সুতীর্থ চক্রবর্তী: নির্মলা সীতারমণের বাজেটকে কী বলে ডাকা যাবে, তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক চলছে। এই বাজেট কি আর্থিক বৃদ্ধির বাজেট? না কি কর্মসংস্থানের বাজেট? না কি শুধুই ভোটের বাজেট? এই প্রশ্নগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে।
নির্মলার বাজেটে প্রচুর সরকারি খরচের কথা বলা থাকবে, এটা প্রত্যাশিতই ছিল। অতিমারী শুরু হওয়ার পর থেকে অর্থনীতিবিদরা সরকারকে টাকা খরচ করার পরামর্শ দিয়ে আসছেন। লাগাতার একবছর ধরে এই পরামর্শ চলছে। বাজেট ভাষণ দেওয়ার পর সাংবাদিক বৈঠকে দেখা গেল, নির্মলা বেশ শ্লেষের সঙ্গেই বললেন, ‘কোষাগার ঘাটতি সাড়ে ৯ শতাংশ। গোড়ায় লক্ষ্য ছিল সাড়ে ৩ শতাংশ। অর্থাৎ লক্ষ্যের চেয়ে ৬ শতাংশ বেশি ঘাটতি হতে চলেছে। এর মানে দাঁড়ায়, সরকার খরচ করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে।’
বাজেটের প্রধান দু’টি বৈশিষ্ট্য হল, পরিকাঠামোয় আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ ও স্বাস্থ্যখাতে ১৩৭ শতাংশ বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং আয়কর-সহ প্রত্যক্ষ করের হারে কোনওরকম পরিবর্তন না করা। এছাড়া, অর্থমন্ত্রীর বাজেটে উল্লেখ করার মতো কিছু বৈশিষ্ট্য নেই। নির্মলা ঘোষণা করেছেন, ‘এলআইসি’ এবার বাজারে শেয়ার ছাড়বে। এটা মধ্যবিত্তের মনে তোলপাড় ফেলেছে। কিন্তু গত বছরই এলআইসি’র বিলগ্নিকরণের কথা বলা হয়েছিল। এবার সেটা বাস্তবায়িত হচ্ছে। তবে বিমাক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের না-হওয়া একটি সংস্কার নির্মলা এবার করতে পেরেছেন। বিমা কোম্পানিতে বিদেশি লগ্নির ক্ষেত্রে ৭৪ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হয়েছে। এই সংস্কারকে স্বাগত জানাচ্ছে বিরোধী দলও। এতে বিদেশি লগ্নি আসার পথ খুলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
নির্মলার এবারের বাজেট নিয়ে প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল। মধ্যবিত্ত কিছু ছাড়ের আশা করছিল। মনে করা হচ্ছিল, বাজারের চাহিদা বৃদ্ধি করতে মধ্যবিত্তের আয়ের উপর অর্থমন্ত্রী কিছুটা নির্ভরশীল হবেন। কিন্তু তিনি সে-পথে হাঁটেননি। আয়করের কাঠামোয় কোনও পরিবর্তনই এল না। পরোক্ষ করেও কোনও সুবিধা নেই। ৭৫-ঊর্ধ্বদের আয়কর রিটার্ন জমা না দেওয়ার সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে আর্থিক লাভ কিছু নেই। পেনশন ও সুদ থেকে আয়ের উপর ব্যাংকই টিডিএস করে নেবে। কিছু কিছু পণ্যের উপর আমদানি শুল্ক কমিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু তাতেও উল্লেখযোগ্য কিছু সুবিধা মিলছে না।
তবে নির্মলার বাজেট থেকে আরও একবার জানা গিয়েছে, শাসকদলের কাছে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোট কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। নতুন যে যে প্রকল্প ঘোষণা হল, তার প্রায় ৯০ শতাংশই এই ভোটমুখী রাজ্যগুলি ঘিরে। কেন্দ্রীয় বাজেটে অতীতে রাজ্য বিধানসভা ভোটের ছায়া এত লম্বাভাবে পড়তে দেখা যায়নি। অর্থমন্ত্রী বা রেলমন্ত্রীরা নিজের রাজ্যের প্রতি ঝোল টেনেছেন- এই অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। কিন্তু বিধানসভা ভোট সাধারণভাবে কেন্দ্রীয় বাজেটে গুরুত্ব পায় না। প্রতি বছরই দেশের কোনও না কোনও রাজ্যে ভোট লেগে থাকে। বাজেটে যদি সেটাকে গুরুত্ব দিতে হয়, তাহলে দেশের প্রেক্ষিতে সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গিটা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। এবারের বাজেট দেখে বিহার ও উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দাদের অসন্তোষ হতে পারে। ভোট নেই বলে কি আমরা বঞ্চিত হলাম? প্রশ্ন তুলতে পারেন ওসব রাজ্যের বাসিন্দারা।
কেন্দ্রীয় সরকার পরিকাঠামো ও স্বাস্থ্যখাতে অপ্রত্যাশিত হারে খরচ বাড়িয়েছে, সে কথা ঠিক। কিন্তু লকডাউনের জেরে কোটি কোটি পরিযায়ী শ্রমিককে যে দুর্ভোগের মধ্যে আমরা পড়তে দেখেছিলাম, তার কোনও প্রতিফলন কিন্তু বাজেটে ঘটল না। অর্থাৎ, দীর্ঘ লকডাউনে যে মানুষগুলো চাকরি খোয়াল, তাদের চাকরি পাওয়ার বিষয়ে কোনও নিশ্চয়তা পাওয়া গেল না। অর্থমন্ত্রী বলছেন, পরিকাঠামো নির্মাণে কাজ শুরু হলেই প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এখন দেখার, বেকারত্ব সামাল দিতে সেটাই যথেষ্ট কি না। লকডাউনে প্রচণ্ডভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে পরিষেবা ক্ষেত্র। পর্যটন, হোটেল, পরিবহণ ইত্যাদি শিল্প সাংঘাতিকভাবে ধাক্কা খেয়েছে। এই ক্ষেত্রগুলিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। সরাসরি বাজেটের মধ্য দিয়ে এই ক্ষেত্রগুলির জন্য কী করা যেত, তার জবাব জানা নেই। কিন্তু এই ক্ষেত্রগুলি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর ভাষণে সম্পূর্ণ উহ্য-ই থেকে গেল।
সরকারি ব্যয় বাড়লে, তা আরও বেসরকারি লগ্নিকে আকর্ষণ করে নিয়ে আসে। পরিকাঠামোয় ব্যয়বৃদ্ধির এই ‘মাল্টিপ্লায়ার এফেক্ট’-এর উপর ভরসা রেখেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। গোড়ায় অর্থমন্ত্রীর ভাষণ শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, সত্যিই বুঝি কল্পতরু হয়েছেন অর্থমন্ত্রী। মন্দার সুযোগে আরও বহু চমকপ্রদ প্রকল্প মিলবে সরকারের কাছ থেকে। বাজেট-ভাষণ শেষের পর অবশ্য মনে হল, চমক তেমন কিছু নেই। আবার আর্থিক সংস্কারের লক্ষ্যে বড় কোনও ঝাঁপও নেই। এককথায় বেশ সাবধানী থেকেছেন নির্মলা সীতারমণ ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.