Advertisement
Advertisement

যুদ্ধাস্ত্র যখন ‘মিম’ ও ‘টিকটক ভিডিও’

রাশিয়ার প্রোপাগান্ডাকে টক্কর দিয়েছে ইউক্রেন।

Ukraine beats Russia in the propaganda war। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:March 2, 2023 3:16 pm
  • Updated:March 2, 2023 3:16 pm  

যে কোনও যুদ্ধে সেনা ও জনসাধারণকে উদ্দীপ্ত রাখা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই প্রচেষ্টা থাকে বিশ্বের কাছে যুদ্ধের টাটকা খবর পৌঁছে দেওয়া। ইউক্রেনের ‘ইউনাইটেড টোয়েন্টিফোর মিডিয়া’ যেসব টিকটক ভিডিও বা মিম তৈরি করে প্রতিরক্ষা দপ্তরের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে নিয়মিত ‘পোস্ট’ করেছে, তাতে স্পষ্ট মস্কোকে টেক্কা দিয়েছে কিয়েভ। লিখলেন সুমন ভট্টাচার্য

ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ (Ukraine-Russia) কি ‘টিকটক ওয়ার’? এখন পশ্চিমের সংবাদমাধ্যম এই ধরনের ‘ক্যাচলাইন’ দিচ্ছে। এর কারণ– যুদ্ধের এক বছর অতিক্রান্ত হলেও যেভাবে ভলোদিমির জেলেনস্কি-র ইউক্রেন বিশ্বখ্যাত ‘রেড আর্মি’-র প্রত্যুত্তর দিয়ে চলেছে, তাতে কিয়েভের রণকৌশল ও প্রত্যাঘাতের গুরুত্ব নিয়ে আর সংশয় নেই। বিগত এক বছরের লড়াইয়ে ইউক্রেনকে যতটা জমির লড়াই লড়তে হয়েছে, ততটাই মোকাবিলা করতে হয়েছে ‘প্রোপাগান্ডা ক্যাম্পেন’ তথা ‘প্রোপাগান্ডা মেশিনারি’-র। ভ্লাদিমির পুতিনের সাইবার ফোর্স একদা হিলারি ক্লিনটনকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হারিয়ে দিয়েছিল। অথচ, সেই রাশিয়া (Russia) বিস্ময়করভাবে এবারের সাইবার যুদ্ধে জেলেনস্কির কাছে পর্যুদস্ত। যুদ্ধের বর্ষপূর্তিতে ইউক্রেনীয় (Ukraine) প্রেসিডেন্ট গণতন্ত্র এবং প্রতিরোধের নতুন প্রতীক। তাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ট্রেনে চেপে দশ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে কিয়েভে পৌঁছে যেতে হয়!

Advertisement

যে কোনও যুদ্ধে আপন সেনা ও জনসাধারণকে উদ্দীপ্ত রাখা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই সবসময় প্রচেষ্টা থাকে বিশ্বের কাছে যুদ্ধের টাটকা খবর পৌঁছে দেওয়ার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যাডল্‌ফ হিটলারকে কেন্দ্র করে প্রাথমিক যে ‘মিথ’ তৈরি হয়েছিল বা জার্মানির অপ্রতিরোধ্য সামরিক শক্তি সম্পর্কে বিশ্বে যে ভীতি তৈরি হয়েছিল, তার প্রধান কারণ ছিল নাৎসিদের ‘প্রোপাগান্ডা মেশিন’। এই প্রোপাগান্ডা-কে প্রতিরোধ করতে গত শতকের চারের দশকে ইংল্যান্ড কিংবা আমেরিকার কালঘাম ছুটে যায়। হালের বহু প্রতিষ্ঠানের– যেমন, ‘ভয়েস অফ আমেরিকা’-র মতো বেতারকেন্দ্র– জন্ম হয়েছিল শুধুমাত্র বার্লিনের রণকৌশলের পালটা জবাব দিতে। গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ ট্যাঙ্ক যখন প্রথম আক্রমণ শুরু করে, তখন থেকেই জেলেনস্কি বাহিনীর অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল মস্কোর প্রোপাগান্ডা মেশিনের প্রতিস্পর্ধী জবাব দেওয়ার। আগুয়ান তালিবান বাহিনীর সামনে প্রতিরোধ
না-গড়ে আফগানিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু জেলেনস্কি সে-পথে হঁাটেননি। প্রতিরোধ করেন সরাসরি। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট থেকে প্রথম যে ভিডিওটি ‘পোস্ট’ করা হয়েছিল, সেটি ছিল রাতের কিয়েভে জেলেনস্কি কীভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সহ-নাগরিকদের উদ্দীপ্ত করছেন– তার দৃশ্য ও বিবরণমালা।

[আরও পড়ুন: কংগ্রেস নেতার মেয়ের NGOতে বন্ধ বিদেশি অনুদানের লাইসেন্স, তোপ বিরোধীদের]

সেই শুরু। তারপর থেকে গত এক বছরে ইউক্রেনের ‘ইউনাইটেড টোয়েন্টিফোর মিডিয়া’-র কাজ যেমন ছিল সেনাবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য অর্থ সংগ্রহ, তেমনই বিশ্বের কাছে এই ‘বার্তা’/ ‘খবর’ পৌঁছে দেওয়া, যে, পূর্ব-ইউরোপের এই দেশে যুদ্ধে ঠিক কী কী হচ্ছে।
যে কৌশলে তারা কাজটি করে, তা সাইবার বিশেষজ্ঞদের তো বটেই, এমনকী, যঁারা ডিজিটাল মার্কেটিং ও ‘ডিজিটাল ওয়ারফেয়ার’ নিয়ে গবেষণা করেন– তঁাদেরও বিস্মিত করে!
‘ইউনাইটেড টোয়েন্টিফোর মিডিয়া’ যেসব ভিডিও বা মিম তৈরি করে প্রতিরক্ষা দপ্তরে টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে নিয়মিত ‘পোস্ট’ করেছে, তার ধারাবাহিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে– প্রচারযুদ্ধে কিয়েভ স্পষ্টত মস্কোকে টেক্কা দিয়েছে।

যেমন, অতি সম্প্রতি ‘ন্যাটো’-র কাছ থেকে ট্যাঙ্ক পাওয়ার পরে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা দপ্তর একটি ভিডিও টুইট করে। সেখানে মনে করিয়ে দেওয়া হয়, যুদ্ধের প্রথমে পশ্চিমের সব সংবাদমাধ্যম– ‘দ্য গার্ডিয়ান’ থেকে শুরু করে ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’-ও সে তালিকায় ছিল– ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে, মস্কোর লাল ফৌজের আক্রমণের সামনে ইউক্রেনের প্রতিরোধ কয়েক ঘণ্টার মাত্র! কিন্তু প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির বাহিনী শুধু নিজেদের জমি ধরে রাখেনি, প্রাথমিক ধাক্কায় রুশ ফৌজ যেসব এলাকা দখল করেছিল, পালটা আক্রমণে তার কিছু কিছু ছিনিয়েও নিয়েছে। এই কথাটি মনে করিয়ে দিয়ে ভিডিওয় বলা হয়েছে– এবার ট্যাঙ্ক হাতে পাওয়ার পর আমরা শত্রুদের কী অবস্থা করি, তা দেখুন।

[আরও পড়ুন: ক্ষমতায় এলেই ৫০০ টাকায় গ্যাস, LPG মূল্যবৃদ্ধির দিনই বড় ঘোষণা কংগ্রেসের]

রক্তক্ষয়ী বিধ্বংসী একটি যুদ্ধ ঘিরে যে ‘টিকটক ভিডিও’ তৈরি হতে পারে, গান দিয়ে যে মিম বানানো যেতে পারে, তা ইউক্রেনের ‘ইউনাইটেড টোয়েন্টিফোর’ প্রথম করে দেখাল। এই সংস্থার প্রধান ও বিপণন-বিশেষজ্ঞ ভালেন্তিন পানিউতা সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘আমরা জানতাম বিষয়টা কঠিন। কিন্তু যদি এভাবে প্রতি মুহূর্তে বিশ্বকে আমরা না-জানাতাম ইউক্রেনে কী হচ্ছে, তাহলে সবাই ভুলে যেত রাশিয়া আমাদের আক্রমণ করেছে। দুনিয়ার চেতনায় আর মননে টিকে থাকাটা ছিল আমাদের প্রথম লড়াই। আর, তারপরের কাজ ছিল সবাইকে জানানো যে– মস্কোর কথায় বিশ্বাস করবেন না, জেলেনস্কি-ও পালাননি আর রাশিয়ার ট্যাঙ্ককে গোলাপ ফুল দিয়ে ইউক্রেনবাসী অভ্যর্থনা জানাচ্ছে না।’’ ইউক্রেনের প্রচার অভিযানের কর্তা যা বলেছেন, যথার্থ। প্রতিরোধ, প্রত্যাঘাত ও পেশাদারিত্বের নিপুণ সংযোগ তৈরি করতে না-পারলে এমনটি হয় না।

যেমন ধরা যাক, ইউক্রেন বিমানবাহিনীর সেই পাইলটের কথা, যিনি ইতিমধ্যেই ‘ঘোস্ট অফ কিয়েভ’ বলে পরিচিত। একের-পর-এক রুশ বিমানকে ধ্বংস করে দেওয়ার তঁার বীরগাথা শুধু ইউক্রেনের মানুষদের প্রতিরোধের লড়াইতে উজ্জীবিত করেনি, বিশ্বকে শিহরিত ও মস্কোর সামরিক ক্ষমতা নিয়ে সংশয়ী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। যুদ্ধের কয়েক মাস পরে, যখন ইউক্রেনের সেনাবাহিনী প্রতি-আক্রমণে গিয়ে একের-পর-এক এলাকা ছিনিয়ে নিচ্ছে, তখন ফ্রন্টলাইন থেকে জেলেনস্কির সেনানীদের পতাকা নিয়ে গান এবং জেতার অদম্য আবেগ– ইউরোপকে আলোড়িত করেছে। আর, মস্কোর সম্পর্কে এতদিন যে সমীহ ছিল, সেই ন্যারেটিভকেও খণ্ডন করছে।

যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ‘মিত্র পক্ষ’ অর্থাৎ ইংল্যান্ড এবং আমেরিকার জয়ের নেপথ্যে
প্রচার কৌশলের গুরুত্ব জানেন, বুঝতে পারবেন কোথায় জেলেনস্কি এগিয়ে। আসলে, রাশিয়ার আক্রমণকে যদি শুধু একটি ইউরোপীয় গৃহযুদ্ধ রূপে না-দেখি, যদি নতুন করে ওয়াশিংটন এবং মস্কোর মধ্যে ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’-র নব্য এক্সটেনশন বলে চিনে নিতে চাই, তাহলে আপৃথিবীর রাজনৈতিক বাস্তবতা বুঝতে সুবিধা হবে। এবং সে-বাস্তবতায় ‘গ্লোবাল নর্থ’ ও ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর দ্বন্দ্ব রয়েছে। সুবিধা হবে এটাও বুঝতে যে, কেন আমেরিকা ও ইউরোপের বড় শক্তিগুলি রাশিয়া-চিনের সখ্য নিয়ে চিন্তিত। প্রশ্নমুখর। নয়া দিল্লি যতই ‘গ্লোবাল সাউথ’
বা বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যেসব দেশেবসবাস করেন, সেসব দেশের মুখ্য প্রতিনিধি রূপে তুলে ধরতে সচেষ্ট থাকুক– ‘গ্লোবাল নর্থ’ চটে থাকলে বা তাদের আস্থা টলে গেলে কী হতে পারে, তা শেয়ার বাজারের সাম্প্রতিক টালমাটাল অবস্থা বলে দেয়। ‘গ্লোবাল নর্থ’ ও ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর মধ্যে বিভাজন যখন স্পষ্ট, তখন দ্বিতীয় পক্ষের নেতৃত্ব দিতে গেলে প্রথম পক্ষের অর্থনৈতিক শক্তি থেকে সামরিক কৌশল সম্পর্কে সম্মুখ অবহিত থাকা প্রয়োজন। তা না হলে ভারতকেও বিশ্বের মানুষ চিনের সঙ্গে একই বন্ধনীতে দেখতে শুরু করতে পারে। আর, তা আমাদের অর্থনৈতিক উচ্চাশা বা বিনিয়োগের ‘গ্লোবাল ডেস্টিনেশন’ হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে খাপ খায় না।

পুনশ্চ: ‘এনিমি অ্যাট দ্য গেট্‌স’ (২০০১) সিনেমায় প্রবল ক্ষমতাধর নাৎসি বাহিনীকে মোকাবিলা করতে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন হিমশিম খাচ্ছে, তখন তারা হন্যে হয়ে খুঁজেছিল এক ‘নায়ক’-কে। যার বীরত্ব ও সাহসিকতার কথা তুলে ধরে মানুষের মনে প্রতিরোধের আগুন উসকে দেওয়া যাবে। উত্থান ঘটে ভাসিলি জাইৎসেভের। যাকে ঘিরে সোভিয়েত স্বপ্ন দেখা শুরু করে নতুন করে। রাশিয়া থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন সত্তার অধিকারী হয়েও ইউক্রেন সাবেক সোভিয়েতের ক্লাসিক রণনীতি ভোলেনি। বরং হাতে-কলমে রাশিয়ার বিরুদ্ধেই তা প্রয়োগ করেছে। এবং নায়কের সন্ধানেও তাদের আকাল হয়ে ঘুরতে হয়নি। ঘরের ছেলেই হয়েছে দেশের নায়ক– জেলেনস্কি।

২০২৪ এর পূজা সংক্রান্ত সমস্ত খবর জানতে চোখ রাখুন আমাদের দেবীপক্ষ -এর পাতায়।

চোখ রাখুন
Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement