেন তার পুরোটাই দুনিয়ার সংশ্লিষ্ট মহলের জানা গত কয়েক বছর ধরেই। প্রথমে ভাবা যাক যে, ক্ষুধার বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম, এই ক্ষোভ, কি কেবলমাত্র নৈতিকতার প্রকাশভঙ্গি? না, ভেবে দেখলে বোঝা যাবে, বোধকরি তা আরও বেশি কিছু। ২০১৫-য় যখন রাষ্ট্র সংঘ ২০৩০-এর লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করে, মোটামুটি সে-সময় দুনিয়ায় প্রায় ৭৮ কোটি মানুষ যথোপযুক্ত পুষ্টির অভাবে ভুগছে, সে-সময় এক বছরে অনাহারে মারা গিয়েছে প্রায় ৩০ লক্ষ ৫-অনূর্ধ্ব শিশু, প্রায় ৬ কোটি ৬০ লক্ষ শিশু খালি পেটে গিয়েছে ইশকুলে। দুনিয়ার সার্বিক ছবিটা তাই সত্যিই বেশ ভয়াবহ। তবু ২০৩০-এর মধ্যে দুনিয়ার ক্ষুধা মুছে দেওয়ার এই সংগ্রামটাকে, এই প্রকল্পটাকে নিশ্চয়ই এক দশক আগে খুব একটা অসম্ভব লড়াই বলে ভাবেননি সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা, নীতিনির্ধারকেরা এবং বিজ্ঞানীরা। এবং কীভাবে এটা অর্জন করা সম্ভব, তার একটা পরিকল্পনা করে ফেলেন তঁারা।
সমস্যাটা কিন্তু বড়ই জটিল। কারণ, কেবলমাত্র পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন করাই দুনিয়ার ক্ষুধা দূর করার চাবিকাঠি নয়। সেই খাদ্যকে পৌঁছতে হবে দুনিয়ার কোনায়-কোনায় ক্ষুধার্ত, অপুষ্ট মানুষের কাছে। সে বড় সহজ কাজ নয়। খাদ্য জোগান দেওয়ার শিকলকে কার্যকর রাখতে হবে, করতে হবে খাবার বিতরণের উপযুক্ত এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থা। সে-ও বড্ড জটিল প্রকল্প। আর, এর জন্য সহযোগিতা প্রয়োজন দেশ-বিদেশের সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং সাধারণ জনগণের।
যাই হোক– লক্ষ্যমাত্রা, পরিকল্পনা, আর বাস্তবের মধ্যে ফারাক বিস্তর। দেখা যাচ্ছে, ২০১৫ থেকে শুরু করে দুনিয়ায় ক্ষুধা আর খাদ্য নিরাপত্তার অভাব দুইই বরং উল্টে বেড়েছে। বেড়েছে নানা কারণে। তার কিছু সহজে বোঝা যায়, কিছু বোঝা ভীষণ কঠিন। আর সেই সঙ্গে শতাব্দীর ভয়ংকরতম অতিমারী, দুনিয়ার নানা জায়গায় সশস্ত্র সংঘর্ষ, জলবায়ুর পরিবর্তন, ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বৈষম্য– এসবই দুনিয়ার ক্ষুধার পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে চলেছে।
রাষ্ট্র সংঘর বিভিন্ন সংস্থা ২০২২-এর জুলাইতে যে ‘দ্য স্টেট অফ ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ রিপোর্টখানা প্রকাশ করে, তার পরতে-পরতে ফুটে ওঠে এই অসহায়ত্বের ছবিটা। একটা কথা মাথায় রাখতে হবে যে, কোভিড অতিমারির ফলশ্রুতিতে প্রাথমিকভাবে ধাক্কা খেলেও দুনিয়ার খাদ্য নিরাপত্তা কিন্তু অঁাটসঁাট হয়েছে দুনিয়া জুড়েই। তবুও দেখা গেল যে, ২০২০ সালে অতিমারীর ভয়ংকরতম সময় থেকে অনেকটা বেড়ে ২০২১ সালে দুনিয়ায় ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা দঁাড়িয়েছে প্রায় ৮৩ কোটিতে। ২০২২-এর এই রিপোর্ট কিন্তু একটা অনুমানও দিয়েছে ২০৩০-এর ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যার। ২০৩০ নাগাদ নাকি আনুমানিক ৬৭ কোটি ক্ষুধার্ত মানুষ থাকবে এই গ্রহে, যা দুনিয়ার জনসংখ্যার প্রায় ৮ শতাংশ!
তাই, এখনকার পৃথিবীতে দঁাড়িয়ে আজকের গতিপ্রকৃতি অনুসারে অদূর ভবিষ্যতে সার্বিক ক্ষুধাহীনতা অর্জন করা হয়তোএকান্তই কঠিন। বরং দুনিয়া হয়তো এখন ক্ষুধার নিরিখে পৌঁছেছে এমন পর্যায়ে, যা ২০০৫ সালের পর থেকে আর দেখা যায়নি। অনেক দেশেই খাদ্যসামগ্রীর দাম এখনও ২০১৫ থেকে ২০১৯-এর মধ্যেকার দামের চেয়ে অনেকটা বেশি। সেটা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জনগণ তাদের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতায় বুঝে চলেছে হাড়ে-হাড়ে। তাই অধ্যাপক মার্টিন কাইম যা বলেছেন তা বোধকরি নতুন কিছু নয়, আকাশ থেকে পেড়ে আনা কল্পনাও নয়।
সাম্প্রতিক অতীতের ঘটনাপ্রকৃতি অনুসারে, প্রাপ্ত তথ্যাদি অনুসারে, দুনিয়া ভালই বুঝতে পারছিল যে ২০৩০-এ ক্ষুধার নিরসন ঘটা সম্ভব নয়। অধ্যাপক কাইম কিন্তু বলেছেন আরও খানিকটা বেশি। তিনি বলছেন– খাদ্য উৎপাদন, বিতরণ এবং গ্রহণের পদ্ধতিতে বড়সড় পরিবর্তন না-ঘটালে শুধুমাত্র ক্ষুধাহীনতার লক্ষ্যমাত্রাই নয়, রাষ্ট্র সংঘের ২০১৫-র ১৭টি টেকসই উন্নয়ন-সম্পর্কিত লক্ষ্যের কোনওটাই অর্জন করা সম্ভব নয় ২০৩০-এর মধ্যে। এবং ভূ-রাজনৈতিক সংঘর্ষ এবং জলবায়ুর সঙ্গে খাদ্য আর অপুষ্টি তো অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে। সশস্ত্র সংঘাত এবং জলবায়ুর পরিবর্তন প্রভাবিত করে চলেছে খাদ্য সমস্যাকে, আর উল্টোদিকে খাদ্য উৎপাদন এবং তার বিতরণও জলবায়ুর উপরে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে অনেকটা।
তাহলে কি অদূর ভবিষ্যতে ক্ষুধার নিরসন ঘটানো আদৌ সম্ভব এই পৃথিবী থেকে? আমরা আশাবাদী হতে চাই। তবে তার জন্য হয়তো রাষ্ট্র সংঘ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থাকে বসতে হবে এখনকার পরিস্থিতি নিয়ে। তথ্যাদি নিয়ে। বিজ্ঞানীদের সঙ্গে। বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে। উদ্যোগপতিদের সঙ্গে। হয়তো তারা সবাই মিলে স্থির করতে পারবে এক নতুন সময়সীমা, ক্ষুধাহীন পৃথিবী অর্জনের জন্য। তৈরি করতে হবে পরিকল্পনার এক নতুন রূপরেখা। এবং মনে রাখতে হবে যে, এক জটিল সংঘাত-দীর্ণ অতিমারী-উত্তর দুনিয়ায়, জলবায়ুর নিয়ত পরিবর্তনশীলতার মধ্যে অসাম্য, দারিদ্র এবং ক্ষুধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ বড় কঠিন কাজ। অন্য যে কোনও সংগ্রামের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক আইএসআই কলকাতার অধ্যাপক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.