বিভাজন প্রধানত হিন্দু-মুসলমানে আবদ্ধ রাখতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’ আনার ভাবনায় মশগুল। তবে ইসলাম ছাড়াও রয়েছে ভিন্ন ধর্ম ও তাদের নিজস্ব ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আইনসমূহ। অসন্তোষ ও অশান্তির সলতেয় যে আগুন বিজেপি লাগাতে চলেছে, পারবে তো তা সামলাতে বিরোধ সর্বব্যাপী হলে? লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘মহিলা সংরক্ষণ বিল’ নিয়ে মাঝে মাঝে কিছু আলোচনা যেমন হয়, তেমনই ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’ও (Uniform Civil Code) কখনও সখনও তিমি মাছের মতো ভুস করে মাথা তোলে। দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য অবশ্য আছে। মহিলা সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা রাজীব গান্ধী প্রথম অনুভব করলেও বিষয়টি কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের একচেটিয়া দাবির পরিচিতি পায়নি। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কিন্তু একেবারেই বিজেপির (BJP) নিজস্ব। পেটেন্ট নেওয়া।
ইন্দিরা-হত্যার পর লোকসভায় বিরোধীদের মধ্যে যখন অন্ধ্রপ্রদেশের জঙ্গা রেড্ডি ও গুজরাতের এ কে প্যাটেল টিমটিমে বিজেপির উপস্থিতির জানান দিতেন, সেই সময় বিজেপির দপ্তরে লালকৃষ্ণ আডবানি, জগদীশপ্রসাদ মাথুর, সুন্দর সিং ভান্ডারিরা বোঝাতেন কেন অন্য সব দলের চেয়ে বিজেপি আলাদা। আডবানি বলতেন, ‘আমরাই রাম জন্মভূমির মুক্তি, সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজ ও অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার কথা বলি। অন্যরা কেউ এসব বলে না। এজন্যই আমরা ভিন্ন।’’
ভারতীয় ‘জন সংঘ পার্টি’-র (বিজেপির জন্ম ১৯৮০ সালের ৬ এপ্রিল) প্রথম নির্বাচনী ইস্তাহারে (১৯৫১) ‘হিন্দু কোড বিল’-এর উল্লেখ করে বলা হয়েছিল, কোনও সামাজিক সংস্কার চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। তাগিদটা সমাজের ভিতর থেকেই আসা উচিত। ১৯৬৭ সালে দলের নির্বাচনি ইস্তেহারে প্রথমবার অভিন্ন দেওয়ানি বিধির উল্লেখ করা হয়। সেই থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত ভারতীয় রাজনীতি ছিল টালমাটাল। অভিন্ন দেওয়ানি বিধির দাবিও ছিল স্তিমিত। ১৯৮৬ সালে শাহ বানো মামলা বিজেপিকে প্রাণিত করে ওই দাবি ফের আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসতে। তুলে ধরা হয় ‘কংগ্রেসের মুসলমান তোষণ নীতি’র ধ্বজা। আজ মনে হচ্ছে, নরেন্দ্র মোদির হাত ধরে সেই প্রতিশ্রুতিও সাকার হতে চলেছে।
শাহ বানো বেগম ছিলেন মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরের গৃহবধূ। তাঁর আইনজীবী স্বামী মহম্মদ আহমেদ খান দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। দুই বউ নিয়ে কয়েক বছর একই ছাদের তলায় সংসার চালানোর পর ১৯৭৮ সালে তিনি শাহ বানোকে তালাক দেন। খোরপোশের দাবিতে ইন্দোরের নিম্ন আদালতে ফৌজদারি মামলা দায়ের করেন শাহ বানো। জিতেও যান। কিন্তু আইনজীবী স্বামী খোরপোশ দিতে নারাজ। তাঁর দাবি, শরিয়ত অনুযায়ী যা দেওয়ার দেবেন, বাড়তি নয়। ফলে মামলা গড়ায় হাই কোর্ট হয়ে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। ১৯৮৫ সালের এপ্রিল মাসে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ওয়াই ভি চন্দ্রচূড়ের (বর্তমান প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের বাবা) নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ শাহ বানোর পক্ষে রায় দেয়। তিনি আমৃত্যু খোরপোশ পাওয়ার অধিকারী হন।
প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সেই রায় যুগান্তকারী মনে করেছিলেন। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের স্নাতক আরিফ মহম্মদ খান তখন রাজীবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও মন্ত্রিসভার সদস্য। রাজীব তাঁকে দায়িত্ব দেন সুপ্রিম কোর্টের ওই প্রগতিশীল রায়ের পক্ষে জনসমর্থন আদায়ের। মনে আছে, লোকসভায় চমৎকার ভাষণ দিয়েছিলেন আরিফ। কিন্তু বিধি বাম। ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড’ ও ‘জামায়েত উলেমা-ই-হিন্দ’ আন্দোলন শুরু করে। পোড়খাওয়া কংগ্রেসি নেতারা প্রমাদ গোনেন। রাজীবকে বোঝান। রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ রাজীবও ভোটের কথা ভেবে পিছিয়ে আসেন। মুসলমান সমর্থনের কথা ভেবে ১৯৮৬ সালে ‘দ্য মুসলিম উইমেন (প্রোটেকশন অফ রাইটস অন ডিভোর্স) আইন’ পাস করে তিনি সুপ্রিম কোর্টের রায়কে অকার্যকর করে দেন।
বিজেপির হাতে সেটাই হয়ে ওঠে মারাত্মক অস্ত্র। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে শুরু হয় মুসলমান তোষণের প্রচার। ১৯৯৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেওয়ার পরের বছর থেকে এ-পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনে বিজেপি নিয়ম করে এই বিধি চালুর প্রতিশ্রুতি শুনিয়ে গিয়েছে। অযোধ্যা-মুক্তি ও ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজের পর নরেন্দ্র মোদির অধরা বলতে শুধু এটাই। ২০২৪-এর যুদ্ধ শুরুর আবহ রচনায় এটাই তাঁর মোক্ষম হাতিয়ার হতে চলেছে কি না সেই জল্পনাও তিনি নিজেই উসকে দিলেন অধুনা প্রয়াত শাহ বানোর রাজ্যে গিয়ে। ভোপালে দলীয় কর্মী সমাবেশে জানালেন, পরিবারের প্রত্যেকের জন্য আলাদা নিয়ম থাকলে সংসার যেমন চালানো যায় না, তেমনই ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থা জারি থাকলে দেশ শাসনও অসম্ভব। প্রয়োজন অভিন্ন ব্যবস্থার।
ভোট আবহে হিন্দু-মুসলমান বিভেদ বিজেপির ঝুলি বারবার ভরিয়েছে। লোকসভার আসন ২ থেকে ৩০৩-এ পৌঁছে দিয়েছে স্রেফ এই একটি উপাখ্যান। ‘হিন্দুত্ববাদ’ ও ‘জাতীয়তাবাদ’ সমার্থক করে দেওয়া হয়েছে। এবারেও সেই লক্ষ্যে মোদি সফল হবেন কি না নির্ভর করছে কীভাবে ঘুঁটি চালবেন তার উপর। কাজটা অসম্ভব না হলেও কঠিন। কারণ, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি শুধু মুসলমান নয়, হিন্দু, শিখ, জৈন, পারসি, খ্রিস্টান মায় উপজাতিদের এক বৃত্তে টেনে আনবে। সৃষ্টি হবে প্রতিরোধ। কীভাবে তার সামাল বিজেপি দেবে সেই রূপরেখা এখনও অদৃশ্য। আইন কমিশনকে দিয়ে প্রক্রিয়ার সলতে পাকানোর কাজটুকু শুধু শুরু হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর তাগিদ কত তীব্র, তা বুঝিয়ে দেয় ২২তম আইন কমিশনের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা। মতামত জানাতে দেশবাসীকে দেওয়া হয়েছে মাত্র একমাস। আইন মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও এ নিয়ে চটজলদি বৈঠক ডাকে। কমিটির বিজেপি চেয়ারম্যান সুশীল মোদি প্রথম বৈঠকেই উপজাতিদের ওই বিধির বাইরে রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন। কারণটা স্পষ্ট। উপজাতি অধ্যুষিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রতিটি রাজ্যই এই বিধির বিরোধিতায় সরব। এই তল্লাটে লোকসভার মোট আসন ২৫। তাদের অভিন্ন দেওয়ানি বিধির আওতার বাইরে না-রাখলে একটি আসনও বিজেপির জুটবে না। যে-কারণে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে গোহত্যা, গোরক্ষা ও গোমাংস ভক্ষণের বিরুদ্ধে বিজেপি ট্যাঁ ফোঁ করে না, সেই কারণে দেওয়ানি বিধিও তারা সেখানে ভিন্ন রাখার পক্ষে। দেশের মোট ৪৭টি লোকসভা কেন্দ্র উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত। তাদের অভিন্ন দেওয়ানি বিধির আওতামুক্ত না-রাখলে ঘোর বিপদ।
কিন্তু শুধু উপজাতি সমাজই নয়, মুসলমানদের পাশাপাশি হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন, পারসি সমাজেও কি তোলপাড় শুরু হবে না? সরকার যতই চাক বিয়ে, বিবাহবিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার ও দত্তক নিয়ে এক আইন চালু করতে, সব সমাজ কি তাতে সহমত হবে এত সহজে? হিন্দুরা? যাদের রীতিনীতির রকমফেরও অসীম? সনাতন হিন্দুত্বের শাখা তো অশেষ পল্লবিত। এই ধর্মে উত্তরাধিকারীকে বঞ্চিত করে যে কেউ নিজের সম্পত্তি যাকে খুশি দিয়ে যেতে পারে। উইল করতে পারে। কিন্তু ইসলামে উত্তরাধিকারীকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যায় না। সম্পত্তির ভাগ কে কতটা পাবে, তা ‘কোরান শরিফ’-এ স্পষ্ট বলা আছে। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে মুসলিম পারিবারিক আইন তৈরি হয়েছে কোরান শরিফের চতুর্থ সুরা ‘আন নিসা’ অনুযায়ী। শিখ ধর্মে বিয়ে হয় ১৯০৯ সালের ‘আনন্দ বিবাহ আইন’ অনুযায়ী। অভিন্ন আইন হলে ওটিও বিলুপ্ত হবে। শিখরা মানবে তো? পারসি ধর্মে নারীরা অন্য ধর্মে বিয়ে করলে ধর্মচ্যুত হয়। দত্তক কন্যা অধিকারহীন হয়। খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মেও রীতিনীতির বৈষম্য প্রচুর। বিরোধ সর্বব্যাপী হলে সামলাতে পারবে তো সরকার?
২১তম আইন কমিশন এসব কারণেই বাদ সেধেছিল। বলেছিল, এখনই তা কাঙ্ক্ষিত নয়, প্রয়োজনও নেই। ইসলামের বহুবিবাহ প্রথা নিয়ে কমিশন বলেছিল, মুসলমান সমাজের এই প্রথায় বহু হিন্দুও আশ্রয় নিচ্ছে। বলতে বলতেই মনে আসছে বিজেপিরই দুই নেতা-নেত্রী স্বামী-স্ত্রী জুটি ধর্মেন্দ্র-হেমা মালিনীর নাম। আইন ফাঁকি দিতে আইনত তাঁরা কিন্তু মুসলমান!বিভাজনটা প্রধানত হিন্দু-মুসলমানে আবদ্ধ রাখতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদির সরকার অসন্তোষ ও অশান্তির সলতেয় আগুন দিতে চলেছে না তো? উপজাতিদের মতো ধীরে ধীরে একে-তাকে বাদ দিয়ে নজরটা শুধু মুসলমানকেন্দ্রিক করে তুললে আর যাই হোক, নতুন দেওয়ানি বিধি ‘অভিন্ন’ হবে না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.